আজও স্মৃতিময় প্রিয় শহর, প্রিয় বীরচন্দ্র গণপাঠাগার

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 15 Feb 2012, 11:52 AM
Updated : 15 Feb 2012, 11:52 AM

আজও বেশ মনে আছে আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে, কুমিল্লা-র শৈলরাণী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়-এ পড়ি। ১৯৬৪ সাল। প্রায় পঞ্চাশ বর্ষ আগের কথা। তখন বিকেলে বাবার সঙ্গে রিক্সায় ঘুরতাম প্রায়ই, বইখাতার দোকানে / চুড়ি-ফিতা-ক্লিপ-এর দোকানে / জুতোর দোকানে। অনেক সময় নিজের পছন্দের জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন বাবা। কি ফুরফুরে সময় উড়তো তখন। কি যে অভূত রোমাঞ্চিত হোতাম, ভাবতেই আজও তেমনই প্রায় রোমাঞ্চ টের পাই হৃদয়ময়।

তেমন এক দিনের কথা বলি, সেদিন বাবার সঙ্গে রিক্সায় চড়েছি। বাবা কিন্তু কিছুতে বলছেন না কোথায় যাচ্ছি। অথচ, আমার জানার জন্য মন উসখুস। একটু পরপরই শুধোচ্ছি – ও বাবা, কোথায় যাচ্ছি ? বাবা হেসে বলেন – চল, গিয়েই দেখবি। অগত্যা চুপ হই। আবার অন্য প্রশ্নে যাই – ও বাবা, এখানে কি নতুন মার্কেট উঠবে ? / এ্যাত্তো বস্তা-বস্তা ইট-বালি-সিমেন্টভর্তি ট্রাক আসছে কেন ? / এই রাস্তার নামটা কি ? ইত্যাকার কত যে প্রশ্ন – বাবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। যথাসম্ভব সঠিক উত্তর দিয়েছেন। তখন আমাদের কুমিল্লার বাতাসে নির্মল সতেজ নৈসর্গিক গন্ধ উড়তো। অই গন্ধে মন খারাপ থাকলেও আবার মন ভালো হয়ে যেতো। এখনকার একদম বিপরীত অবস্থা বলা যায়। তাছাড়া বয়সটাও ছিলো উড্ডীনতার। যা কিছু দেখি তা-ই ভালো লাগে। তাতেই মন ভেসে যায় এমন – যেন উড়ালপঙ্ক্ষী ! তো, কান্দিরপারে রিক্সা যেতেই প্রশ্ন করি – এই রাস্তার নাম কান্দিরপার কেন বাবা? জবাবে বাবা বলেন – হয়তো তখন বৃটিশরাজ রাস্তা তৈরীর কালে এখানে কলার কান্দির ঝাড় ছিলো, তাই কান্দিরপার নাম। বাবার উত্তর আমার মনে ধরে খুব।

ততক্ষণে কান্দিরপার মোড় ঘুরে রিক্সা পৌঁচেছে বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন-এর ফটকে। আনন্দাতিশয্যে আমার তখন মুখে কোনও কথা নেই। অবাঙ দুই চোখে মুগ্ধতাঘোর। ঘোর ভাঙে বাবার ডাকে – কি রে, আয়, আজ তোকে তোর সাধের পাঠাগার দেখাই, আয়। আমার মন বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে। বাবার হাত ধরে প্রবেশ করি বিশাল নগর মিলনায়তনে, যা আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিলো – সেই ইচ্ছেপূরণ করেন বাবা-ই – আমি আমার জীবনে প্রথম পাঠাগার দেখি।

যার নামকরণ করা হয়েছে সে সময়ের মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যরাজ-এর নামে। কেননা তাঁরই অনুদানে তখন তাঁর দেয়া জমির 'পরে তৈরী হয় কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন ও গণপাঠাগার। পাঠাগারের বিশালতা দেখে আমার কিশোরি হৃদয় সুবিস্ময়ে হা ! সুউচ্চ সেলফভর্তি সারি-সারি মলাটের ভিতর অজানিত রহস্যের হাতছানিময় কথামালায় চুপ এতো বই ! বইয়ের জগত সেই প্রথম দেখা আমার। তার কথা কি জীবনে ভুলতে পারি !

পারিনা বলেই আজও এই মধ্য বয়সেও তার স্মৃতি আমায় টানে আগের মতোই সুতীব্র আকর্ষণে। যদিও জানিনা সে আজ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে কি হয়নি, কেবল সে যেন তার সুউচ্চ বইয়ের ভান্ডার নিয়ে ডেকে নেয় ভবিষ্য প্রজন্মকে। তার জন্য আজ আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা এই।

এবঙ সরকারের প্রতিও আবেদন জানাই এই ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারটির শ্রীবৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে তার সংস্কার-সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হউক। ভাষামাসে আজ আমার এটুকুই নিবেদন। আশাকরি আমার এই নিবেদনটি সরকারের নজরে পড়বে – যথাযথ উদ্যোগ গৃহিত হবে ও আরেকটি ইচ্ছেপূরণ শুধু আমার নয় – শহর কুমিল্লার সকল পাঠপ্রিয় মানুষদের ইচ্ছাপূরণ হবে।

১৪২১ বঙ্গাব্দ।।
২০১৫ সাল।।