মিরাকেল চুরি

কিযী তাহনিন
Published : 18 Sept 2017, 02:36 PM
Updated : 18 Sept 2017, 02:36 PM

বাহ্, একেই কি বলে মিরাকেল? বাংলায় যাকে বলে অলৌকিক কোনো ঘটনা। তবে, এক্ষেত্রে আমার ইংরেজি শব্দটি বেশি ভালো লাগে। মিরাকেল, কেমন ছন্দ আছে, জাদুময়। মনে হয়, হলো বুঝি তেমন কিছু, যেমন আগে হয়নি, তেমন কিছু, যেমন ভাবি অনেক ভাবার মাঝে। এ জীবনে, তেমন মিরাকেল কিছু হয়নি। বা ঘটেছে। হয়তো ভুলে গেছি। আমরা দুঃখ পুষতে ভালোবাসি। কিন্তু আনন্দময় কিছু ঘটে যাবার পরে, অতি দ্রুত তার সুঘ্রাণটুকু হারিয়ে ফেলি। রয়ে যায় পুরোনো ঘটনার শুকনো রসহীন কুঁচকে যাওয়া চামড়া। আর তাকে ছুঁড়ে ফেলে আবার আবার নতুন কিছু খুঁজি। ভুলে যাই পুরোনো সুঘ্রাণ কেমন ছিল। খুঁজি নতুন মিরাকেল, অলৌকিক কিছু। পুরোনোটুকু ভুলে যাওয়াতেই তখন সুখ, নতুন খোঁজায় তখন সব ভালোলাগার ঘর-বাড়ি। তাই ঠিক মনে পড়ছেনা এ মুহূর্তে, মিরাকুলাস কিছু ঘটেছিলো কিনা।

যে মুহূর্তে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে, ঘুম ঘুম চোখে সকালের প্রথম দরজা খুলছিলাম, ভাবিনি এমন কিছু ঘটবে। বুঝিনি দরজার সামনে বসে সে আমার অপেক্ষা করবে। দরজা খুলে প্রতিদিনের মতন, সদ্য ঘুমভাঙা এলোমেলো আমি, মেঝে থেকে আজকের পত্রিকাটি তুলে নিলাম। পত্রিকায় বিল গুঁজে গেছে করিম হকার। বিলটি হাতে নিয়ে দেখবো যখন, তখন দু তিন পলক এদিক সেদিন হতে হতেই দেখি তিনি বসে আছে। আসনপিঁড়ি হয়ে। ঘুম পালালো, কেঁপে উঠলাম আমি, যেন বেঁচেও উঠলাম। এক প্রতিদিনের একইরকম সকাল মুহূর্তে লন্ডভন্ড, আনন্দের কাঁচভাঙ্গা ঝনঝন – মিরাকেল একদম। সামনে বসা, চোখ বন্ধ, আসনপিঁড়ি, বাম হাত তাঁর গায়ে জড়ানো টেরাকোটা রঙের চাদরে লুকোনো, অন্য হাত ডান হাঁটুর উপরে, শান্ত তিনি, তাড়াহীন, আমার সামনে তিনি। পত্রিকাটি মাটিতে নামিয়ে রেখে, খুব আলতো করে দুহাতে দুলে নিলাম তাকে।

গৌতম বুদ্ধ। আমার দরজার সামনে এভাবে অপেক্ষমান, নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে, ব্যাখ্যা আছে। এ পৃথিবীতে কিছু ভালো মানুষ এক সময়ে জন্মেছিলেন, ভালো কথা বলেছিলেন। সব ধর্ম-জাতি তাঁদের শ্রদ্ধা করে। আমিও। তাঁর টেরাকোটা মূর্তি দরজার সামনে। এমন একজন শক্তিমান মানুষের টেরাকোটা মূর্তি আমার দরজায়, কোনো এক কারণে এসে স্থান নিয়েছে নিশ্চয়ই। এটি কি মিরাকেল নয়? অলৌকিক?

আমি মূর্তিটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কয়েক মুহূর্ত। আহা, এমন নিখুঁত কারুকাজ আমি দেখিনি আগে। লালচে কমলা, টেরাকোটা রং। চোখ বন্ধ, ঠোঁটের কোন এক চিমটি হাসি, যেন কিছু বলবে, বলবে তেমন কিছু যা আমার শুনতে ইচ্ছে করে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। গায়ে জড়ানো কমলা রঙা চাদরটি এতই বাস্তব, যে আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন তার বুনোট অনুভব করা যায়। এমন অমূল্য এক শিল্প আমার দরজার সামনে কেন?

কেউ ফেলে দিয়ে গেছে? এই অমূল্য অস্তিত্ব কে ফেলে দিলো? কেন? হয়তো প্রিয় কারো কাছ থেকে পাওয়া একটুকরো ভালোবাসার মুহূর্তের ধারক, ধ্যানরত গৌতমবুদ্ধ ? "বড্ড প্রিয় তুমি, বেঁচে থাকবার মতন, তাই তোমাকে এই মূর্তিটি দিলাম" – এই বলে হয়তো ভালোবাসার পুরুষ মূর্তিটি দিয়েছিলো প্রিয় কোনো নারীকে, কোনো ছন্দময় ক্ষণে।

কষ্ট দিয়েছে? অভিমান? এতটাই যে মূর্তিটিকেও মিথ্যে মনে হচ্ছে? অথবা অন্যকোনো জীবনের শুরু হবে, তাতে গৌতম বুদ্ধের বা প্রেমিক পুরুষটির অস্তিত্ব নেই। ফেলে দিলো তাই এমন শিল্প? আহারে না জানি কত অভিমান, না-ভালোলাগা কিংবা অন্যরকম ভবিষ্যতের স্বপ্নের বিনিময়ে হারাতে হলো তাঁকে, স্মিত গৌতম বুদ্ধকে।

কিন্তু আমার বাড়ির সামনে এলো কি করে? তবে কি করিম হকার? হ্যাঁ ওই হবে। কাল রাত এগারোটায় যখন শানিলার বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরলাম, এতো এখানে ছিলোনা। তবে করিম হকার ছাড়া কে হবে? বহুদিনের পুরোনো পরিচিত, জানে আমার শিল্পের প্রতি আগ্রহ আছে, মূর্তি সংগ্রহ করতে ভালো লাগে। ওই তবে কুড়িয়ে পেয়ে, বা খুঁজে পেয়ে পত্রিকার সাথে রেখে গেলো?

কত দেশের কত নিমগ্ন ধ্যানরত মূর্তি যে আমার আছে। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও এক খচখচ – ঠিক তেমনটা এখনো পাইনি, যেমনটি চাই। কি যেন খুঁজি, থাকি। আজ সকালে কোন অলৌকিক ঘটনার সূত্রে যখন বিনা মূল্যব্যয়ে এই অমূল্য এক সময় আমার দরজার সামনে, যাকে খুঁজে চলেছি, তাকে পেয়ে গেলাম- আমি তাকে মিরাকেল বলবোনা?

কতখানি সময় চলে গেলো? পাঁচ মিনিট কিংবা পনেরো? হিসাব নেই। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কারো ফেলে দেয়া স্মৃতির বাহক মূর্তিটি হাতের তালুতে স্থান দিয়ে এতসব ভাবছিলাম। ওপরতলার দরজা খোলার শব্দে অকস্মাৎ ভাবনা ভাঙলো। চমকে উঠলাম। বেলা হচ্ছে, প্রতিবেশীদের কাজে যাবার সময়। দরজা বন্ধ করবো করবো,এমন সময় পায়ের আওয়াজ ওপর থেকে নিচতলায় ক্রমশ নেমে আসছে দেখে, মুহূর্তের সিদ্ধান্তে দু'হাত পিছে নিয়ে, গৌতম বুদ্ধ'র টেরাকোটা মূর্তিটিকে আমার পেছনে লুকিয়ে ফেললাম। ততক্ষনে পায়ের আওয়াজ আমার সামনে এসে থেমেছে। ওপরতলার ভদ্রমহিলা, সাথে ৯/১০ বছরের জমিলা, যাকে প্রতিদিনের ভাষায় 'কাজের লোক' বলা হয়। ভদ্রমহিলার বাড়ির 'কাজের লোক' ।

আমি হাসি। হালকা, মেপে মেপে। দরজা আটকাতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু মহিলা যে একদম আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আর আমার পেছনে দু'হাতের মুঠোয় লুকোনো গৌতম বুদ্ধ।

"দেখেছেন অবস্থা? আজকাল আর কাউকে বিশ্বাস করতে আছে।?" – রিনরিনে গলায় কেটে কেটে মহিলা আমায় বলে।
-"জ্বি?"
"আরে কাজের লোকদের। বিশ্বাস করা যায় বলেন?"
উত্তর নিষ্প্রয়োজন। তাই তাকিয়ে থাকি। আমার ধারণ উনি নিজেই বলবেন কিছু।
"দেখেছেন আপনি, দেখেছেন?"
-"কি? কাজের লোকদের অবস্থা?", একটু ব্যাঙ্গাত্মক হবার চেষ্টা করি।
"কি বলেন? আমার মূর্তি দেখেছেন?"
-"কি কি কিসের মূর্তি?"
"আর বলেন না আপনার ভাই গৌতম বুদ্ধের এক মূর্তি, আপনার ভাই আনলো নেপাল থেকে, সে ভীষণ দাম দিয়ে। খুঁজে পাচ্ছিনা "
-"ওহ ওহ ওহ .."
"এই বদমাশ মেয়ে, মুছতে যেয়ে কাল এক হাত ভেঙে ফেলেছে। তারপর লুকিয়ে আজ সকালে নাকি নিচে এখানে রেখে গেছে। কাল থেকে চুপ, এতো খুঁজি, স্বীকার যায়না। দিলাম এক কানমলা সকালে, তারপর বললো, এখানে ফেলে গেছে। কি এইখানেই রেখেছিস?"

বিব্রত, বিধ্স্ত জমিলা হাত দিয়ে দেখালো, আমার দরজার সামনে, ঠিক যেখান থেকে আমি তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছি।

আমার বুক ধুকপুক করছে। এক গ্যালন পানি খাওয়ার তৃষ্ণা হচ্ছে। শক্ত করে পেছনে হাতের মুঠোয় তাকে চেপে ধরি। ওহ, বাম হাতটি তবে ভাঙা, আমি যে হাতকে চাদরে জড়ানো ভেবে ভুল করেছিলাম। আমার তাঁর জন্য মায়া কেমন গুন্ গুন্ করে বহুগুণ বেড়ে গেলো। আহারে। কোনমতে মাথা নেড়ে বলি, – "দেখিনিতো কোনো মূর্তি, দেখিনি। " বুক ধুকপুক, কপালে ঘাম, কাঁপছি খানিকটা, যদি ধরা পরে যাই?

"সেই এ কি আর থাকে, হকার, ময়লাওয়ালা সকাল থেকে ভিড় করে। সব ছোটলোক চোর বদমাশের ভিড়।" জমিলার 'কত বছরের বেতন কাটলে এই ক্ষতিপূরণ সম্ভব' এ হিসাব করতে করতে মহিলা জমিলাসহ ওপরতলায় নিজ ঘরে ছোটে। বেচারা জমিলা।

মিথ্যা, চুরি এবং পাপ। তবুও, অসম্ভব, এমন অহংকারী, রূঢ় মানুষের হাতে আমি ওনাকে আর সপে দিচ্ছিনা। তাতে বড্ড আত্মপীড়া হবে। জমিলার কষ্টের ভার নিতে পারলামনা। কিন্তু এই ভীষণ অমূল্য শিল্পটি কে বাঁচানোর চেষ্টা করতেই পারি। তাই, এই নির্দোষ চুরি শ্রেয়। আত্মপীড়া হবে, তবে কম। পেছন থেকে হাতদুটোকে সামনে এনে, দরজা আটকে মনের সবটুকু দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। আহা। হাতটা ভেঙে গেছে। তাতেও হাসি ম্লান হয়নি এতটুকু।

প্রথমবার চুরির অপরাধবোধ ছাপিয়ে ও তাকে পাওয়ার আনন্দে মন কেমন হেসে হেসে ওঠে। বাঁচতে হবে, বাঁচাতেও। খুব যত্নে ভালোবাসায় লুকিয়ে রাখতে হবে তাঁকে। যাকে খুঁজছি, খুঁজে চলেছি, খুঁজে পাবার ঠিক আগে পর্যন্ত, শেষ পর্যন্ত। আমার দরজার সামনেই এসে স্থান নিলো সে। এ যদি মিরাকেল না হয়, তবে মিরাকেল আর কাকে বলে?