শীতার্ত জলছবি

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 19 Nov 2011, 06:24 PM
Updated : 19 Nov 2011, 06:24 PM

ভোরের ঠান্ডা কুয়াশাভর্তি জানালায় চিলতে আকাশরেখার সনে একঝলক শীতার্ত শিকড়গন্ধ জানান দিলো হ্যাঁ, বাংলাদেশে এসে পড়েছে শীতঋতু। জাঁকানো-কাঁপানো হিমেল শীতকাল আজকাল তেমন সেকালের মতোন নেই-নেই এমন কথা লোকজনের মুখে রটেছে বটে, তবুও শীতকাল স্বল্পকালীন হলেও হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হঠাৎ বেশ জেঁকেই নামে। তখন লোকজনের শীতের জন্য যার যেমন সাধ্যি তেমন শীতেপোষাক কেনাকাটার ঝোঁক দেখা যায় ছোট-বড় বিপনিগুলোয়। আর যাদের ঠাঁই ফুটপাথ/ বৃক্ষতলায় তারা আসন্ন শীত যেন না আসে তার জন্যই খড়কুটোয় অাগুন জ্বেলে প্রার্থনা জানায় হয়তো। এই দৃশ্যটি দেশের অনেক জায়গায় অামরা দেখি। বিশেষ করে মাঠে বা পার্কের কোণায় দল বেঁধেই অাগুন পোহানো দৃশ্য খবরে দেখি। রাস্তায় বেরুলেও নজরে পড়ে। গ্রামেতো শীতকালের অাগুন পোহানোর ছবিটি প্রায় বাড়ির উঠোনে দেখতে পাওয়া যায়।

এবঙ ভোরের শিশিরের খসে পড়ার জলজ সবুজ কুয়াশার মুখ আদতে বিষম মায়াবি। এই বাংলার চিরন্তন রূপসী মূর্তি। যার জন্য জীবনানন্দ লিখেছেন আশ্চর্য পঙক্তি –
" বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি / তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর "

যদিও মানুষের নির্মমতায় প্রকৃতি নিজস্ব স্বাভাবিক রূপটি খুইয়ে বসেছে প্রায়। তথাপি ঋতুচক্র ঠিকই তার আগমনী জানান দেয় আজও। মনে পড়ছে ছেলেবেলার হাড়কাঁপানো শীতের ভোরে কিছুতাই লেপের ওম ছেড়ে না ওঠার বিস্তর অপচেষ্টা স্বত্তেও অবশেষে মায়ের ঝাড়ি খেয়ে ঊঠে পড়ার স্নেহ জাগানিয়া দিন। মায়ের শেখানো ছড়া কাটতাম জোরে –
" শীত আমার মিত / আগুন আমার ভাই / শীতের কাছে কইও ও ভাই / আমার কাঁথাকাপড় নাই "
যেন ছড়ার জোরে শীত পালাবে !

আজ মা বেঁচে নেই বলেই যেন বা বাড়ির সেই শীতের আনন্দানুভূতিরও ধার নেই। চারপাশের বহুবিধ যান্ত্রিক-ধাতব-পাথুরে আওয়াজের আতিশয্যে ঋতুর একান্ত বদলে যাওয়া স্মৃতির জলছবির গন্ধ ঢাকা পড়ে যায়। ওই ঢাকার ফাঁকফোকর গলেও ঠিক ভাবগা ঘরে চাঁদের আলোরেখার মতোই ঢুকে পড়ে নবান্নের চিতই-ভাপা-পুলিপিঠের ঘ্রাণ! আদিম অবারিত প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা মাঠের-মায়ের কথাই বলে যেন বা। সেইসব আনন্দনের টান একটু যেন চিড় খাওয়া বেদনায় ম্লান অাজিকে।

তথাপি বাঙালি মন ক্যামন যেন এক নাড়ির টানেই ঋতুর পানে ধায়। আমাদের ষড়ঋতুর ষড়ৈশ্বর্য জগতের আর কোথাও কি পাওয়া যায় ! যায়না বলেই শত কুঠারে-কুঠারে কাটা পড়া বাংলার প্রকৃতি আজও গান গায় –

বেলা যে আজ ভরে গেলো পাকা ফসলে / মরি হায় হায় হায় / পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে ছুটে আয় আয় আয়।

পৌষ। ১৪২১ বঙ্গাব্দ।