আজকের বাংলাদেশ নৈরাজ্যের বাংলাদেশ নয় অাদতে

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 18 Feb 2015, 07:14 PM
Updated : 18 Feb 2015, 07:14 PM

অনেকদিন আমার হাঁটতে যাওয়া হয়নি। আজ অনেকদিন পরে হাঁটতে গিয়ে একটু ধীরে চলতে-চলতে একজনের কথা শুনেতো আমি অবাক ! তিনি বলছিলেন –
"ভাই, রাজশাহীতে, যশোরে বিশাল মিছিল বিএনপির – বুঝছেন – সরকারের পেটোয়া বাহিনী মিছিলে পাখির মতো মারছে গুলি কইরা – বুঝছেন? এভাবে ক্ষমতা থাকবে নাকি?"
সাথের অন্যরা অবাক কি না জানিনা, কারণ আমার চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে চলা ওদের কথা আমার পাশ কাটিয়ে বহুদূর। যাহোক, অই লোকের কথাগুলি আমাকে মনে পড়িয়ে দিলো – ২০১৪ সালের বিএনপি নেত্রীর সেই বয়ান –
"পুলিশ পাখির মতো করছে গুলি – পুলিশ হত্যা করছে মানুষদেরকে।"
কি আশ্চর্য মিল নেত্রীর সঙ্গে ২০১৫ তেও বিএনপির সমর্থকদের। ভাবি যে – তাহলে বিএনপির অবরোধ আর হরতালের বিশাল মিছিল মিডিয়া দেখে না কেন? এবঙ পুলিশের পাখির মতো মিছিলে গুলি করার দৃশ্য মিডিয়া ধারণ করে না কেন?
আসলে যা ঘটেনি তা কি মুখের কথায় ঘটানো যায়? বিএনপির সমর্থকদের আসলে মাথা পুরাই গেছে। যাবে না কেন? কোথাও সাধারণের সাড়া না পেয়ে মাথা খারাপ হবার কথাই। তাই এমন মনগড়া মূর্খের মতো কাহিনী বলে নিজেদেরকে নিজেরাই বাহবা দেয়া আর কি !

এবার আজকের বাংলাদেশ এত বোমাবাজির পরেও ক্যামন চলমান – তারই চিত্রটা একটু দেখি। দেখার কথাটা এই যে – আজ আমার হাঁটার চেয়ে দেখা ও ছবি সমেত কিছু কথার চিত্রটা চাইছি লিখতে – প্রথমে পার্কের নিরাপত্তা প্রহরীদের কথা লিখতে চাই – হাঁটতে গিয়ে অনেকবার ভেবেছি প্রহরীদের সঙ্গে বলবো কথা – বলিনি। আজ প্রহরীদের তিনজনকে পেলাম একসঙ্গে। পেয়েই – শুধোলাম – "আমি কি আপনাদের একটা ছবি তুলতে পারি? অনেকদিন ধরেই ভেবেছি ছবি তুলবো, কথা বলবো, আপনারা জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে – তাই আপনাদের কথা লিখতে চাই।"
তিনজনেই খুশিমনে আমাকে ছবি তোলার অনুমতি দিলেন।

অতঃপর আমার প্রশ্ন – "আপনারা কি পার্কের কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত নাকি সরকারের?"
উনাদের জবাব – "আমরা সরকারের নিয়োজিত। চাকরী সরকারী।"
পরের প্রশ্ন – "ডিউটি শুধু দিনের?"
উনাদের জবাব – "আমাদের ডিউটি চব্বিশ ঘন্টার।"
বলি – "শিফট কতক্ষণ?"
জবাবে প্রহরীরা জানান – "ভোর ছয়টা হতে সন্ধ্যা ছয়টা – এক শিফট। দ্বিতীয় শিফট – সন্ধ্যা ছয়টা হতে ভোর ছয়টা।"
আমি জানতে চাইলাম – "বেতন পান ক্যামন?"
জানালেন – "তেমন উচ্চ বেতন না হলেও আগের চেয়ে অনেক ভালো বেতন পাচ্ছি – এইটা আমাদের অনেক দিনের দাবীদাওয়ার ফলেই বর্তমান সরকারের আমলে বাড়ানো হলো। এতেই খুশি আমরা।"
আমি তখন বলি – "অনেক ভালো লাগলো জেনে। এবার বলুন – আজকের অবরোধ ও হরতালের ক্ষেত্রে আপনারা কি করছেন?"
জবাবে তিনজন একই সুরে বলেন –
"এই এরিয়া হাই কমিশনের এরিয়া। অধিকাংশ হাই কমিশনই এলাকার চারপাশকে ঘিরে। বিএনপির অফিস এখানে। বড় মাপের পার্ক এখানে। তাই অবরোধ ও হরতালের সময় বলে অধিক সতর্ক আমরা। এ পর্যন্ত এখানে কোনওরকম বোমাবাজদের হামলা, হানাহানি হয়নি। কুটনৈতিক পাড়ার সর্বোচ্চ ডিউটি দিচ্ছি আমরা নিরাপত্তার কারণে।"
উনাদের কথায় নজরে পড়ে তিনজনের আর্মসগুলি – সদাসতর্ক বটে। আমার অনেক ভালো লাগলো। আমি জীবনে এই প্রথম এভাবে পুলিশ প্রহরীদের ছবি তুলেছি। কথা বলেছি। উনাদের তিনজনকে সালাম, ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

এরপর আমার সঙ্গে কথোপকথন গেইটে বসে চা বিক্রেতা নারীর সঙ্গে। উনার নাম নাজমা। ভোর ছয়টাতেই গেইটে বসেন চা বিক্রির গাড়িটি নিয়ে। থাকেন কালাচাঁদপুর বস্তিতে। ফজরের সময় উঠে চুলায় চা চাপান। স্বামী ও ছোট ছেলের জন্য রাঁধেন ভাত-তরকারী। নিজেও খেয়ে বয়ামভর্তি মুড়ি, বিস্কুট, পান, ফ্লাস্কে চা নিয়ে ভ্যানগাড়িটা চালিয়ে আসেন। বড় ছেলেটা বিয়ে করেছে বলে আলাদা থাকে। কালাচঁদপুরের বস্তির ইস্কুলে এইটে উঠেছে ছোটছেলে। নাজমা দুই বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করেই চলছেন – ভালোই আয় এখন তার। যখন বড়ছেলে আলাদা হলো তখন ভয় পেয়েছিলেন সংসার কিভাবে চালাবেন ভাবতে গিয়ে। স্বামীর সহযোগীতায় দুজনে দুইপথে আয়ের ফলে ভালোই আছেন এখন তারা। জানতে চাইলাম – "এই যে অবরোধ, হরতালের মধ্যে আসেন – অসুবিধা হয় না? ভয় পান না? পেট্রলবোমারে?" হেসে বলেন নাজমা – "না, ভয় পাইলেতো জীবন চলবোনা বইন। ভয় পাই না। এইখানে কোনও ভয় নাইতো। পুলিশ পাহারা আছে সবসময়। রাইতে বাড়িতে যাই। আমরা অবরোধ, হরতালের ভয় পাই না।"
নাজমা নামের একজন সাহসী নারী চাঅলা আমাকে হতবাক করলো খুব। সালাম জানালাম। এবঙ মোবাইলে ছবিও উঠালাম।

আমার আজকের কথাটি শুধু এই যে – কে বলে বাংলাদেশ নৈরাজ্যের? বাংলাদেশ নৈরাজ্যের নয় আদতে। যারা বানাতে চায় বাংলাদেশকে একটা নৈরাজ্যের বাংলাদেশ – তারা কোনওদিন সফল হবে না। আজকের বাংলাদেশে খেটে খাওয়া একজন পুলিশ, খেটে খাওয়া একজন নারীও অনেক সাহসী। নমস্য মানুষ। এই সাহসী মানুষগুলিই আজকের মানুষ। আগামীর মানুষ। ওদের দেখেই আমিও আজ প্রাণিত। তাই আমার মতান লিখিয়ে মানুষও সাহসে উঠে দাঁড়াই। অসুখ নিয়েও সাহসে হাঁটতে যাই – অবরোধ ও হরতালের বোমাবাজির ভয় হটিয়ে উঠে দাঁড়াই। এইসব জীবনেরই আশাবাদী জীবনী, আশাময় আগামী, পজিটিভ তারুণ্যময় বাংলাদেশের কথা লিখতে চাই। কোনও হতাশার রাজনীতির বিকারগ্রস্ততার শিকার হওয়া বাংলাদেশ দেখতে চাই না। নেগেটিভ বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণায় মত্তদের কোনও হাইলাইট চাই না। অগ্রসরমান বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে গর্বিত উপস্থাপনা দেখতে চাই।

ফাল্গুন। ১৪২১ বঙ্গাব্দ।
ফেব্রুয়ারি। ২০১৫ সাল।