আমার চিলতে জানলাতল

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 19 June 2014, 09:14 PM
Updated : 19 June 2014, 09:14 PM

অকাজে ভেসে যাওয়া কিছু প্রহর আসে যখন জগতবাড়ির কিছুতেই লাগেনা মন। কেবল একা বিজন বেলা আগলে প্রায় ভেসে যাওয়া কিছু একান্ত অনুভব আদিম প্রাকৃতিক। যদিও নাগরিক যন্ত্রনির্ভর যাপিত জীবনে প্রাকৃতিক সবুজ শ্যামলিমা আগের মতোন সতেজ নেই কোথাও। চারপাশের বর্জ্যে, জঞ্জালে, যন্ত্রের দাপটে ম্লান শুধু না, প্রকৃতির সমগ্র ভারসাম্য বিপর্যয়ের মুখে। তবুও বৃত্তবন্দী চিলতে  ব্যালকনি অথবা জানলায় আজও কিছু দারুণ রৌদ্রমেঘচ্ছায়াঘন সঘন বাদল দিনও আসে। তখন মন উদাস হয়। উতলা হয়। জানলাতল ভেসে যাওয়া আলোমেঘের ভেলায় চড়ে হৃদয়ে বাজে কবিগুরুর গান –

"পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে

পাগল আমার মন জেগে ওঠে …"

তখন ধূলিধূসর গাছের পাতা মুহূর্তে ভিজে ধুইয়ে দেয়া রূপালি জলকণাগুলি দুহাত বাড়িয়ে ধরতে চাওয়া – এই অনুভব কি লেখা সম্ভব ?  সম্ভব না। কেবল কিছু পঙক্তিঘোর মন জাগিয়ে হৃদয় ভাসিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয়। তারেই হয়তো কবিতা বলে। হয়তো নয়। আবার কেউকেউ তারই ছবি ক্যামেরাবন্দী করে। ছবির শিল্পী তাদেরকেই বলি আমরা। অন্যদিকে যে শিল্পী, সে আঁকে তারে আপন মনের মাধুরী মেশা তুলির রঙের খেলায় মেতে। গায়ক গায় এমন দিনেই আপন মনে। গাইতে পারেনা এমন মানুষও গুনগুনিয়ে ওঠে এমন দিনে  –

"এমন দিনে তারে বলা যায় / এমন ঘনঘোর বরিষায় …"।

তবুও যেন কিছুই মনের মতোন নয়। যেমন করে সে আসে জানলাতলে – তেমন করে তারে কি কেউ লিখতে পারে ? আঁকতে পারে? ছবিটা হবহু তারই রূপ প্রকাশ করে? গান কি তার ভিতরকার সুর-তাল-লয়-বাণী তেমন করেই বাজায় সে যেমন বাজায় মন ? অমন  প্রাকৃতিক ঝর্ঝর-মর্মর প্রহরগুলি এক একটা ঋতুতে একেক রকমের আশ্চর্য অধরার ভাষায় কি বলে / বলতে চায় মানুষ বোঝে সম্পূর্ণ তারে? তার কি ব্যাথা কি কথা কি সুখ সেইসব কতটুকুই আর কবিতা-গানে-ছবির ভাষায় আসে অমল ঝর্ণা যেমন বহে তেমন করে? তেমন করে বুঝি কি তারে? মানুষ আদতেই বোঝেনা তারে।

বুঝতো যদি তবেতো আজ প্রকৃতি ভারসাম্যহীন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হতোনা এমন করে। জগত আজ মানব সৃষ্ট আবর্জনায় অপরূপ  সৃষ্টির যত ক্ষতিসাধন করেছে / করছে, তবু সর্বংসহ প্রকৃতি নির্দয় মানবের উপর প্রতিশোধ নেয়না তত। উন্মত্ত সে হয় তখন, যখন সমুদ্রতল ফুঁসে উত্তপ্ত হয়। বঙ্গোপসাগর ঘেরা বদ্বীপ এই বঙ্গদেশ আজও – "সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা" বলে পৃথিবীলোকে পরিচিত,  সুখ্যাত বেশ , অথচ আমরা তারও ষড়শ্বৈর্যময় ঐশ্বর্যে নির্বিচারে কুঠার চালাতে লজ্জিত নই। লজ্জিত নই বনবনানী উজাড় করতে। নদীময় বাংলাদেশের নদীর পারগুলি দখলদারদের আধিপত্য বিস্তারে মত্ত। নদী যে শুকিয়ে মরাহাজায় পরিণত – তা যেন দেখেও দেখার নয়। হ্যাঁ,  এমনই – "চোখ থাকিতে অন্ধ" দশার খপ্পরে আমরা অন্ধতাকে মেনেই নিচ্ছি ক্যামন গড্ডল নিয়মে। তারপরেও জানিনা কি এক তাড়নায়  কেবল আষাঢ়স্য বরষাবিধুর বেলায় এই একটুখানি কাঁদুনি গাওয়া আমাদের। অকাজে বসে থাকার দিনে খানিক কাব্যিক ভাবের বশে নাগরিকের ভাবনা / দায়দায়িত্ব নিয়ে কিঞ্চিত লিখে দায়ভারটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা। কি বলি নিজের এমন ভাবসাব বিষয়ে !

তবু বুঝি বা প্রায় ভুলতে বসা অমল আমার সবুজ বেলা – ছেলেবেলার মনোহরপুর স্মৃতির হাজার মাইল হতে হঠাত ভেসে আসা ধনের মতোন আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে জানলাতলে ছলছল কাঁদিয়ে ছাড়ে আমায়। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমার ঢাকাবাসি জীবনে বর্তমান বাড়ির পেছনের পড়শিদের ছাতখানা বড়োই মনোহর। সে ছাত যদি না যখন-তখন দেখতে পেতাম দমবদ্ধ হয়েই মারা পড়ার দশা হতো যে – তাতে সন্দেহ নেই। আমার এই লেখায় অই ছাতের ছবি অর্থাৎ আমার জানলাদৃশ্য দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কি অার হবে এখানে ছবিটি ঝুলিয়ে ! তার চাইতে পাঠকের মনের চোখ পড়ুক লেখার ভিতর ছবির ভাষাও। পাঠকরা ভাবুক যারা, মনের চোখে লেখার ভিতর ছবির ভাষা পড়তে পারা – ভাবতে গিয়ে অামার ভালোগায় হৃদয় ভরে উঠছে। অামি যে দেখছি এই মুহূর্তে সেই দারুণ মুহূর্তকে – পাঠক পড়ছে বলেই এই লেখার অলিখিত ভাবও ছবিময় ! জানলাদৃশ্য সে অার ছবিতে কতটুকু ধারণ করা সম্ভব ক্যামেরায়! মনের চোখে দেখার মূল্য অমূল্য। অামি তারেই বলি – চোখল নমস্য পাঠক।

১৪২১ বঙ্গাব্দ।।