অন্তর আজও খুঁজে বেড়ায় নির্জনতার ঠিকানা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 14 June 2015, 06:56 AM
Updated : 14 June 2015, 06:56 AM

আজকাল হয়তো প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়িয়ে ক্লান্তচিত্তে ঝিমুনি ধরে জেঁকেই। জানি, কে আর অনন্ত বাঁচতে পায় জগতে ! তা সে যতই চায় বাঁচবে অনন্তকাল – যতই বিজ্ঞান আবিষ্কারের তাক লাগানো আইডিয়ায় অগ্রসরমানতা নিয়ে নতুন সব অন্বেষণের চমকানো ঝলকে উদ্ভাসিত – ততই অজানিত অসুখ / জরা হাজির এক একটি নতুন নামকরণের হালখাতায় ! আমার লাগে এমন যখন ঝিমুনি আসে। তখন নিজের ঝিমিয়ে পড়া একদমই এনার্জিহীনতা যেন বলতে আসে – এইতো অমোঘ আদি ও অন্তহীন শেষের নির্জনতার ঝিমুনি। তবু কি এক অতলান্ত প্রকৃতি প্রশ্ন করতে থাকে ঘোলাটে অতল জলের কবিতার মতোন ঘুরেঘুরে – তুমি কি জানো, বাতাস জানে, কেউ কি জানে – সুদূর নির্জনতা কোথায় থাকে? সে কোন আদিগন্ত অসীম দিগন্তরেখায় তাহার ঠিকানা? সে কি কবির খেয়ালে রচিত এক নীরবতার শব্দ নিছক? সে কি ঠিকানাহীন কবেকার নিঝুম পটভূমি কোনও – একদম অচিন?

ভাবি – অঢেল ঝিমুনিতলে তলিয়ে যেতেযেতে – কে দিলো "নির্জনতা" নামটি তাহারই অচিন আশ্চর্য কপালে ঠেসে? যখন কেউ কোথাও নেই … কেবল কি এক অচিন নির্জনতার মতোন অনুভব – ঝিমুনিতলে – ঝাঁকিয়ে-কাঁপিয়ে শিরদাঁড়ার গভীরে রক্ত চলাচলের জ্যাম লাগিয়ে দিয়ে তামাশা দেখতে-দেখতে চুপ … যেন বা কবরের মতোন মৃতলোকের ঠিকানা ঝুলিয়ে দিয়েছে পাথরের লাহান আমারই অকুল হৃদয় মাঝারে – কি ক্ষতি কবে সাধন করে বসেছি ! তাই আমারে মহা ফাঁপড়ে দিয়েছে ঠেলে ! তো, ঠ্যালা সামলাতে হবেই।

আমি আধোজাগরণের মাঝে হাতড়ে ফিরি তাহারে – প্রায় অবিশ্বাস্য সে এক চুপ ছবিটি যেন ! ছবির গভীরে অলীক ঠিকানা তাহার ! তবু অসীমে আছে কারও না কারও শব্দে / নৈঃশব্দে কবিতা / গল্প / নাটক / নিরীক্ষার ভিতর এক একটি ভুবনের কোলাহলের নীরবতার ভিতর এক একটি ভুবনান্ত রচনা করে ! এসব ভাবনায় আমার ঝিমুনির ভিতর যবনিকপাত / ছন্দ পতন নিভৃত-নীরব সব অঘটনের আকাশতলে ঘটিয়ে দেয় ! সে এমনই নির্জন যেন বা বুঝে ওঠার আগেই অচিন গন্ধে বাতাসেরও " প্রবেশ নিষেধ" বার্তা ঝুলিয়ে দেয় কবিতাখাকি রাক্ষস-খোক্কস হয়ে ! একটা কবিতার লাইন খুঁজে হৃদয় হয়রান – এদিকে অর্ধেকের অধিক জীবনখাকি বেকার জীবনের ফাঁকফোকর গলে পলকা সূতোর বাঁধন ছিঁড়ে সেঁধিয়ে পড়ে ! নিকশ ঝিমুনির হাঁসফাঁসের প্রহরে সে আসে নীরবতার জগদ্দল পাথরসম রঙহীন বিরাট চিরকুটে একটি নির্জন কবিতা হতেই – না, কোনও উছিলায় আমার জাগতিক চাওয়াপাওয়া ঘুচিয়ে দিয়ে আমায় নির্জনতা কাহারে কয় বুঝিয়ে দিতে কে জানে !

এমনই জটিল জর্জরিত চাপেও ভাগ্যক্রমে জেগেই উঠি ঝিমুনি হতে আবার জাগতিক সংসারের শত প্রয়োজনের হল্লাময় দারুণ মায়ামাখা বাৎসল্য জড়ানো ঘরে। দেখি যে আমারই পুরনো সেই ভাবের আতিশয্যে "নির্জনতা"-র উপমা হয়ে মাথার পাশে কেমন চুপচাপ অনেক কথাজালে জড়ানো পুরনো মলাটবদ্ধ সারিসারি কবিতাময় / গদ্যময় শতেক বই। সে এক সুবিস্ময়ের গভীরতম জগত বটে। কিছু সে পার্থিব, কিছু সে অপার্থিব বিরাট লয়ে গান ও কবিতার মতোন আবেগের জলছবিতে গড়া হাজার কবির / হাজার লেখকের মনোভূমিতে রচিত ভুবন। নির্জনতাসুদ্ধো সে এক সরব জীবন। গড্ডলতা ছাড়িয়ে সেইসব ভুবন মানুষের, নদী ও পাখিদের এবঙ শিকড়ের , আবার পাহাড়ের গভীর ভাষা লুকিয়ে রাখা দারুণ জীবনীশক্তিমাখা পাতার ভাঁজেভাঁজে হৃদয়জয়ী চিরকালীন কাহিনী। উচ্চারণে / অনুচ্চারণেও আমি তাহারে "নির্জনতা" ডাকতে চাই।

আমাদেরই হৃদয়জ চাওয়াগুলো পাওয়া ভোলানো নীরবতা রচনা করে একটি কবিতার লাইন হতে জগত জুড়ে লিখিত / অলিখিত পাতায়-পাতায় সবার মনে না হোক – কারও-কারও মনের কাব্যময় ঘোরের কড়া নাড়িয়ে যায়। তখন নির্জনতাও ঠিকই জাগে। অবাক কথাজালে সবাক হয় নির্জনতার প্রহর কবিতার খেরোখাতার পাতায়-পাতায়। তখনই হয়তো নির্জনতা নামের শব্দ চমকে ওঠে অশনিভেদী কবিতার আলোকবার্তারূপী অরূপ ছটায়। তখনই হয়তো ঝিমুনির মাঝেও জীবন ডাকতে আসে – ও ভাই, জাগো … আরও একবার জেগেই দেখো … কবিতা ভাঙছে কেমন নির্জনতার প্রহর।

৩০শে জৈষ্ঠ্য। ১৪২২ বঙ্গাব্দ।
ঢাকা। বাংলাদেশ।