কাজী আনোয়ার হোসেনের আকাশ ও বাতাস

জি এইচ হাবীবজি এইচ হাবীব
Published : 28 Sept 2011, 11:01 AM
Updated : 21 Jan 2022, 11:28 AM


২০২২ সালের ১৯শে জানুয়ারি বুধবার একজন মানুষ মারা গেছেন।
অবশ্য একথা সত্য যে, সেদিন এই ধরাধামে, এই বাংলাদেশে, অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু আমরা যাঁর কথা বলছি, তিনি অন্য অনেকের মতো নন। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন, অনেক ভালোবেসে যাঁকে পাঠকেরা, তাঁর অগণন গুণমুদ্ধরা, কাজীদা' বলে ডাকতেন, ডাকেন, ডাকবেন, বহুকাল ধ'রে।
ছিয়াশি বছরের একটি দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি। বর্ণাঢ্য জীবন অনেকেই কাটান, কিন্তু কাজী আনোয়ার হোসেনের জীবনের বর্ণাঢ্যতা একেবারেই অন্যরকম, অন্য গোত্রীয়। তাঁর জীবন বর্ণিল হতে পারতো একজন প্লে ব্যাক সিঙ্গার তথা গায়ক হিসেবে, একজন তথাকথিত 'মৌলিক' লেখক হিসেবে। আর তাঁর সেই সামর্থ্যের কথা স্বীকার করতে তিলেক বিলম্ব হবে না যদি কেউ সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং ছবিতে তাঁর প্লে ব্যাক করা "এই যে আকাশ, এই যে বাতাস" গানটি একবার শোনেন;
https://www.youtube.com/watch?v=ebW_zsVzLXE
আর, গত শতকে ৬-এর দশকে রচিত তাঁর ছোটগল্পগুলো তাঁর লেখক সত্তার পক্ষে কথা বলবে (উল্লেখ্য, কাজী আনোয়ার হোসেনের এই "মৌলিক" সাহিত্যকর্মের কথা আমার জানা ছিল না; জানিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক রওশন জামিল, তাঁর জনৈক শিক্ষকের বরাত দিয়ে)। তাঁর জন্য অনায়াস সাধ্য ছিল এই দুই বৃত্তি। যেখানে তিনি পেতে পারতেন সমাজের 'এলিট' শ্রেণীর স্বীকৃতি ও সম্মান, যদিও হয়ত তা দিয়ে তিনি তাঁর জীবিকা নির্বাহ করতে পারতেন না।

কিন্তু তিনি বেছে নিলেন বাংলা প্রকাশনা ও অনুবাদকের যথাক্রমে দুর্গম ও ধন্যবাদশূন্য বৃত্তি। এবং তা করতে গিয়ে এই দুই ক্ষেত্রে একরকম বিপ্লবই ঘটালেন। বেশ কিছু সমর্থ অনুবাদকের একটি দল নিয়ে – যে-দলের উল্লেখযোগ্য সদস্য শেখ আব্দুল হাকিম, রকিব হাসান, নিয়াজ মোরশেদ, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান, খসরু চৌধুরী, শওকত হোসেন, অনীশ দাশ অপু, তাহের শামসুদ্দিন, প্রমুখ — প্রথমে বেশ 'নাইভ' গোয়েন্দা কাহিনী কুয়াশা, পরে যথেষ্ট পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্কপাঠ্য থ্রিলার তথা স্পাই কাহিনী 'মাসুদ রানা', সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা কিছু নন ফিকশন, যেমন যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান, ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন, খালি হাতে আত্মরক্ষা, সঠিক নিয়মে লেখা পড়া লিখে, রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যের অসাধারণ কিছু গল্প অ্যাডাপ্ট ক'রে, বিচিত্র ধরনের লেখা সম্বলিত রহস্য পত্রিকা ও কিশোর পত্রিকা সম্পাদনা ক'রে, বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিক, কিশোর পাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনী 'তিন গোয়েন্দা', ও বিজ্ঞান কল্প-কাহিনী এবং ওয়েস্টার্ন কাহিনী অনুবাদ করিয়ে, মাঝে মাঝে নিজেও ক'রে, তিনি ও তাঁর 'সেবা' কিশোর, তরুণ, যুবক এমনকি অশীতিপরদেরকেও মন্ত্রমুগ্ধ রাখলেন দশকের পর দশক, যে প্রক্রিয়া এখনো চলমান। কত অযুত পাঠকের কল্পনাকে, পাঠাভ্যাসকে, জ্ঞান ও কল্পনার জগৎকে, শৈশব, কৈশোর, ও যৌবনকে তিনি তাঁর লেখা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনীর এন্তার বই-পত্রের সাহায্যে উজ্জীবিত, রঙিন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এ-নিছক ছেলে খেলা নয়।

তাঁর নিজের লেখার বিষয়ে এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। সত্য যে, একজন অনুবাদকের উৎস ভাষার চাইতে লক্ষ্য ভাষায় অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষতা থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করা হয়, এবং কাজী আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলারই ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন সেটা তাঁর অনুবাদ, অ্যাডাপ্টেশন, বই নির্বাচন, এসব থেকে আমরা বুঝতে পারি। আর, যে-বাংলায় তিনি লিখলেন, বিশেষ ক'রে অনুবাদ ও অ্যাডাপ্টেশন করলেন, তার প্রসাদ গুণ ও বিষয়য়ানুগ ব্যবহার এক কথায় তুলনারহিত। গোয়েন্দা বা রহস্য গল্প, এবং থ্রিলার বা স্পাই কাহিনীর জন্য যে ধরনের গতিশীল, বাহুল্যবর্জিত চৌকস ভাষা দরকার, পাঠককে যা বইয়ের পাতায় আটকে রাখে, বাংলায় তার পরাকাষ্ঠা দেখালেন তিনি।

তাঁর গড়া সেবা প্রকাশনী নানান দিক থেকেই অনন্য। প্রুফ দেখার আদর্শ ব্যাপারটা কেমন তা জানা হয়েছিল 'সেবা' থেকে এই অনুবাদকের বই প্রকাশ হওয়ার আগেই, একদিন সে-অফিসে গিয়ে, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে।। দেখা গেল, একজন চশমাধারী তরুণ একটা পাণ্ডুলিপি থেকে প'ড়ে যাচ্ছেন, একেবারে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, উদ্ধৃতি-প্রশ্ন-আশ্চর্যবোধক চিহ্নসহ, অন্য জন প্রুফ দেখে তা মেলাচ্ছেন। আজ, একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের গোড়ার দিকেও বাংলার অগুনতি প্রকাশনা সংস্থার ক'টিতে প্রুফ দেখার এই মোক্ষম নিয়ম অনুসরণ করা হয় তা জানতে ইচ্ছা করে।
সেবার বইয়ের আর এক অমোঘ আকর্ষণের কথা বলতেই হবে। সেই আকর্ষণ হচ্ছে, প্রথম দিকে শিল্পী হাশেম খানের চমৎকার সব ড্রয়িং সম্বলিত প্রচ্ছদ; আর পরে শাহাদত চৌধুরী, আসাদুজ্জামান, ধ্রুব এষ, আলীম আজীজ-এর কোলাজ নির্ভর প্রচ্ছদ। এবং, প্রচ্ছদে কোলাজের প্রবর্তন সম্ভবত 'সেবা'ই প্রথম করে।

মুদ্রণ বিভ্রাট তথা ছাপাখানার ভূতের দৌরাত্ম্যহীনতা, সহজবোধ্য কিন্তু ঋজু বাংলা গদ্য এবং বিদেশী শব্দের সঠিক উচ্চারণ সরবরাহের ব্যাপারে বরাবর সচতেনতার পরিচয় দিয়ে 'সেবা' পাঠক সমাজের ভালোবাসা ও সমীহ কুড়িয়েছে। অন্যদিকে লেখকদের সমীহ আদায় করেছে সম্মানী তথা রয়্যালটি তাঁদেরকে পাই পাই ক'রে যথাসময়ে বুঝিয়ে দিয়ে । লেখক বা অনুবাদক বা প্রদায়করা তাঁদের সম্মানীর জন্য তাগাদা দিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে গিয়ে পাননি, এমন ঘটনা 'সেবা'-র ইতিহাসে বিরল। এই বিষয়টি আজো অনুকরণীয়। সম্প্রতি একটি ঘটনায় সে-সুনাম বেশ ক্ষুণ্ন হয়েছে অবশ্য। সেটা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করবো আমরা; আলোচনা করবো ব্যবহৃত বিদেশী বইগুলোর কপিরাইট সংক্রান্ত জরুরি বিষয়-ও। তবে, অন্য কোনো সময়ে।

সারস্বত মহল তথা অ্যাকাডেমিয়াতে, বা তথাকথিত ভদ্র জনপরিসরে কাজী আনোয়ার হোসেন বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী, বা সেখান থেকে প্রকাশিত বই-পত্র ব্রাত্য, অপাংক্তেয়, জানি। কিন্তু বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে, এত যত্ন নিয়ে সম্পাদনা ক'রে, শব্দ-বানান-উচ্চারণ, বইয়ের সহজলভ্যতা, বিক্রয় মূল্যের সহনীয়তা, ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখে এদেশের খুব কম প্রকাশনীই উচ্চ মানের বই প্রকাশ ক'রে থাকে। হতে পারে সেসব বই নিউজপ্রিন্টে ছাপা, কম দামের, রেলস্টেশন বা পথের ধারে লভ্য। তাতে সেসব বইয়ের, বা সেসব বইয়ের লেখক-অনুবাদকের মান মর্যাদা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগে পাঠ্য হওয়া দরকার কাজী আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সেবা প্রকাশনীর ইতিহাস; তাঁর জীবন, কর্ম, এবং বাংলা প্রকাশনা জগতে তাঁর অবদান নিয়ে হওয়া দরকার পিএইচডি পর্যায়ের কোনো গবেষণা।
আমরা বিস্মৃতিপরায়ণ। কিন্তু কাজী আনোয়ার হোসেনকে ভুলে যাওয়া হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতমূলক।