জগতের অমোঘ নিয়মেই বছর আসে বছর যায়। কালের গর্ভে আরও একটা বছর ভালোমন্দে চলেই গেলো। ১৪২০-এর যা কিছু জঞ্জাল, মিথ্যাচার আজিকে সেইসব – "বতসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক, যাক – এসো হে বৈশাখ এসো, এসো"-র সুরে ও বাণীতে এই প্রার্থনা । নববর্ষ ১৪২১ বয়ে আনুক আমাদের সকলের কাঙ্ক্ষিত যা কিছু মঙ্গলময় – সেই মঙ্গলালোকে বিরাজমান সত্য ও সুন্দরকে। আকাশ হতে আকাশে উড়ুক আমাদেরই অপার সম্ভাবনার বাসভূম – অামাদেরই প্রিয় বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের হৃদয় হতে ছড়িয়ে পড়ুক নবসূর্যোদয়ের আলোগন্ধ। অগ্নিস্নানেই শুচিশুদ্ধ হউক আজন্মের আকাশ, বাতাস, মেদিনীতল।
যারা হিংসা বিদ্বেষবিষে উন্মাদ – তারা নিপাত যাক। সত্য ও সুন্দরের প্রণোদনায় আগামীর শিশুরা বেড়ে উঠুক – অগ্রসরমানতার দুহাত ধরে – প্রাণের মহাসন্মিলনে। যেথায় বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য লালিত – লালনের, হাছন রাজার, রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দের শত গভীর আবাহনী জাগায় হৃদি অসুন্দরের বিরুদ্ধে জয়ের শক্তিমন্ত সুশান্ত গানের বাণী ও সুরে । অপশক্তির থাবা যেন বা গান শুনেই অকস্মাত পরাজিতের মতো পালায়। এই বাংলাদেশ তেমন ইতিহাসের বিজয় নিশান ওড়ানো জয়ী বাংলাদেশ। এই দেশের বাংলা মা, বাঙালি জাতি জগতে মাথা নত না করা জাতি। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধুর অবিসম্বাদিত নেতৃত্বে মৃত্যু পরোয়া না করে জয় ছিনিয়ে নেয়া বিজয়ী জাতি। মাতৃভাষার দাবী আদায়ে রক্ত দানের ইতিহাস রচনাকারী। এদেশের মানুষ জাতিগত ভাবেই বাংলাপ্রিয় বাঙালি বলে বিশ্বের কাছে প্রমাণ রেখেছে প্রাণের নবনব প্রণোদনার সৃজনী শক্তিতে। কবিতায়, গানে ও শিল্পের অভাবনীয় কালজয়ী সম্ভারে বঙ্গ দেশের কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী সেই কালিদাসের কাল হতেই হৃদয়হরণ সৃষ্টিজালে জড়িয়েছেন বিশ্বভরা প্রাণের ডাক। তাইতো "বারোমাস্যা তের পার্বন"-এর এদেশে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষেই যে কোনও পালা-পার্বনে ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে আনন্দ আবাহনে বাঙালি ঐতিহ্য ধারণ করে বাজায় প্রাণের সঙ্গীত –
"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে মোরে আরও আরও আরও দাও স্থান।"
এমন প্রার্থনা সঙ্গীতে কার না হৃদয় জাগে? জাগরণের এক অনন্য আনন্দযজ্ঞ রূপেই আসে নতুন বর্ষ। মেলার গন্ধে বাতাসভর্তি রঙিন বাজনা বাজে। সর্বস্তরের মানুষ মেলার মহাসন্মিলনপানে সপরিবার লাল-সাদা পোষাক পরে বাঁশের বাঁশি, মাটির সরা, শোলার টুপি, ডুগডুগি, মুড়িমুড়কি, খই, চিড়ার মোয়া, মন্ডামিঠাই, পিঠেপুলি, শীতল পাটি, খাঁচার পাখি, বাঁদর নাচ, বয়াতীদের গানে বৈশাখ বরণ করতে উতসাহের জোয়ারে ভাসে। চারপাশের নিত্যকার হাজারতর অসামঞ্জস্যতার পাঁচালি এইদিন উধাও যেন। ব্যাবসায়ীরা আজ যতই আধুনিক ধারায় ধাবিত হোন না কেন, আজও কিন্তু হালখাতার নতুন হিসেব খুলবার রেওয়াজটা চালু রয়েছে। বিশেষতঃ সোনার দোকানীরা এবঙ বই প্রকাশনার প্রতিষ্ঠানে আজও বাংলা নববর্ষের আয়োজনে মুখর হয় মিষ্টিমুখের সঙ্গে নতুন লেনাদেনার হিসেব খুলে।
রাজধানীর খাবার রেঁস্তোরাগুলো, ছোটবড় মার্কেটগুলো নজরকাড়া আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয় বৈশাখী পান্তা-ইলিশের মহোতসবে। কোনও কোনও মার্কেট চত্বরে বৈশাখী মেলাও সাড়ম্বরে সজ্জিত হরেক দেশীয় অায়োজনে। বৈশাখী সাজে শহর মুখরিত রঙিন ব্যানারে অালোকসজ্জার বাহারে। আমাদের বাড়ির কাছে ইউনিমার্টে তিন দিনের বৈশাখী মেলার বিজ্ঞাপণে আকৃষ্ট হয়ে আমিও গেছি নাতিনাতনী, কাজের মেয়েকে নিয়ে। আগের মতো ছুটতে পারিনা রমনা মাঠে। দুপায়ে জোর স্তিমিত। তাই বাড়ির ধারেকাছে একটু নিরাপদে হাঁটার মতো কোথাও মেলা অথবা কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজনে যাবার চেষ্টা চালাই। তেমন ইচ্ছের জোরে ইউনিমার্ট এর মেলায় উপভোগ করেছি গানবাদ্য, খাবার – নাতিনাতনী – কাজের মেয়েসুদ্ধো। দেখেছি মেলার বাঁদর নাচ, খাঁচার পাখি, বয়াতীদের গান। খেয়েছি ফুচকা, অাইসক্রিম। ইচ্ছে জোয়ারে ভেসে নিষিদ্ধ কোল্ডড্রিংকস করেছি পান। ওদের কিনে দিয়েছি বাঁশের বাঁশি ও চুড়ি, ছড়াছবির বই, খাতা-পেন্সিল। খই, চিড়ার মোয়া, মিঠাইভর্তি ডালা কিনেছি বাড়ির সবার জন্য। এইতো একটুকরো আনন্দ। এ আনন্দ অমূল্য। শুভ হউক ১৪২১ বঙ্গাব্দ।
শুভ নববর্ষ।।
পহেলা বৈশাখ ১৪২১ বঙ্গাব্দ।।