জলছবিপাঠ

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 23 Nov 2011, 02:17 PM
Updated : 23 Nov 2011, 02:17 PM

আজকাল মাঝেমাঝেই পুরনো জং লাগা জলছবিদের জং খুলে পড়ে নিই তাদের যত পুরনো কথাজাল। পড়তে-পড়তে পুনরায় বিষম মুগ্ধতায় ভাবি – এত যে অমল পাঠ এত যে গীতল এতটা জ্বলন্ত আর এতটা শীতল তার নাম হতে পারে প্রেম। হতে পারে দেশ। অথবা সে ছবিময় অধরা-অশেষ।

আজ যদি অশেষের জলছবিদের আমারই জানালাতলে পুনরায় পাঠ করি – ডাকি – মনে হয় সে যেন বিষম উড়ো ছটফটে পাখি। ছমছমে গন্ধ তার ঝমঝমে গাঁ ছায়ায়-ছায়ায় উদাস। হাজার তারার জয়োচ্ছ্বাসে ঘুম আসেনা – সুতীব্র তার চিরন্তন শ্বাস। দেখি সূর্যজাগা সৃষ্টিধুম। দেখি বৃষ্টিধোয়া ঘুম। দেখি পাতাভর্তি মেঘলা-সবুজ রঙ। দেখি দৃষ্টিকাঁপা ছেলেবেলা, পাঠশালা ঢংঢং। আদিগন্ত মাঠ আর মাঠের অমল ঘাসের ভিতর জেগে ওঠা ধূসর দোসর। পড়ি তার অলিখিত হাজার খবর। যেন সে পাগল যত মেঘভর্তি আগুনিয়া প্রাণ। যেন সে উথাল স্বপ্নঘ্রাণ, শত্রুমুক্ত গান। সেখানে মুক্তির মানে বাধাহীন বইমেলা, ভালোবাসা। সেখানে মুক্তির মানে অঢেল আনন্দ কিনে জগতবাড়ির ঘাটে ফিরে আসা। তখনইতো মনে আসে সদ্য কেনা পাতার কথাও। মনে আসে কে কখন চেয়েছিলো শীতের কবিতা? বলেছিলো বসন্তের কথাও? আজও সে কথাজাল আছে তোলা। অবাঙ খাতার পাতায় আবার হয়তো তারই ব্যথা হবে খোলা। হয়তো হবেনা। আহা সে কি ঝর্ণা ? না গুমোট বর্ষাবেলা ? তার পদচিহ্নে জ্বলে বাংলার রূপোলি খেলা। খেলা ফেলে চলে যেতে হবে – মনে হলেই – দুচোখ ভেসে যায় ঘোলাটে জলে। জানি সারিসারি চলে যাওয়ারা আর জীবনে ফেরেনা। নোঙরের মুথা দাগ হয়তোবা পড়ে থাকে ক্যামন অচেনা ! অই অচেনার সনে যোগ হয় নতুন অনেক ঝকঝকে মুখ। তারা সেথায় নতুন ঘর বাঁধে। আবার নতুন করে লেখা হয় সুখদুখ। আজকাল নাগরিক সব ঘরে-ঘরে চকচকে স্নানঘর – শুনি – অর্ধচেনা-অর্ধজানা আশপাশের নতুন কলস্বর। অই মুখ অই ঘরদোর আমারই পাড়ায় ছিলো – অনেকটা কাল আমার তেমন নজর পড়েনি – আজ হঠাত পড়লো।

আদতে চিরকালীন জলছবি চিরকালই নতুন দেখায়। অই যে মাঠের পারে রেল যায়
যাত্রী ও মালবোঝাই, সেও কিন্তু অনেক কালের চেনাই। এমন কি একলা দাঁড়িয়ে থাকা গাছ ও জগতভোর, থমথমে দিন, চাঁদমাখা রাত সমস্তই আবারও রচে নব-নব ঘোর। এবঙ অনন্ত ছাত, ছাতহীনাদের দুঃখকাল, সেও কিন্তু আমাদেরই জখমিত সব গেরস্থালিজাল। আমি কি তেমন পারি লিখতে সেসব অন্তহীন ঘোর বেদনার লাল ! আমি কি ভুলেও জানি সামনে কি ! আদ্যন্ত কবিতা না কি গল্প ! না নতুন না পুরনো না জেনেই আমার বাংলাজানালায় কড়া নাড়ে রোজের হাজার চিত্রকল্প, আমি কি লিখবো আজ একে-একে অইসব অলিখিত সহজিয়া দেশজ গন্ধের গদ্যপদ্য ! এইতো খানিক আগেই রাস্তায় দেখা নতুন মুখকে মনে করে হয়তো কবিতা হবে, কিংবা গল্প, পাতারা রাখবে ধরে।

এই যে রোজই সূর্যাস্তের পারে পাখিরাও ঝাঁক বেঁধে ফেরে নীড়ে, কাল আবারও দেখা হবে ঠিক যথারীতি সূর্য ওঠা ঘিরে। বলি, তাইতো জগতে শাদা-কালোর ঝগড়া আজ মিটে যাওয়াই ভালো। তবেই হয়তো আবছা-ঝাপসা বিগত সবই মনে হবে আলো। সে আলোয় ভেসে আসবেই সবুজের গান। সে আলোয় আবার ঝলোমলো জয়োচ্ছ্বাসে জেগে উঠবে লক্ষ এপার-ওপারের সন্ত বিজয়কালের ঊষশি কলতান। আজ খুব করে জানি, সে আমার সততঃ উড্ডীন দেশ। সে আমার প্রেম, অধরা-অশেষ বাংলাদেশ।

এভাবেই ছুটন্ততার এক একটি কাল, কালধারায় ধাবমান অনন্ত মহাকাল, তারাময় তারা যেন জ্বলন্ত জলছবিদের গান ! যারা আমায় এই অাটান্ন বয়স অব্দি ডেকেছে প্রেমের অধিক ! যেন বলেছে –
পারতো আমায় ধরো !
আমিও জগত-সংসার এমন কি নিজেকেও প্রায় ভুলে লিখতে চেয়েছি ছুটন্ত কালের গান ! অথচ কাজটি সহজসাধ্য নয় মোটেও ! উপরন্তু এতটাই ধাবমান যে আমার মতো সামান্য একজন লিখিয়ের সাধ্য কি ধরি তারে ! তো, প্রায়ই চালশে দুচোখ যেন বা ভেসে যায়-যায় আরকি ! তারই বিস্তর খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তেই পড়ি তার ঐতিহাসিক যত জানা কি অজানিত পুঁথি ! এবঙ লিখি। লিখি মানে লেখার প্রয়াস চালাই। চালিয়েই যাচ্ছি। যেদিন মোটে লেখা হয়না দু'চারটে লাইনও নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপান্তরিত উদ্ভট মানবীই মনে হয়। নিজের কাছেই নিজেকে একা-অপাঙক্তেয় লাগে। আর লেখা যেদিন আপনা থেকেই হয় নিজেকে বিশ্বজয়ী প্রেমীর মতো উড্ডীনতায় পেয়ে বসে। কেউ তা ভালোবাসুক না বাসুক পরোয়া না করেই লিখি যখন যা মনে আসে। মনের মধ্যে চিরজাগ্রত এক দেশ, সে আমার প্রথম প্রেম, প্রিয় বাংলাদেশ। তারই জন্য নিবেদিত আমার যত জলছবিময় পঙক্তিমালা – এই লেখায় তারই প্রকট ছায়া পড়েছে শব্দাতুর কবিতা হতে গদ্যের জটিল জগতে।

সঙ্গে – ' আজও জলছবি পড়ি ' কাব্যগ্রন্থের শেষাংশের পঙক্তিমালা জুড়ে দিলাম –

আজ যখন আকাশ নিয়েও ঝগড়া
হাস্যকর কেউ
যে কোনও উছিলায় গান ভুলে
খেয়োখেয়ি বিশ্রী ঘেউ
মরুকগে তারা। আজ
আমার তোমার গান পড়া।
তোমার নামটি বেশ, বাংলাদেশ।
তুমি মানে মনে পড়া।

তুমি মানে মহানিম –
তুমি জলছবি রিমঝিম।
তুমি নদীময় দিন –
স্মৃতির হাজার থিম।
তোমার টানেই বুঝি, ভাগ্যিশ জন্মেছি বঙ্গে !
আহ কি অপরিশোধ্য ঋণ ছবি ও গানের সঙ্গে !

মনে আছে ধানকাটা অঘ্রাণের ভারে
উঠোন-বাগান থইথই, আমরা বন্ধুরা নদীপারে। হঠাত বিকট শব্দে ট্রাক গঞ্জ থেকে
বালুভর্তি ট্রাক
গাঁয়ে পাকা রাস্তা হবে, মেম্বারের
সে কি হাঁকডাক !

বস্তা-বস্তা বালু, তার উপর গড়িয়ে পড়া
গরম পিচের ঢল
দেখতে আমরা ছুটে যাই, মেম্বার হাঁকেন-
সরে যা মেয়ের দল !
সরতে-সরতে দূরে, যন্ত্রের অদ্ভুত
জারিজুরি দেখি।
রাস্তা হয় গাঁয়, তার মেঠো
পথের হারিয়ে যাওয়া দেখি।

এরপর ইলেকট্রিকও আসে।
লন্ঠনের কাচগন্ধ দূরে
যেতে-যেতে প্রায় বনবাসে।
তবুও অঘ্রাণ এলে কি জানি কি ধানী বেদনায়
উদাস নদীরা ডাকে –
মেঠোপথ পাঁজর জাগায়।

( *নুরুন্নাহার শিরীন-এর নির্বাচিত দেশজ কবিতা, পৃষ্ঠা ৪৪* )

জানুয়ারী। ২০১৫ সাল।
১৪২১ বঙ্গাব্দ।।