একুশ-একাত্তুর একইসূত্রে গাঁথা অজরগাথা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 20 Feb 2013, 12:38 PM
Updated : 20 Feb 2013, 12:38 PM

যে অন্যায় দমন নীতির কারণে একুশ এসেছিলো মায়ের ভাষা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে, একশো চুয়াল্লিশ ধারাকে অগ্রাহ্য করে, ঢাকার রাজপথ আমার ভায়ের রক্তধারায় ভেসেছিলো, দিনটি ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারী। তারই ধারাবাহিকতায় এ বঙ্গদেশে '৬৯-এর গণআন্দোলনের সংগ্রামী ইতিহাসের হাত ধরেই এসেছে একাত্তুরের মহান চেতনাময় মুক্তিযুদ্ধ। এ ইতিহাস, এই চেতনা চির অম্লান, চির অজর, একইসূত্রে বাঁধা বঙ্গদেশের অজরগাঁথা –

"আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি"

পারিনা বলেই একুশ মানে রক্তাক্ত বাংলা, বর্ণমালার ইতিহাস। আমরা যদ্দিন বাংলা বর্ণমালা লিখব / পড়ব / শিখব তদ্দিনই বাংলা ভাষার রক্তাক্ত ইতিহাস পড়বে মনে। শহীদ ভায়ের বুকের রক্তে পাওয়া বাংলা ভাষার জন্য যে বাঙালির মন আকুলি-বিকুলি করে না, সে ক্যামন বাঙালি সেই প্রশ্নটি ওঠে। তখন তেমন বাঙালিদের বর্জনের কথাও ওঠে। প্রকৃত বাঙালি নিশ্চয় শহীদের মর্যাদা রক্ষা করতে নিজের জীবনবাজি চেতনায় জাগ্রত হতে ভালোবাসে ও জেগে ওঠার জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়। সে নিশ্চয় বাংলা ভাষাভাষি সকল মানুষকে ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে ভালোবাসতে জানে। সে নিজে বিপন্ন হয়েও পড়শির বিপদে চুপ থাকে না। তাকে প্রাণিত করতে ভোলেনা। এই স্বভাবজাত চেতনাই আমরা দেখেছি একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে। বিপন্ন কোটি মানুষ তখন পড়শি দেশে আশ্রয় পেয়েছিলো। হিন্দু না মুসলিম না খ্রিস্টান না বৌদ্ধ তখন সেই প্রশ্নই মনে আসেনি। নিশ্চয় তারই নাম মানবধর্ম।

অথচ, তখনও এবঙ এখনও ধর্মের নাম সর্বস্ব কতিপয় নির্মম দল-উপদল ধর্মের নামে জিকির তুলে মানবধর্ম নির্দ্বিধায় পদদলিত শুধু না – সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে বিষিয়ে তুলতে সর্বদা ততপর। অর্থাৎ অপততপর। বাঙালি চেতনায় হামলা চালিয়ে অসাম্প্রদায়িক সামাজিক মানুষদের বিভ্রান্ত করার কাজই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য প্রবনতাই তাদের একাত্তুরে নিজের দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির পক্ষে কাজের উতসাহের আতিশয্যের অন্যতম কারণ হয়ে আজও পাকিপ্রেমী বানিয়ে রেখেছে। আজও তারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিরোধী কাজেই নিয়োজিত। তাদের কাছে মানুষ কোন ধর্মের সেটি সর্বাগ্রে গণ্য। অতঃপর মানুষটি ক্যামন বাঙালি তারও তথ্য ধর্মের অপরাজনৈতিক মানদন্ডের মাপকাঠিতে বিচার করে টার্গেট বানিয়ে তাদের তালিকায় ঝুলিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এবঙ ঝোপ বুঝেই কোপ মারতে দ্বিধা করেনা। তারা সঠিক শুদ্ধ বাংলা লিখতে-পড়তে না পারুক তাতে কি ! অন্তর্জালে তাদের গতিবিধির পরিধি সীমাহীন। ডিজিটালের অগ্রগতির সুযোগে তারা সর্বত্র জাল পেতেই আছে। সে জালে মাছ ধরার মতো বাংলাপ্রিয় বাঙালি চেতনাধারীদের ব্লগ লিংক খুঁজে তালিকা তৈরী করছে ! সামাজিক সাইটে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে ! লেখার অপরাধে ব্লগার রাজীবকে হত্যার পর শহীদ মৃত রাজীব-এর ধর্মীয় কুতসাগাথা রচনা করে ইন্টারনেটে প্রচার করছে ! মৃত মানুষ সকল ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বের মানুষ এই সহজ সত্য চেতনাবিরোধীরা সব কালেই অস্বীকার করেছে। করবেও। কারণ তারা ধর্মের অপরাজনীতিই করবে। অর্থাৎ অধর্মকারী দল তারাই।

আজ যখন সারা বাংলাদেশ আবারও একাত্তুরের চেতনায় জেগেছে তারা সেখানে নিষিদ্ধ শুধু না অবাঞ্ছিত। আমরা সন্তানতুল্য নতুন প্রজন্মের চেতনা জাগানিয়া সকল শপথের সঙ্গে একাত্ম সংহতি জানাচ্ছি অকুন্ঠ চিত্তেই। বহুদূর হতেই প্রবাসি বাঙালিরাও এবারের নতুন প্রজন্মের চেতনা জাগানিয়া সকল শপথের সঙ্গে একাত্ম সংহতি প্রকাশে দ্বিধাহীন। কেবল বিএনপি তাদের আঠারো জোটের জটাবদ্ধতার কারণে দূরে নিজদেশেই। এ যেন নিজদেশেই পরবাসি ! আহারে !

এবারের একুশ একাত্তুরের চেতনাজাগা গণজাগরণের কারণে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এবারের একুশ তাই অন্যবারের চেয়ে আরও অধিক চেতনা সমৃদ্ধ গণজোয়ারে উথাল জনসমুদ্র হবে সন্দেহ নেই। গভীর বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্যে ফুলেফুলে ভরবে স্মৃতির মিনার। যারা সেথায় ধর্মহীনতার অসার ধুয়ো তুলেই চিরকাল ধর্মের অপরাজনীতির কারণে দূরে ঠেলতে চেয়েছে চেতনা বাঙালির – তারাই আজ জনবিচ্ছিন্ন বক ধার্মিক-এর দঙ্গল – তারা দূরেই থাকুক – অতঃপর অধর্মের পাপেই নিমজ্জিত হউক। মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত ফুলপ্রিয় ছিলেন। তাঁর হাদিস অনুসারে কবির রচিত পঙক্তি –

"জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি / দুটি যদি জোটে তবে অর্ধেকে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী"

আমরা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে চাই – কেউ বা বেশি – কেউ বা কম – তাতে আমরা তত অপরাধীই নই নিশ্চয় যতটা কমবেশির জন্য ধর্মের নামে কুঠার / চাপাতি চালানো যায় নির্মম চোরাগোপ্তা হামলা করে ! কোনও ধর্ম কি অমানবিক এমন নির্দেশ দেয় ! দেয়নি। এমন কোনও ধর্ম জগতে নেই।

অধর্মকারীদের সৃষ্ট সকল দল / রাজনীতিকে বর্জনই হউক এবারের একুশ-এর শপথ এবঙ জাতীয় অর্জনের বাংলাদেশ। সবশেষে আমার সামান্য পঙক্তিমালা উতসর্গ করছি – মহান একুশ-একাত্তুরের চেতনার চিরজাগ্রত রক্তমাখা সোপানতলে –

শ্রদ্ধাঞ্জলি
——–
এখানে আমার ভায়ের রক্তের ধারা
এখানে আমার রক্তাক্ত বাংলা বর্ণমালা
এখানে আমার জাতীয় পরিচয়ের পালা
এখানে আমার অহংকারের অশ্রুধারা।।

শব্দহীন পদচিহ্ন জ্বেলে
শিকড়ে ডানার গন্ধ জ্বেলে
দুদন্ড দাঁড়াও গভীর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি দাও ঢেলে
স্মৃতির সোপান ভরে যাক অজস্র চেতনাফুলেফুলে।

২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৩