বিশ্বের এক নম্বর টেনিস তারকার স্বেচ্ছাচারিতা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 18 Feb 2012, 05:32 PM
Updated : 17 Jan 2022, 05:44 AM

তিনি বিশ্বের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড়। টেনিসের বিভিন্ন শিরোপা জিতে যিনি কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তিনি কোভিডসংক্রান্ত নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলে তার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি আদালতেও গিয়েছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আদালত থেকেও তিনি তার স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষে সমর্থন পাননি। মামলায় হেরে গেছেন। বলছিলাম বিশ্বের অন্যতম সেরা টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচের কথা। করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা এবং স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অভিযোগে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার মুখে বাধার মুখে পড়েন ২০টি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ী সার্বিয়ান টেনিস তারকা জোকোভিচ। গত সপ্তাহে তার ভিসা বাতিল করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলা চলছিল। শেষ পর্যন্ত আদালত তার ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। আইনি লড়াইয়ে হারের পরে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি আগামী তিন বছর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা না রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

জোকোভিচের এই ঘটনাটি দুনিয়া জুড়ে আলোচিত হচ্ছে। অনেকে এটাকে 'ব্যক্তিগত অভিরুচি' হিসেবে বর্ণনা করে 'ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ' বলছেন। ঘটনাটিকে 'রাষ্ট্রীয় বাড়াবাড়ি' হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন মন্ত্রী অ্যালেক্স হক অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, 'দেশের সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ জোকোভিচকে অস্ট্রেলিয়ায় আসার অনুমতি দিলে গোটা দেশে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। কারণ অনেকেই আর করোনা প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে চাইতেন না। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।'

জোকোভিচ যা করেছেন, তেমন কাণ্ড অবশ্য দুনিয়াজুড়ে অনেকেই করছেন। মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্য খেয়াল বাসা বেঁধেছে। স্বজনের মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়েও কোভিড বিধি পালন করতে অনেকে নারাজ। মাস্ক পরার ক্ষেত্রেও অনেকের ঘোরতর আপত্তি আছে। করোনা টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনীহা লক্ষ করা যায়। এটা শুধু সংস্কারপ্রিয় ধর্মপ্রাণ কিংবা ভীতু জনগোষ্ঠীর আচরণ নয়, শিক্ষিত সচেতন মানুষের মধ্যেও এ প্রবণতাগুলো রয়েছে। অনেকে এটাকে দেখছেন ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে।

লকডাউন, বিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা, সবাইকে বাধ্যতামূলক টিকাকরণ ইত্যাদির ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঠিক কতটা নাগরিককে জোর করতে পারে? প্রাত্যহিকতায় কতটুকু হস্তক্ষেপ করতে পারে? পাশপাশি এ প্রশ্নও উঠছে যে, এক নাগরিক মাস্ক না পরে যদি আর এক নাগরিকের সংক্রমণের কারণ হয়ে ওঠে, তা হলে কোন নাগরিকের স্বার্থ দেখবে রাষ্ট্র? যে কারণ তার, না যে আক্রান্ত, তার? যে বা যারা সংক্রমণ ছড়ানোর দোষে দুষ্ট তাকে বা তাদের ঠেকাতে প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণের। আর সেই নিয়ন্ত্রণ সার্বিক। ফলে যে নিয়ম মানতে রাজি, তাকেও সেই নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। একজন দোষ করবে আর সেই দোষের শাস্তি ভোগ করতে হবে যে দোষী নয় তাকেও! এ কেমন বিচার?

আলোচনার পথে হেঁটে এই প্রশ্নের দিশা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ, এ জাতীয় যুক্তির লড়াইয়ে ঢিল ছোড়াছুড়ির বাইরে কোনও নির্দিষ্ট এবং কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যে যায় না, তা আমাদের অভিজ্ঞতাই স্পষ্ট করে দিয়েছে। আসলে শুধু ব্যক্তিগত অভিরুচি কিংবা স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সব বিপদ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নিয়ম মানতে হবে। বিশ্বজুড়ে করোনার সংক্রমণের চরিত্র একই। আর সেই জায়গা থেকে বিশ্বজুড়েই করোনার লড়াইয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মত নিয়ে সব দেশই একই রকম বিধিনিষেধের পথে হাঁটছে। তাতে সাময়িক স্বস্তি মিললেও বিধিনিষেধ পালনের ক্ষেত্রে সমাজ জুড়েই একই ক্লান্তি এবং অনীহা। সে বাংলাদেশ হোক বা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হোক বা বা অন্য কোনও দেশ। তা হলে সমস্যাটা কোথায়? মানুষ কেন এত এত প্রিয়জন হারিয়েও কোভিড বিধি মানতে নারাজ?

এখানেই বিস্ময়। জটিল মনস্তত্ব। স্বাধীনতা পেয়ে গেলে নাকি কিছু মানুষ পারাধীন হতে ভালোবাসে। আবার কিছু মানুষ আছে যারা স্বেচ্ছাচারী হতে পছন্দ করে। এমনকি জোকোভিচের মতো সেলিব্রিটি হলেও। তবে নিয়ম না মানা বা স্বেচ্ছাচারিতার বিপদ আছে। বিশেষত সেলিব্রেটিদের। কোনো বিখ্যাত তারকা যদি স্বয়ং অনিয়মকে নিয়ম মনে করেন, তবে তার অনুরাগীরা কী শিক্ষা নেবেন? বিশ্বের এক নম্বর পুরুষ টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচ সেই নিয়ম ভাঙবার দলে।

অস্ট্রেলিয়ান সরকার তার ভিসা বাতিল করেছে কারণ, তিনি কোভিডের প্রতিষেধক নেননি এবং সীমান্ত বিভাগকে জমা দেওয়া নথিপত্রে ভুল তথ্য দিয়েছেন। উল্লেখ্য, কোভিড সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি না মানবার উদাহরণ জোকোভিচের ক্ষেত্রে এটাই প্রথম নয়। এর আগে সে কোভিড আক্রান্ত হয়েও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, মাস্কহীন অবস্থায় ছবিও তুলেছেন। অর্থাৎ, মহামারীর স্বাস্থ্যবিধি তিনি বরাবরই অবজ্ঞা করেছেন। তার মতো মহাতারকার কাছে যা একেবারেই অনভিপ্রেত। তার মতো টেনিস তারকা, যিনি বিশ্বের অগণিত ক্রীড়াপ্রেমীর চোখের মণি, তার পক্ষে কি এমন দায়িত্বহীন আচরণ মানায়? তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোভিডের টিকা গ্রহণের পক্ষপাতী নন এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। কিন্তু টিকা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মত যাই হোক, প্রসঙ্গ যখন জনস্বাস্থ্য, তখন নিজস্ব মত এবং বিশ্বাসে অটল থাকা স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। তার জানা উচিত ছিল মাঠে নামবার পর একজন খেলোয়াড় শুধু ব্যক্তিগত রেকর্ডের জন্য খেলেন না, খেলেন নিজ দেশের জন্যও, তার উপর আস্থা রাখা অনুগামীদের জন্যও। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং প্রতিষেধক গ্রহণের বিষয়টি অনেকাংশে তাই। এই সহজ কথাটি ভুলে যাওয়া কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় নয়, এক ধরনের ঔদ্ধত্যও। এ ধরনের ঔদ্ধত্য সামাজিক স্থিতির জন্য মোটেও সহায়ক নয়।

জোকোভিচ যা করেছেন, তা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে থেকে করেননি। তিনি করোনায় আক্রান্তদের বাঁচাতে কিংবা করোনার নামে যারা ব্যবসা করছে, রাতরাতি ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিদ্রোহ করেননি। তিনি যা করেছেন তা ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে, রীতিমতো গোয়ার্তুমি। অপরিণামদর্শী আচরণ।

মহামারী এখনও পুরো বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫৬ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন তো শিকারী কুকুরের মতো মানুষকে তাড়া করে ফিরছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এখনও বহু মানুষ টিকা পায়নি। টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ও সম্পূর্ণ কাটেনি। এ অবস্থায় জোকোভিচের মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের অগ্রসর হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। তার মতো মানুষের উদাহরণ আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে টিকা নিতে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ ভাবে মেনে চলতে। বিভিন্ন দেশে তারকাদের জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত সরকারি প্রচারকাজে যুক্ত করবার এটাই কারণ। কিন্তু তিনি সেই পথে তো হাঁটলেনই না, উপরন্তু এমন উদাহরণ তৈরি করলেন, যে পথে যদি তার অনুগামীরাও হাঁটতে চান, তাহলে এই মহামারী হয়তো কোনও দিনই শেষ হবে না।

ঠিক এই কারণেই তার অস্ট্রেলিয়া পৌঁছানো নিয়ে সেখানকার নাগরিকদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা এর আগে দীর্ঘ লকডাউন দেখেছেন, কড়া কোভিডবিধি মানতে বাধ্য হয়েছেন, রোজগার বন্ধ হতে দেখেছেন। এমতাবস্থায় জোকোভিচকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে তাদের এত দিনের সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে পড়ত। তিনি নিজ স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে পারেন, কিন্তু অন্যের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না। বড় খেলোয়ার হলেই যে বড় মানুষ হয় না, তা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন।

দায়িত্বশীলতা, মানবিক অনুভূতি ও সমানুভূতির মাপকাঠিতে তিনি অনেক নিচে নেমে গেলেন। আমরা কেউই যেন জোকোভিচের মতো স্বেচ্ছাচারী না হই, সেই শিক্ষাটা যেমন নিতে হবে, পাশাপাশি নিয়ম সবার জন্য সমান, সে মহাতারকাই হোক, আর বিশেষ অতিথিই হোক, অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করাও জরুরি।