আজ বীরাঙ্গনা দিবস

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 26 Feb 2012, 11:46 AM
Updated : 26 Feb 2012, 11:46 AM

১৯৭২ এ বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাবনার বেড়া, সুজানগর, সাঁথিয়ার ফসলি জমিন যমুনার প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য নগরবাড়ি ঘাট থেকে কাজীরহাট বাঁধ নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে নিজ হাতে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে টুকরি ভরে বাঁধ এর জন্য খননকৃত স্থানে ফেলেছেন। তারপর মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাত জনসমাবেশ ঠেলে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছাতে চাওয়া কজন নারী বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো আয়োজক কমিটি সেবকদের দ্বারা আর সেদিকেই বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়ায় তিনি তক্ষুণি মাইকে নির্দেশ দেন –
' ওদের আসতে দাও ' – বলে। আঁচলে চোখ মুছতে-মুছতে বঙ্গবন্ধুর কাছে মঞ্চে নতজানু হয়ে বসে তারা শোনায় আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের যোগসাজশে পাকবাহিনীর হাতে তাদের চরম লাঞ্ছিত হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনী। শুনে বাকরুদ্ধ প্রায় বঙ্গবন্ধু তখনই ঘোষণা দেন – ' আজ থেকে পাকবাহিনী নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয় তারা আজ থেকেই বীরাঙ্গনা খেতাব এ ভূষিত। '

সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন – ' দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবেনা। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সন্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে বলছি যে আপনারাও ধন্য। কেননা এমন ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা কন্যার পিতা হয়েছেন। '

আজ বঙ্গবন্ধু নেই। পিতৃহীন জাতি চল্লিশ বর্ষের অনেক অপালন অনেক অন্যায় বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ইতিহাসের গৌরবজনক শিক্ষাবঞ্চিত বলা যায়। তাইতো আজও আমরা জানিইনা এদেশে কতজন বীরাঙ্গনা মা-বোন এর মৃত্যু হয়েছে, কতজন তলিয়ে গেছে আত্মমর্যাদার অভাবে। শিকার হয়েছে ধর্মান্ধতার-অশিক্ষা-কুশিক্ষার-অপমানিত জীবন-জীবিকার অনলে। খুব মুষ্টিমেয় ক'জন এর নামই কেবল হয়তো বীরাঙ্গনার তালিকাভুক্ত হয়েছে। অগণিত বীরাঙ্গনারা রয়ে গেছেন অজানিত। সাহসী বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে এমন নামটি একটিই মনে আসছে এ মুহূর্তে – আর কেউ আছেন কি না জানা নেই, তিনি স্বশিক্ষিত শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী।

আজকের দিনে আমার নিজের একটি কবিতা উপস্থাপন করছি মহান বীরাঙ্গনাদের জন্য। শিরোনাম –

স্মৃতির কসম
*************
প্রিয় জয়, তুমিতো জানোই আজ আর সেই সহজিয়া কাল নেই। সহজে আসেনা
তুচ্ছ লিপিকাও। হাওয়ায় কৃষ্ণ
মেঘগুলোকে পুড়তে দেখে পোড়া চোখ
যেই ভেবেছে আসছে বৃষ্টি
অন্তহীন খরায় হৃদয়মাটি ফেটে চৌচির। সমস্ত ধুধু ফাটলের মধ্য থেকে
আকুল মৃতের হাড় স্মৃতিতে জানান দিচ্ছে – 'পুড়ছি আমরাও আমাদের
কালেও তেতেই ছিলো পথ।
কেবল তোমাকে পাবার কালে
হুহু ভিজে উঠতো সে
আমরাও জয়বাংলা বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি
মৃত্যু পরোয়া না করে।
আজ আর ভেজে না সে
সন্ত্রাসী নিঃশ্বাসে পুড়ছে সে।
খুনে-সন্ত্রাসীরা দাঁত বসিয়েছে
মায়ের উঠোনে।
উঠোনের ঘাস রক্তভারে থমথমে।

প্রিয় জয়, তুমিতো জানোই
এইখানে কত বেয়নেট কত গুলির উল্লাসে
কত হৃদি ভেসে গেছে
কত মা-বোন প্রেমিকা
পিশাচের সঙ্গী হয়েছে তোমাকে পেতে।
আজও সহজখাকি হৃদয়খাকি খুনের দাপটে পোড়াচোখে দ্রোহের আগুন।
আজও তোমার পেতে
কোটি হৃদি যুদ্ধে যেতে পারে।
প্রিয় জয়, তুমিতো জানোই সাম্প্রদায়িক নয় এদেশের দলিত মানুষ।
পিশাচকে পরাজিত করে এদেশের মেয়ে।
তুমিতো জানোই এই মাটি এই ঘাস-নদী-রক্ত ভোলেনা অতীত।
মনে আছে সব স্মৃতি। মনে আছে সব
মেঘ ও বিস্মৃতি।
মনে আছে বজ্রবাণী।
মনে আছে
উত্তাল তর্জনী।
আমাদের ইতিহাস আমাদের মানচিত্র
সহজে আসেনি।
তাহলে নতুন যুদ্ধে ভয় কি বাঙালি ?
ভয় কি সন্ত্রাসে ?
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জানে
জয় আমাদেরই, জয় আমাদেরই।

প্রিয় জয়, আমরা বীরের জাতি। যদি দিই – বীরাঙ্গনায় বীরের সন্মান যদি বলি –
তোমাদের ত্যাগ বীরের অধিক, তোমরাও
মুক্তিদিদি এইদেশে –
নিশ্চয় তখন গ্লানিমুক্তির বৃষ্টি নাববে অঝোর। নাববে হৃদয়ধারা
উড়বে লিপিকাবালিকারা
শিথানে উড়বে হৃত উপশম
মৃত পাঁজরায় জীবনের ওম –
স্মৃতির কসম, স্মৃতির কসম।

( *নুরুন্নাহার শিরীন এর নির্বাচিত দেশজ কবিতা, পৃষ্ঠা ১৭ *)

লক্ষ আত্মত্যাগের জ্বলন্ত স্মৃতির জলছবি হৃদয়ে জখমিত মেঘের মতো লুকিয়ে যারা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার অনন্য অংশী আজ আমার হাজার সালাম হাজার প্রণতি নাম না জানা সহস্র বীরাঙ্গনা মা-বোনের স্মৃতির প্রতি।

***
ডিসেম্বর। ২০১৪ ইং।