বাড়ি ভাবতে বাবার মুখ সে এক জগতবাড়ি

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 8 Feb 2016, 07:45 PM
Updated : 8 Feb 2016, 07:45 PM

আমার মনে সেই সে শিশুকালে যেমন আজও তেমনই – বাড়ির কথা ভাবতে – বাবার মুখ। অতঃপর মা ও দাদীর মুখ। বাবার বাড়িটা জমজমাট ছিলো তখন। আমাদের কিশোর বেলায়, তরুণ বয়সেও বাড়িটা ভর্তি থাকতো আত্মীয়-স্বজনে। খালি থাকতোই না। মেহমান কেউ না কেউ হাজির। থাকার মেহমান। মা ও বাবা হাসিমুখে তাঁদের মেহমানদারি করতে থাকতেন। চাকুরীজীবী বাবা নিজের সাধ্যমতো বাজার আনতেন দুহাতে দুই চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে। রাজগঞ্জ বাজার ছিলো বাড়ির কাছে। হেঁটেই বাজারে যেতেন। বাজারপ্রিয় মানুষ বাবা আমার। মেহমানদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন খুব। সেকালে অতিথি আসার মানে – ভাগ্যবানের ঘরেই অতিথি আসে। মাসের অর্ধেকেই ফুরাতো বেতনের পুরোটা। মায়ের তখন সামলানো নিজের জমানো টাকায়। এভাবেই আমরা দশ ভাইবোনের বেড়ে ওঠার স্মৃতিময় বাবার বাড়ি।

বাবার বড়ো পাতাবাহার গাছের বাতিক ছিলো। বাগান ঘিরে বাহারি পাতাবাহার লাগিয়েছিলেন – মায়ের সুপারি গাছের পাশাপাশি। দেখতে দারুণ লাগতো। বাবা, মা বিষম বইপ্রিয় মানুষ ছিলেন। বাবা মায়ের জন্য তখনকার বিখ্যাত লেখকদের বই কিনতে ভালোবাসতেন। আমাদেরও জন্মদিনে দিতেন উপহার দারুণ গল্পের বই কিশোরপাঠযোগ্য। কিশোরী বেলায় ছুটির দুপুরে লুকিয়ে পড়তাম মায়ের বই। তরুণী বেলায় পারমিশন পাই বাবার কাছেই প্রথম বড়দের ঢাউস উপন্যাস পাঠের। বাড়িভর্তি লোকজনের মাঝেও মাঝেমাঝে অবকাশের দুপুর আসতো ঠিক। আমার সেদিন নতুন কোনও একটি পাঠে হৃদয়সুদ্ধো মাথাগোঁজ সারাটি বেলা। নাওয়াখাওয়া ভুলেই গিলতাম গল্পের লাইনগুলি। মায়ের বকাবকি মাথায় ঢুকতো না। বাবার সস্নেহ প্রশ্রয় পেতাম সেই সময়। মা গজগজ করতে থাকতেন – "অইতো আশকারা দিয়েই মেয়েকে মাথায় উঠিয়েছে। রাতদিন কি বই পড়তে আছে? "

তো, অই বাবার বাড়িতে এভাবেই বেড়েছি। মনে পড়ছে আমার তেরতম জন্মদিনে বাবার উপহার দু'খানা বই। দারুণ লেগেছিলো একটি – "বিনা টিকিটের যাত্রী"। অসাধারণ গল্প। আজও আবছা-ঝাপসা বইটির প্রচ্ছদপট ও নাম বিষম মনে আসছে অবিকল। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী রহস্যময় বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ার গল্পে লোকটি আদতেই অচেনা যাত্রী হিসেবে উঠেছিলো চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে। বাবা আমাকে পড়ুয়া বানিয়েছেন। তাঁর স্মরণশক্তি আশ্চর্যরকম ছিলো। কার কি পছন্দ বাবার মুখস্ত। আমরা যে যা পছন্দমতো খাবার চাইতাম বাবার সাধ্যমতো কিনতে বেরুতেন সেসব। প্রিয় ছোটখালার পছন্দ জিলেপি – সে এলেই গরমাগরম জিলেপি কিনতে বাবার বাজারে যাওয়া চাই।

তারও অনেক পরের কথা – আমরা বিবাহসূত্রে অনেক দূরে – বাবার বাড়ি এলেই বাবা বাজারে ছুটতেন। আমার, জামাইয়ের, নাতি-নাত্নীর মন-পছন্দ বাজার এনে হাজির করতেন সামনে। মা কে ফরমায়েশ করতেন – মাছটা অইভাবে করবে, মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট, চিংড়ি পুঁইশাকে, মুরগী রেজালা তোমার অসাধারণ। মা হেসে সবই রাঁধতেন। খাবার পরে বাবার সাধাসাধিতে দই ও সন্দেশ গিলতে হতো। সকল বাবা এমন হন – আমার মন বলছে। বাবা প্রয়াত আজ। অনেক বছর অাগেই মা গেছেন অচিনপুর। আমাদের জগতবাড়ি খাঁখাঁ এখন। আমি বাতাসে হাহাকার শুনতে পাই। বাবা কে ভেবে বাবার বাড়িটি ভেবেই মনে কয়েকখানা পঙক্তি এলো। সদ্যলিখিত। শেয়ার  করলাম পাঠকদের সনে।

প্রশ্নবিদ্ধ জগতবাড়ি।।
নুরুন্নাহার শিরীন।।
*************
আজও দাঁড়িয়ে আছে।
হৃদয়পুরের কাছে।
ভেবেছিলাম সেই সে।
প্রিয় বাতাসে-বাতাসে …
ভুলে গেছি সে নয় তো –
বাবার আগলে রাখা শত –
পিতৃস্নেহচ্ছায়াময় পাতাবাহারের ডাক …
সে আজ প্রশ্নবোধক অংশীদারের ভাগ।
আমার ক্ষমতা কই?
কি করে বলি যে তারে – আমি তোর হই?
ভিটেমাটির ভিতর –
ছুঁয়ে আছি কম্পমান ভঙুর শিকড়।

৮-ই ফেব্রুয়ারী। ২০১৬ ইং।
ঢাকা। বাংলাদেশ।