বিজয় মাসে আমার দেখা নমস্য নারী মাহেলা বানু

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 29 Dec 2014, 07:48 PM
Updated : 29 Dec 2014, 07:48 PM

আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা মাহেলা বানু নামের 'একজন ফুলবিক্রেতা বয়েসী নারীর। একহারা শ্যামলা রঙ, মায়ের মতোন মায়াবী মুখ। তাঁকে দেখেই কেন জানিনা ভালো লাগলো খুব। নিজেই সালাম দিয়ে অালাপ করলাম। হাসিমুখেই জানালেন আমায় তাঁর অপরিসীম জীবনযুদ্ধের কথা। আমরা যারা শহুরে নাগরিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত – একাত্তুর দেখেছি বটে, অনেক নির্যাতনের কথাও জানি পাকিজান্তার, রাজাকারের আমাদেরই মা-বোনের উপর – সেই সময় অনেক শঙ্কিত দিনরাত্রিগুলি করেছি পার – নয়টি মাস – তবুও মাহেলা বানুর মতোন অমন প্রত্যক্ষভাবে জীবনের ভোগান্তি সওয়া নমস্য নারী আমরা নই।

অবাঙ আমি মাহেলা বানুর সংগ্রামের জীবন কাহিনী শুনে। সবার সঙ্গে শেয়ার করার জন্যই আজ লিখতে বসেছি উনার কথা। নইলে আজ বিজয় মাসে মাহেলা বানুর কাছেই অপরাধী আমার মন বিবেকহীন হিসেবে চিহ্নিত হবে জীবনভর। মন বলছে – আত্মসন্মান বাঁচিয়ে চলা মাহেলা বানু হয়তো আর আমার কাছে কোনওদিন বলবেন না মনের কথা, হয়তো তাঁকে আমার আর কোনওদিন দেখাও হবে না, কেবল এই লেখার মাঝে নমস্য একজন মাহেলা বানুর জীবনগাথা পড়ে অনেকে অশ্রুসজল হবেন – তাঁকে সালাম জানাবেন অদেখা এক সংগ্রামীর প্রতীকী নারীর নাম হিসেবে – এই ভেবেই তাঁর আমাকে বলা জীবন সংগ্রামের কাহিনী লিখে শেয়ার করতে চাইছি – যাতে মাহেলা বানু নামের নমস্য নারীর প্রতি আমরা সন্মান জানাতে কার্পণ্য না করি।

এই মাহেলা বানু উত্তরবঙ্গের রংপুরের কন্যা ছিলেন। মাত্র পনের বছর বয়সে বাবা বিবাহ দেন কন্যার রংপুরের তরুণ রাজমিস্ত্রী মন্তাজ আলী মিস্ত্রীর সঙ্গে। মন্তাজ আলীর পরিবারের তেমন মুরুব্বী কেউ ছিলোনা বেঁচে। তবুও মানুষটা ভালোই ছিলো – শহরে কাজ ভালোই পেতো – শহর ছাড়িয়ে আরও দূরে কাজের জন্য ছুটতে হতো। অভাব ছিলোনা মাহেলা বানুর নতুন সংসারে। দুই বতসরের মাথায় বড়পুত্র মোহন আর পরের বছর আরও এক পুত্রের জন্ম – মিসির এর। তখন মন্তাজ আলীকে বেশি রোজগারের জন্য প্রায়ই শহরের বাইরে কাজ নেওয়া শুরু। তখন একাত্তুর আসলো। মাহেলা ও দুইপুত্রকে রেখে হঠাত একদিন মন্তাজ আলী হারিয়ে গেলো। যাবার আগে জমানো সঞ্চয়ের পাঁচহাজার টাকা মাহেলা বানুকে ধরিয়ে বলেছিলো – দেখিস ছেলেদের – আমার যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই – বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হইসে – এখন ঘরে বইসা থাকলেও মরণ – ভাবিসনা – আমরা যুদ্ধে জিতবো ইনশাহ আল্লাহ। সেই যে মন্তাজ ঘর ছাড়লো আর ফিরেনি আজতক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হইলো – সবাই ঘরে ফিরলো – কারও-কারও যুদ্ধে শহীদ হবার খবর পাওয়া গেলেও – মন্তাজের কোনও খবর কেউ পায়নি এই এতটা কাল। একাত্তুরের সেই অত্যাচারের দিনে দূরের এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলো মাহেলা। সেই আত্মীয় নয়মাসে জমানো টাকার পুরোটা ধার নিয়েছে। আর ফেরত দেয়নি। কি আর করে মাহেলা? মন্তাজের অপেক্ষায় থাকতে-থাকতে একসময় বাধ্য হয়েই দুই পুত্রকে নিয়ে সামান্য টিনের ঘরটা বিক্রি করেই মাহেলা ঢাকায় আসে স্বাধীনতার পরের বছর। সেই থেকেই ঢাকার কমলাপুর বস্তিবাসি মাহেলা। এনজিও-র ইস্কুলে দুই পুত্রকে পড়তে দিয়েছে। নিজে নেমেছে কাজে – প্রথমে ঘর বিক্রির টাকায় বস্তির মুদি দোকানদার এর পাশেই একখানা টঙদোকান ঘর নিয়েছে। পিঠা বানিয়ে – চা-ঝালমুড়ি বানিয়ে আয় নেহাত মন্দ হোতনা। বহু লোকের কু-প্রস্তাব / কু-নজরকে পাত্তা না দিয়ে মাহেলা বানুর পথ চলার সংগ্রাম চলছে আজ বয়স পঁয়ষট্টির পরেও। দুই পুত্রই বিয়ে করেছে পছন্দের পাত্রীকে। ওরা আলাদা থাকে। মায়ের জায়গা হয়না দুই পুত্রের কারও ঘরেই। তাতে কোনও আফসোস হয় না মাহেলা বানুর। ওরা বউ-বাচ্চাকে নিয়া সুখেই আছে। ওদের সুখ দেখেই মাহেলা বানুর সুখ। এইতো সেই আপত্য স্নেহময়ী মাতৃত্ব – মায়ের মতোন কেউ জগতে নাই। হয় না। মাহেলা বানুর আত্মত্যাগ কেবল একজন মায়ের পক্ষেই সম্ভব। এ যেন সর্বংসহ ধরিত্রী মাতা – শিকড়তলে পরম স্নেহের আঁচল বিছিয়ে আগলে রাখা জগত মাতার মতোন – আমাদের গর্ভধারিনী মমতাময়ী মা।

এই মা মাহেলা বানু এখন আর আগের মতোন খাটুনি পারেন না বলেই পিঠা বানানো ছেড়েছেন। এখন ফুল কিনেন যেখানে সস্তায় মেলে। বিজয় মাস / বৈশাখ / বিভিন্ন উতসবে বস্তির ইস্কুলে ভালোই ফুল বেচেন। গুলশান এলাকা আসেন সস্তায় ফুল পাওয়া যায় ফুলের বড়বড় আড়ত হতে বাসি-ফুলের দাম অনেক কম বলেই। থেমে-থেমে মাহেলা বলেন নিজের এই জীবন ধারার বেদনাগাথা। আমি অবাঙ হয়ে শুনেছি। অনেকক্ষণ আমার মুখে কোনও কথা আসেনি। মাহেলা বানুর জন্য কোনও সান্ত্বনা বাক্যই দরকার পড়েনা। দরকার মাহেলা বানুর মর্যাদা দেয়া। আমার অনুরোধ সত্তেও মাহেলা বানুর ঠিকানাটি জানালেন না তিনি। আমার মোবাইল নম্বর দিলাম উনাকে এক টুকরো কাগজে লিখে ও আমার বাসার ঠিকানাও দিলাম। মাহেলা বানুর মোবাইল নেই – বস্তির কারও নম্বর থেকে আমাকে যেন উনার খবর জানান – গুলশানে এলেই যেন আমার বাড়ি আসেন – অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নিলাম। উনার মুখটি অবিকল মায়ের মতোন লাগলো। বুক চিরেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এমন কত মাহেলা বানুর জীবন আমাদের চারপাশেই হয়তো রয়েছে ভাসমান – আমরা তাদের খবর পর্যন্ত পাইনা। আমাদের তেমন অবকাশ কোথায় ছুটন্ত জীবনে – মাহেলা বানুর মতোন আরও অনেক মাহেলার খোঁজখবর করবার? অথচ আমাদেরও রয়েছে দায়ভার – সত্যটা অত্যন্ত কঠিন জ্বলন্ত বাস্তব – তবু বিকারহীন আমাদের জীবন বড়োই কর্মমূখর – এই মাহেলা বানুরা কত না সংগ্রাম করেই বেঁচে আছেন সন্তানের সুখেই সুখী – একটা দীর্ঘশ্বাস না ফেলে ! জগতে মা মানে এমনই সর্বংসহ নারী – সর্বংসহ ধরিত্রীমাতা যেমন – তেমনই মায়ের মন – সন্তান / প্রিয়জন / পরিবারের সবার মঙ্গল চেয়ে নিজের সুখ / সুবিধা বিসর্জন দেয়া মা – তিনি জননী বসুন্ধরার সঙ্গেই তুল্য। তেমন মায়েদের নমস্য বল্লেও কম-ই বলা।

মাহেলা বানু আমার দেখা নমস্য নারী। উনাকে বিজয় মাসে সালাম – হাজার সালাম।

*সেদিন আমার লেনোভো মোবাইল নিইনি সঙ্গে, পুরনো নকিয়া মোবাইলের ছবি ক্যামন ঝাপ্সা মতোন আসে, অগত্যা অই নকিয়াতেই তুলেছি উনার ছবি, এবঙ আজ সেটিই কপি করেছি বলে ছবিটা তত স্পষ্ট না, উনি দেখতে আরও অনেক মায়াবতী।*

ডিসেম্বর। ২০১৪ ইং