ফুল ছিঁড়েছিঁড়েই একজন ঘাতক-এর প্রথম পাপের সূচনা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 28 May 2015, 07:17 PM
Updated : 28 May 2015, 07:17 PM

অামার মায়ের বিষম প্রিয় ফুলটি জবাফুল। মা একবার বোনের বাড়ির বাগানের একটা জবাচারা রুয়েছিলেন অামাদের পড়ার ঘরের জানলাতলে। বাবা বলেছিলেন হেসে –
'হায়রে ফুলপ্রিয়া অামার, অামাদের এ বাগানের ঊষর মাটিতে পাতাবাহার যদিও হয়, তোমার জবাফুল কোনওদিন ফুটবে না।' বাবার বাগানঘেরা পাতাবাহার ছিলো। বাবার ছিলো পাতাবাহারপ্রীতি বিষম। যাইহোক, মা খুব মৃদুমুখি ছিলেন বলে বাবাকে কিছুই না বলে হেসেছিলেন চাপাহাসি। তো, রোজ বিকেলে মা বেশ যত্নে জবাচারায় জল দিতেন। বেশ কিছুটা দিন গড়ালো। একদিন হঠাত অামি পড়ার টেবিলে জানলা দিয়ে তাকিয়ে অবাক দুচোখে দেখি – মায়ের জবাচারা সবুজ ডালপালা মেলছে ! ও মা, ক'দিন যেতে না যেতেই দেখি – সবুজ ঝোপালো পাতার ফাঁকে দারুণ দুখানা জবাকুঁড়ি দিয়েছে উঁকি ! অফিস ফেরত বাবাকে দেখাতেই বাবাও অবাক হলেন। মা কে বিকেলে বারান্দায় চা-পান করতে-করতে বাহবা দিলেন –
'বাহ, তুমিতো তোমার শ্বশুড়বাড়ির ঊষর মাটিতে ফুলও ফুটিয়েই ছাড়বে ! '
তখনও বাবাকে কিছুই বলেননি মা। চাপাহাসি হেসেছিলেন শুধু। অারও ক'দিন পরের এক সকালে দেখি – মায়ের জলযত্নে জবার দুখানা কুঁড়িই লাল রঙের অাভাময় রেনুকা সমেত জ্বলছে রোদেলা জানলাতলে ! অামি খুশিতে হাততালি দিয়েই সবাইকে ডেকেছিলাম –
'দেখো-দেখো মায়ের জবাফুল ফুটেছে ! ' ভাইবোনেরা এলো ছুটেই। বাবাও এলেন। খুশি সবাই। বাবা বলেন –
'বলেছিলাম না, ফুটিয়ে ছাড়বেই ফুলকে ঊষর মাটিতে তোদের মা ! '

মা সেইদিন জবাব দিয়েছিলেন হেসে –
"মায়েরা জানে কেমন করে পরম ধৈর্য্যে ছেলেমেয়ের মতোন করেই চারা গাছের যত্ন করতে হয়। রোজই জল ঢালতে হয়। এবঙ পরিমাণ মতোন। যেরকম শিশুকে খাওয়ায় সময় মতোন পরিমাণ মেনেই , সেরকম। তোমরা পাঠ্যবইতে পড়েছো গাছেরও রয়েছে প্রাণ, বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম সত্যটি জানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন, তাই না?'

তাই তো, তাই তো! মা এভাবে সহজ করে বুঝিয়ে ছাড়তেন অামাদেরকে জাগতিক সকল সত্য। মায়ের গাছের কোনও ফুল ছিঁড়তে মানা মেনেছি অামরা। ফুল যখন ঝরোঝরো তখন ফুলদানিতে জলের মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে দিতেন। এভাবেই মায়ের মিঠেকড়া শাসনে বড় হয়েছি যত, ততই বুঝেছি , জাগতিক কঠিন সত্যগুলি। বুঝেছি, মা হয়ে, সহজ নয় কঠিন বাস্তবের দুনিয়াদারী। মেয়েদের বেলায় ততোধিক কঠিন জাগতিক নিয়ম-নীতি। শাঁখের করাতের মতোন কাটে, মেয়ের চলতে-ফিরতে, ফুলেল অনুভুতির শিকড়ের মেদিনী। অাজ অামার অনেক বয়স পেয়ে, মায়ের শেখানো সকল সত্য যখন যা মনে অাসতে থাকে , লিখতে চাই। লিখতে বসে অনেক অনুভবের ফুলেল ঘ্রাণ হারিয়ে যাওয়ার বেদনাময় ভোঁতা কি এক অজানিত যাতনাবিদ্ধ হই।

অনেক প্রিয় বাংলাদেশে অামারই চারপাশের ঘটমান রোজের কালো থাবার বিস্তার অমাকে চোখে অাঙুল দিয়ে দেখায় – দেখ-দেখ, কেমন দুনিয়াদারী অাজিকে ফুলপ্রিয় মেয়ের জন্য জগতে পশু মানুষগুলি রেখেছে বিছায়ে পথ চলতি সুযোগ মতোন থাবা বসাতে ! সে কোন মা বাঁচাবে তারই গর্ভজাত মেয়ের নাড়িছেঁড়া বাঁধনটুকু ! সে কোন অাঁচলতলে জড়িয়ে বাঁচাবে তারে ! সে কোন চোখের জলের ধারাজলে ভিজিয়ে শুশ্রূষা করবে তার ! লিখতে বসে নিজেই ভিজছি চোখের জলে ! অামার ফুলপ্রিয় মা তাঁর শ্বশুড়বাড়ির ঊষর মাটিতে জবাফুল ফুটিয়ে ছাড়লেও , তাঁরই মেয়ে হয়েও মধ্য বয়স পেরিয়ে অামার হাত একটি ফুলকে বাঁচানোরও ক্ষমতাধর কেউ না বলে শুধুই পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসা ! ঘাতকদের থাবা ফুলেল অনুভুতি মাড়িয়ে পাপের সূচনাকাল ছাড়িয়ে দাবড়ে বেড়ায় দুনিয়া ! অামরা শুধুই দেখি ! লিখতে চেয়ে ভাবালুতায় ভোঁতা ধাতব চিৎকার শুনতে পাই – — অামিও যেহেতু মা ! ধারণ-লালন করেছি সন্তান ও সাধের দুনিয়াদারীর সংসার ! সঙের মতোন লাগছে নিজেকেও অাজিকে !

জৈষ্ঠ। ১৪২২ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।