জীবনে প্রথম ভারত ভ্রমণ

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 28 June 2015, 08:37 AM
Updated : 28 June 2015, 08:37 AM

তাজমহল দেখে ফেরার পরদিন আমরা আবারও টিকিট কেটে বাসেই চড়লাম। এবার জয়পুর দেখার সাধ। নেমেই মুগ্ধ দুচোখ আমাদের। মনের অজান্তেই যেন বা "বাহ" বলেছি দুজনেই। জয়পুরের সবই গোলাপি রঙ। দোকানপাট, বাড়ি, মিউজিয়ম সব গোলাপি রঙে সাজানো ছবির মতোন। তাই পিংকসিটি বলতে জয়পুর। এমন শহর দেখিনি আর। অনেক ঘুরলাম আমরা সারাদিন একটা ট্যাক্সি ভাড়ায় নিয়ে। মুঘল রাজরাজরাদের বিলাসি-আয়েশি অনেক দ্রব্য , মণিমাণিক্যখচিত সামগ্রী সম্ভারে বোঝাই মিউজিয়মে গেলাম। দেখলাম। বুঝতে পারলাম উনারা বিলাসিতার উদাহরণ পৃথিবীতে। প্রজার খাজনায় উনারা কত না ফূর্তিতে সোনা-রূপার হুক্কো আরাম কেদারায় সোনালি মখমলের তাকিয়া দিয়া মাথার নীচে আয়েশে চক্ষু মুদেই টেনেছেন নেশার সুবাসিত সোনা-রূপায় গড়া গড়গড়ার নল । আহাহা বাদশাহী এসব খায়েশ অতঃপর কব্জা করেছিলেন বাংলার তামাম জমিদারগণ। তাঁদের সার্বক্ষণিক সেবায় তটস্থ সেবাদাসিরা। আহাহা অবাক কাণ্ডকীর্তির নজির হাজারতর ব্যবহারিক সামগ্রী থরেথরে সাজানো সেথায়। দেখে তো হৃদয়সুদ্ধো অবাঙ।

এরপর "জলমহাল" দেখলাম। দারুণ কীর্তি সেটিও। জলের নীচে মহল বানিয়ে সেথায় জলকেলিতে প্রমোদমত্ত হতেন রাজা। যেন বা শ্রীকৃষ্ণ যেমন তেমনই। উনিও তখন হৃদয়ে ভগবান মহান – বুঝলাম। জলমহাল সত্যি দেখতে অপরূপ। চোখজুড়ানো। সেথায় ছবিও তুলেছি দুজনে – ট্যাক্সি চালক ক্যামেরায় করেছে ক্লিক। ছবিটা এ্যালবামে পেলেই এখানে সংযুক্ত করবো আশাকরি। আমরা জলমহাল দেখার পর একটা রেঁস্তোরায় খেলাম দারুণ ইডলি-দোসা-চাটনী-সম্বার। অসাধারণ স্বাদু খাবার। খাওয়া পর্ব চুকিয়ে সরকারী বিপনী দেখাতে নিলেন স্বামী। দোতলা বিপনীতে হরেক সম্ভার। সেখায় ঘুরেঘুরে কিনেছি স্যূভেনির, কোটা ও সিল্কের শাড়ি, মেয়ে ও ননদিনীর জন্য জয়পুরী সূতির কারুকাজ খচিত লেহেঙ্গা, ওড়না। চন্দনের আগরবাতি কিনলেন আমার স্বামী। আমরা রাতে বাসেই ফিরলাম হোটেলে।

(*যে ছবি দিতে চেয়েছি, বহু বছরে বহু বাসভবন বদলের কারণে কোনও এ্যালবামের মাঝে খুঁজেও পেলাম না। তো, জলমহালে আমরা দুজনে যে ছবিতে, সে ছবি দেয়া গেলোনা।*)
(*খুঁজে পেলাম একটা পুরনো এ্যালবামে দুখানা ছবি। দিলাম জুড়ে।*)

দিল্লী দেখার শেষদিনে আমরা আগে গেলাম ট্রাভেল অফিসে। অই অফিস যাঁর তিনিতো প্রায় হুবহু অভিনেতা আমজাদ খানের মতোন দেখতে। তাঁকে কথাটি জানাতেই বলেন – "হাঁ ইয়ে তো হাম জানতা হ্যায়, লোগ ভি এয়সা বোলতা হ্যায়"। আমরা ছবি তুলেছি উনার সনেও। কোলকাতা ফেরার টিকিট নিলেন স্বামী। আমরা রাতে চড়বো রেলে। আবার কোলকাতা। দুদিন থেকে নিজের দেশ বাংলাদেশে ফেরা … মনটা দেশ ও ছেলেমেয়ের জন্য কেমন করে উঠলো। ভ্রমন ফুরালে বাঁচি … এমন লাগলো আমার। হয়তো তারেই বলে স্বদেশপ্রীতি। হয়তো তারই নাম গর্ভধারিনী। জননী জন্মভূমি। বিদেশ বিভূঁই গেলেই তারে এমন করে আকুলচিত্তে মনে পড়তে থাকে। গভীর ভালোবাসায় জড়ায়।

রাত ন'টায় দিল্লীর হোটেল ছাড়লাম। যথাসময়ে স্টেশনে সেই ট্রাভেল এজেন্টও হাজির। তাঁকে বিদায় সালাম জানিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে আবার যাত্রা। খাওয়া প্রচুর খেলাম। রেলের দুলুনী মৃদৃমন্দ ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দিলো। আমরা জানিওনা সে রাতে একদল চরম উগ্রপন্থী মৌলবাদের হামলায় গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সুপ্রাচীন বাবরী মসজিদ। যে মসজিদ বাদশাহ আকবরের আমলের একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দারুণ সহাবস্থান রূপেই বিবেচিত হয়েছে। কারণ পাশেই রাম মন্দির। আকবরের আমলে প্রবর্তিত নিয়মানুযায়ী মসজিদে আজান শুনে মুসলমান প্রজারা যেমন নামাজে দাঁড়াতো, তেমনই পূজারী মন্দিরে সময় মতো পূজার অর্ঘ সাজিয়ে ঘন্টি বাজালে মন্দিরে ভক্তকুলের উলুধ্বনি দিতেও কোনও সমস্যা হয়নি। উগ্রপন্থী শিবসেনারা সেই রাতেই মানুষ যখন ঘুমন্ত – ডাকাতদের মতোন হামলে পড়ে বাবরী মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। এমন অন্যায় আক্রমণের আঘাতে স্তম্ভিত মুসলমান সমাজ শুধু না, সমগ্র পৃথিবী। এদিকে আমরা এতবড় ঘটনাটির কিছুমাত্র পাইনি টের। রেলের আরামদায়ক ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটলে যখন কোলকাতায় নামি – দেখি যে – রেলওয়ে স্টেশনের একদমই থমথমে একটা পরিস্থিতি। কোথাও কোনও যানবাহন নেই। রেলওয়ের কর্মকর্তা গোছের একজন যাত্রীদেরকে জানালেন খবর – সারা কোলকাতায় কারফ্যূ ঘোষিত হয়েছে। বাবরী মসজিদটি ভাঙার কারণে দাঙ্গা না বাঁধে সেই আশঙ্কাতে জরুরী আইন জারি করেছে সরকার। আমরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ। আমাদেরকে সহায়তা দিলেন রেলওয়ের কয়েকজন অফিসার। তাঁদের পরিচিত একটা ট্যাক্সিতে আমরা ভয়েভয়ে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। পথে কয়েকবার টহলরত সেনানীদের পাসপোর্ট দেখিয়ে ছাড় পেয়েছি। যাহোক, দ্বিগুন ভাড়ার টাকা দিলেন ট্যাক্সিঅলাকে আমার স্বামী। এদিকে হোটেলে খাওয়া নেই। বাইরে কোথাও কোনও রেঁস্তোরা / দোকানপাট খোলা নেই যে খাওয়া পাওয়া যাবে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বারবারই ক্ষমা চাইতে লাগলেন। পাশের একজন পড়শি হোটেলে খাওয়া নেই জানতে পেয়ে সবার জন্য খাওয়া পাঠালেন। পরের দিন হোটেল কর্তৃপক্ষ পথের ঠ্যালাঅলা, ভ্যানচালক, রিক্সাঅলাদের হোটেল সংলগ্ন দোকানে যা রান্না সেসব কিনে হোটেলবাসী সবার খাবার যোগালেন। টিনের বাসনকোসনে এলো গরম মোটা চালের ভাত, সবজি, ডাল, বেগুনভাজা, ডিমভাজা। সেসব অমৃত লাগলো আমাদের। এইতো পারস্পরিক মানবতার দায়ভার। তাইতো শিল্পীর গানের বাণী –

"মানুষ মানুষের জন্য …"

তা যদি না থাকতো জগতে মানবতা বলতে থাকতোনা কিছুই। অমানবিকতার বিস্তার যতই হোক, মানবিকতা ধুয়েমুছে যায় না বলেই মানবিকতার হাত বাড়ানো দেখি। এভাবে আমাদের কোলকাতার দুদিন হোটেলবদ্ধ ঘেরাটোপে কাটলো দমবদ্ধ দশায়। ফ্লাইটের তারিখ এলো। হোটেল কর্তৃপক্ষ নিজের ট্যাক্সি দিলেন। বিলপত্র চুকিয়ে রওয়ানা দিলাম। বেশ কয়েকবার ট্যাক্সি থামিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে পার পাওয়া হলো। আমরা দমদম বিমান বন্দরে ঢুকেই শুনি ঘোষিত হচ্ছে – সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ। বিমান বন্দরে হাজার যাত্রী করুণ মুখে সোফায়, ফ্লোরে লাগেজ নিয়ে অপেক্ষমান। আমরাও একটা সিট পেলাম। অভাবিত সে এক দৃশ্য। কত না দেশের হরেক যাত্রী। হরেক ভাষার মানুষ। উদ্বিগ্ন মুখের ভাবটি কিন্তু একইরকম। ভাবিত মুখ। হঠাৎ দেখি মাদার টেরিজা সদলে দমদম বিমান বন্দরে। সবার মাঝে দারুণ সাড়া। সাংবাদিক দল সমানে এ-মাথা ও-মাথা ক্লিক করেই যাচ্ছে। মাদার টেরিজা ছোটার মাঝে তাদের বক্তব্য দিলেন। তিনি কোলকাতায় দাঙ্গা জনিত অবস্থায় কোনও গরীব না শিকার হয়ে আহত কাতরায় – তাদের সেবা দানের মহতি কাজেই ছুটছেন। তখন এতটাই ছিলাম গাধামার্কা – ক্যামেরা থাকলেও মাদার টেরিজার সনে যে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলবো – মাথায় আসেনি। বোকা ছিলাম আদতেই। আজও ডিজিটাল অনেক কিছু শিখে না শিখে একটু আধটু লিখতে জানলেও বোকাই আছি আমার আত্মীয়দের ধারণা। সেই সময় মন জুড়েই স্বদেশের আকুল ব্যাকুল শ্যামল গন্ধে বিমান বন্দরের হাজার বিদেশিদের উচাটনের সনে আমাদেরও উচাটন উৎকন্ঠিত চোখে ঘুমহীনতা … ভ্রমণের খায়েশ পুরোপুরি উধাও। কখন আসবে বাংলাদেশ বিমান? সে যে কি এক দুঃসহ তিনটা দিনের কেবল অপেক্ষার দুচোখ … টিভিস্ক্রিনে কোনও নতুন ঘোষণা ভেসে ওঠার অপেক্ষা কাতর টানা বাহাত্তরটি ঘন্টা … সে শুধু সেদিনের করুণমুখ যাত্রীরাই জেনেছে। স্বল্প একটু দূরত্ব কতটা ব্যবধানময়তার কাঁটাতারের সীমানা প্রাচীর গড়ে রেখেছে – ভেবে আমার মনে বারবারই সাঁওতাল সুরের একটি গানের দুটি লাইন গুনগুনিয়ে অঝোর আকুল ভাষায় ঝরছিলো –

"হেথায় তুক মাইছেনাগো …
ইক্কেবারে মানাইছেনাগো … "

যাহোক, তখন আমরা এক নাগাড়ে ঠায় বসেই দমদম বিমান বন্দরের লাউঞ্জে। বাহাত্তরটি ঘন্টা কেবল অপেক্ষা – কখন সিডিউল ফ্লাইট আমাদের বহন করতে আসবে। কখন আমরা স্বদেশের মাটিতে পা রাখবো … সকল যাত্রীদের দুচোখে অপেক্ষা তারই তরে। এ যদি দেশপ্রেম না হয় – দেশপ্রেম কাহারে কয়? আজও এ প্রশ্ন সেদিনকার অনুভবে স্মৃতির কড়া নাড়িয়ে যায়। তিনটা দিনের পরেই আচমকা ঘোষণা আসে যেন বা বিধাতার রহমতের বাণী হয়েই –
"ঢাকাগামী সকল যাত্রীদের ঢাকায় নিতে আসছে বাংলাদেশ বিমান-০০৭"

আমরা যেন কোনও আসমানি বাণী শুনছি এমনই লাগলো। বারবার ঘোষিত হতে লাগলো সেই ঘোষণা। ঝটপট লাগেজ সমেত আমরা রেডি। অচিরে আসে সে প্রেমের বাহনখানি হয়েই। সেই সময় দমদম বিমান বন্দরে আটকা পড়া শতেক যাত্রীদের স্বদেশে নিতে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ বোয়িং বিমান পাঠিয়েছে। আমরা আমাদের তিনটি দিনের বিদেশী সহযাত্রীদের – "বাই-বাই-বাই" শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিই। বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ০০৭ এর পাইলট ও কেবিন ক্রু সবাই আন্তরিক শুকরিয়ায় আমাদের বিমানে সিটে বসিয়ে দিয়ে চটজলদি দক্ষতায় বোয়িং আকাশপথে উড়িয়ে দেয়। আমি যে কতশতবার দুচোখ ভিজে যাওয়া চোখে সকল যাত্রীর চোখগুলিকে সজল দেখেছি আর ভেবেছি –

"সকল দেশের সেরা সে দেশ আমার জন্মভূমি …
সে যে আমার জন্মভূমি … সে যে আমার জন্মভূমি"

কি করে জেগেছিলো কবির মনে ! কবিও হয়তো এমনতর কিছু অনুভবের জোরে একটি গানের লাইন জন্ম দিয়েছিলেন। যাক, সেদিন জন্মভূমিতে আমাদেরকে নিরাপদে অবতরণ করিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমান এর বোয়িং ০০৭ এর পাইলট। এ নিয়ে প্রথম লিখেছিলাম "আজকের কাগজ" এর সাহিত্য সম্পাদকের অনুরোধে (কবি ও সম্পাদক শামীম রেজা) আমার কলাম "পঙক্তি ঘোরের খোঁজে"। আমার একটাই গদ্যবই প্রকাশিত রয়েছে – বইটির নামকরণ করেছি একই নামে – "পঙক্তি ঘোরের খোঁজে"। তারই মাঝে জড়ানো আমার প্রথম ভারত দেখার ভ্রমণের অনুধাবনমালা। আমার স্বদেশঘোর। সে এক প্রেমানুভুতি বলা যেতেও পারে।

২৮ শে জুন। ২০১৫ সাল।
ঢাকা। বাংলাদেশ।