বাংলাজানালা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 20 Feb 2012, 08:30 AM
Updated : 20 Feb 2012, 08:30 AM

সে এক জীবন এসেছি ফেলে বিষম তাজা আলোর গন্ধে ভাসা। ভোরের আলোরেখা জানলাতল ভাসিয়ে আছড়ে পড়তো আমাদের উঠোনে। বাতাসে অমল সোঁদা গন্ধ বাংলার। জেগে উঠেই তড়িঘড়ি ছুটতাম আমরা বোনেরা শিউলিতল থেকে পাশের বকুল তলায়। আমাদের আঁচলভর্তি ফুলের গন্ধ যেন জানান দিতো কবিগুরুর গানের ভাষায় –

বাংলার মাটি বাংলার জল / বাংলার বায়ু বাংলার ফল / পূর্ণ হউক পুর্ণ হউক পূণ্য হউক ….

সে জীবন বিষম আনন্দ-স্নেহজলের আন্তরিক গ্রামসুখী জীবনধারার সনাতন উতস-ঐতিহ্যের চিহ্নে ঝলমল করতো। পড়শিরা পরস্পরের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতো হৃদয়গত তাগিদে। আমাদের অন্তর আদতেই কলুষমুক্ত ছিলো। আদ্যন্ত সহজিয়া এক জীবন্ত চলচ্চিত্রসম খোলা-জানালাসম জবা-যুঁই-ভুঁইচাঁপা-শিউলি-বকুল-চাঁপা-চামেলির মউ-মউ গন্ধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়তো ফল-ফসলের ধানী গন্ধের দিনরাত্রি। যেন সে গানের পঙক্তি –

এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী / ফুলে ও ফসলে কাদামাটিজলে ঝলোমলো করে লাবণী

আজ তার সবই অতীতের রূপকথাময় হাতছানির জয়বার্তা হয়ে ঝরে কীবোর্ডে / খাতার পাতায় / কবিতায় / নাটকে / গল্পে অথবা উপন্যাসে। আজও ফুল-ফল-ফসল কিছুরই অভাব নেই বটে, কেবল খোয়া গেছে অামাদের সে অমল গন্ধের জানালাটা।

আজ জানালাভর্তি কেবলই জঙ লাগা কবেকার জলছবিদের গন্ধমালা। জমাট ধূলো-জঞ্জাল ভেদ করে তারা আর আগের মতো ঝলমলিয়ে উঠতে পারেনা কিছুতেই। বিশেষ-বিশেষ দিবস এলে জানালা ধুয়ে-মুছে সাফ-সুতরো করে অতীত ঐতিহ্যকে প্রাণান্ত ফেরত পাবার জন্য উঠেপড়ে লেগে যাই। কিছুটা হয়তো বা পাই। কিছু তার হৃত কালের রূপকথা হয়েই জ্বলে পুরনো জানালায়। তাকেই উতসর্গ করি প্রিয় বাংলায় যেন একান্ত স্বপ্নাঞ্জলি –

বাতাসের মুখ দেখে ভাবলাম
আজ তার মুড নেই।
আজ তার ধূলোদিন।
অথচ ঘটলো কি না একদম অপজিট।
বলা যায় প্রায় মেঘ না চাইতে বৃষ্টির রিমঝিম।
ভাবলাম তবে যাই। যাই তবে।

আহ যতদূর, সবটাই দৃষ্টিসুখ, সনাতন থিম।
থিম মানে অমলিন মেঘরথে ওড়ার অফার।
যদিও যোজনদূর ছবি ও রোদ্দুর।
ছবি মানে স্মৃতিদের হিম।
ছবি মানে শিখাতুর ভালোবাসাদিন।

ছবি মানে আবারও আনন্দনের সূর্য হাড়পাঁজরায় বেজে ওঠা ঠিক।
যেন সে আমার দেশ
যেন সে আমার বাঁশিপানা মাগো –
' কি শোভা কি ছায়াগো কি স্নেহ কি মায়াগো '।
তখনইতো পথ ভরে যায় শ্যামগন্ধে
চোখ ভরে যায় রূপে।
তখনইতো হাত ভরে যায়
পত্রালিকায়, পা ভরে যায় ধূপে।

এবঙ ধারনাতীত সব চিত্রকল্পে
বাতাসের সঙ্গে ভাব জমে।
ভাবি, আজ তবে জানালাই দেশ।
আজ তবে গান হোক বেশ।
কাল আবার কি হয়, কি আপদ –
হয়তো বা যা ভাবা তা নয় মোটেও।
একদম সারপ্রাইজিংলি গান- ই
এসে হাজির চাতালে !
অন্যরকম স্টাইলে ধুমতানানাও ফোটে !
গানগুলি কে ভুলতে পারে কে তাহারে ভোলে!
লতাগুল্মে জড়িয়ে তা নতুন পাতায় জ্বলে !

সেইতো নতুন স্বপ্নযাত্রা সেইতো সবুজ বাংলা
বাতাসের সঙ্গে যার চিরকালের সখ্যতা।
এবঙ জানালা ? কি কথা সে বলে ?
কি গান বাতাসে ? কি গান বাতাসে ?

ভাবামাত্র রক্ত গায় –
' আমার সোনার বাংলা '
স্বপ্নজালে রক্তধারা ভাসে।
স্বপ্নজালে রক্তধারা ভাসে।
স্বপ্নজালে রক্তধারা ভাসে।

( আমার লেখা 'নুরুন্নাহার শিরীন এর দেশজ কবিতা বইয়ের প্রথম কবিতা )

এইতো আজ রাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছোঁয়ামাত্র প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেজে উঠবে –
' আমার ভায়ের রক্তে
রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী / আমি কি ভুলিতে পারি '
এ যে বাংলাদেশের হৃদয় জাগানো রক্তজলের গান। যে গান প্রজন্মকে জানান দেয় –
ওঠো, জাগো, অহঙ্কারের বাংলা ভাষায় গর্জে ওঠো, ভালোবাসো আর অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।

একুশ তার ৬২তম বর্ষে দাঁড়িয়ে পালন করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ গর্ব নিশ্চয় আমাদের সবার। এই গর্ব আমরা যেন হৃদয় থেকে হৃদয়ে চারিয়ে দিই অতন্দ্র শিকড়ের গভীর ছুঁয়ে শিখরপানে। যেখানে নাক্ষত্রিক বোধনে অন্তর জারিত হয় শুদ্ধতম আলোয়। পৃথিবীর বিদ্বেষবিষ ধুয়ে যায় নতুন অন্তর্জালে। বাংলা মা আমাদের সেই আশীর্বাদ দিন আজ আমার প্রার্থনা কেবল এই অাজিকে।

২০ ফেব্রুয়ারী। ২০১৪ ইং।