শুক্রবারের সাধারণ বাঙালি রান্না কথন …

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 22 May 2015, 06:26 PM
Updated : 22 May 2015, 06:26 PM

আমাদের মা মাঝেমাঝে একদমই সাধারণ গরম ভাতে আলুভর্তা, সরিষাভর্তা, রসুন-মরিচভর্তা, ডাল ও শাক, মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পরিবেশন করতেন। খুবই সাধারণ বাঙালি খাবারের অসাধারণ স্বাদ। আমিও আমার ছেলেমেয়েকে শিশু বয়সে অভ্যস্ত করেছি এসব খাবার পাতে দিয়েই। আজকাল মায়েরা গলদঘর্ম একটা মাত্র শিশুকে ভাত খাওয়াতে । এখনকার আদুরে শিশুরা ভাত-ডাল-শাক-সবজি খায়না একদম। তাইতো মুরগী, মাটন, বিরিয়ানী, চিপস-বর্গারে মুটিয়ে যাওয়া শিশুদের কত না সমস্যায় ভুগতে হয় এখনকার বহু শিশুকে। অথবা, সুষম খাবার না খাওয়া জনিত কারণে আন্ডার-ওয়েট সমস্যায় কাতর হয়ে সেসব শিশুর মা-ববা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। শিশুকালে শিশুকে অভ্যাস করাতে না পারার কারণে বড় হয়েও একালের ছেলমেয়েরা সুষম খাবার নয়, বাইরে ফুডকোর্টে জাংকফুড খাওয়া ভালোবাসে।

যাহোক। ছুটির শুক্রবারে প্রয়াত মায়ের মতোন রাঁধতে চেয়েছি সাধারণ কয়েক পদ। টেবিলে গরম ভাতের সনে দিলাম শাক, সরিষা-ভর্তা, আলুভর্তা, রসুন-মরিচভর্তা, ছোটমাছের ঝাল, এবঙ ডাল। জগতে মায়ের হাতের তুল্য কি হয় কেউ? হয় না। আমিও না। যদিও ছেলেমেয়ে-জামাতা-পুত্রবধূ-নাতি-নাতনী, স্বামী – সবাই চেটেপুটে সাবাড় করেছে পাতের ভাত !

ওদের খাওয়াতে এবঙ নিজেও খাবার মুখে নিতেই মা কে স্মরণে পড়া … চাকুরীজীবী বাবার আয়ের স্বল্প টাকায় কি স্বল্পেই না সবার পাতে দিতেন অসাধারণ শাকান্ন ! খুবই সহজ রান্না। অথচ, পুষ্টিমান অনেকগুণ বেশি মুরগী-মাটনের চাইতে। ভাত যখন হাঁড়িতে টগবগিয়ে ফুটতো – আলু খোসাসুদ্ধো দুইটুকরো করে ধুয়ে দিতেন ভাতে। ভাতের মাড় ফেলার পরে হাতায় করে সেদ্ধ আলুগুলো গরম তুলে বাটিতে খোসা ছাড়িয়ে ভাতের চামচের উল্টোপিঠ দিয়েই মসৃন ভর্তা বানিয়ে সরিষার তেল ও পিঁয়াজকুচি, কাঁচামরিচকুচি, ধনেপাতাকুচি, বিটলবন, অল্প গোলমরিচগুঁড়ো মাখিয়ে নিতেন। সরিষার ভর্তা করতে সাদা সরিষা ৩-৪ চামচ, রসুন ৩-৪ টা, কাঁচামরিচ ৩-৪টা, ধনেপাতা ২আঁটি ধুয়ে ৩-৪ চামচ সরিসার তেলে টেলে পাটায় পিষে লবন সহযোগে ভর্তা বানাতেন। শাকও খুব সহজ রান্না। পাতা ও ডাঁটা আলাদা ধুয়ে-কেটে গরম তেলে রসুন-শুকনোমরিচ ভেজে বাদামী হলে প্রথমে ডাঁটা একটু সিদ্ধ হলেই শাক দিতেন অল্প হলুদগুঁড়ো, মরিচগুঁড়ো, পিঁয়াজ, লবন দিয়ে সবুজ থাকতেই কয়েককানা কাঁচামরিচ দিয়ে মিনিট কয়েক ঢাকনা দিয়ে চুলায় রাখতেন। রসুন-মরিচের ভর্তায় ৭-৮ টা রসুন, লাল শুকনো মরিচ ৭-৮ টা ধুয়েই আধঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পাটায় পিষে লবন মেখে গরম দুই চামচ সরিষার তেলে ২ টা পিঁয়াজকুচি বাদামী হলে কয়েক মিনিট ভেজে নামাতেন। ছোট মাছের চচ্চড়ি করতে মাছ অনেকবার ধুয়ে হলুদ, লবন একটুকরো লেবু মাখিয়ে রাখতেন ৭-৮ মিনিট। আবার ধুয়ে একচামচ হলুদগুঁড়ো, একচামচ মরিচগুঁড়ো, একটা টমেটুকুচি, একটা আলুকুচি , ৩-৪ টা পিঁয়াজকুচি, ৩-৪ চামচ সরিষার তেল মাখিয়ে কড়াইতে চুলায় চাপাতেন। ঢাকনা দিয়ে মিনিট দশেক পরেই ধনেপাতাকুচি ছড়িয়ে লবণ দিতেন। দুই মিনিট পর নামিয়ে পাতে দিতেন সবাইকে একচামচ করে দারুণ স্বাদের ছোটমাছের চচ্চড়ি। মায়ের ডালও খুব সহজ রান্না। ধুয়েই ডাল হাঁড়িতে পানি, লবন, আধচামচ হলুদগুঁড়ো, দুই চামচ আদাবাটা দিয়ে সিদ্ধ হলে আরেকখানা কড়াইতে দুইচামচ ঘিয়ে ৩-৪টা পিঁয়াজকুচি, দুইটা শুকনোমরিচ ভেজে বাদামী করে বাগার দিয়ে ধনেপাতা-কাঁচামরিচ সমেত বাটিতে ঢালতেন।

আমিও আজ তেমন করে পরিবেশন করতে চেয়েছি – মা যেমন আমাদেরকে পাতে দিতেন। তবুও আমি তো আর আমার মায়ের মতোন স্বল্পে অসাধারণ করে এসব সাধারণ রেসিপি রাঁধি তেমন স্নেহমাখা হাতের মৃদুমুখ রাঁধুনী নই। তবুও আজ দুপুরে আমি যেমন রেঁধেছি তা-ই খেয়েছে পরিবারের সবাই মহানন্দে। তাতেই মহাসুখী আমিও।

একই সঙ্গে এওতো উল্লেখ্য যে – এইদেশে কখন আসে ছুটির দিন কখন ভালোমন্দ দুমুঠো জোটে কপালে নিরন্ন হাভাতে মানুষের সেসব বড়ো বেদনাময় বাস্তব জীবন। আমরা হয়তো মাঝেমাঝে খুবই হাতেগোণা কাঙাল পাতে দুমুঠো অন্ন-ব্যাঞ্জনের যেগান দিই। ওদের শুক্রবার কোনওদিন আসেনা তেমন করে। লিখতে বসে অথবা খেতে বসেও অনেক সময় ভেবে মনটা বিষন্ন হয়েই যায়।

জৈষ্ঠ। ১৪২২ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।