৩১শে মার্চ, সেদিন গাঁ ছেড়ে পালিয়ে এলো হাসু-র মা

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 31 March 2012, 01:39 PM
Updated : 31 March 2012, 01:39 PM

একাত্তুরের ৩১ শে মার্চ সেদিন। যথারীতি চারপাশের বাতাসে গুমোট। বাবা সুযোগ পেলেই – 'আসছি' – বলে আশপাশের খবর জানতে বেরুচ্ছেন। এবঙ খুব চেষ্টাও করছেন অসীমাদি'-মৃদুলাদি'-দের সীমান্ত পেরুবার বন্দোবস্তের জন্য। তাদের জন্য কালো বোরখা রেডি করা আছে। তারাও রেডি কখন বাবা তাদের ওপারে যাবার পথ করে দেবেন সে আশায়। আমরা সেদিন বসেছি বাগানের পিছনে বড়ইতলায়। খসে পড়া বড়ই নুন-মরিচ সহযোগে সবাই মিলে খাচ্ছি, খানিক স্বস্তি-র তরেই বুঝি। যদিও সবারই অন্তর জানে আমরা পার করছি অজানিত শঙ্কার দিন। জানিনা মুহূর্তেই কি-জানি-কি ঘটে যায়। কি আপদ না আসে এই ভয়েই আদতে আমরা রকাঁটাবিদ্ধ তখন সারাক্ষণই। তো, বিকেলের আলোম্লান বাগানে বসেই আমরা শুনি – গেইটে কে যেন – ' ও আম্মা গেইট খোলেন, আমি-আমি আমি আইছি ' – বলে। আমিই প্রথম বুঝি যে – আরে ! এতো আমাদের হাসু-র মা খালার গলা ! বাবার নিষেধ ভুলেই দৌড়ে গেইট খুলি। দেখি – বোরখা পরা হাসু-র মা খালার ধূলিধূসর বিপর্যস্ত অবস্থা। হাত ধরে টেনে ঢোকাই তারে। তাড়াতাড়ি গেইট বন্ধ করি। হাত ধরেই নিয়ে যাই ঘরে। সে কাঁপছে-কাঁদছে বিরামহীন। মা-র ঘরেই নিয়ে যাই। হাসু-র মা খালা মেঝেতেই বসে বিনবিনিয়ে বিলাপের মতো কিছু বলেন, আবার কান্নার দমকের তোড়ে ভেসে যান। আমরা কেউ কিছুই না বলে সময় দিই সে যেন কেঁদেই কিঞ্চিত হাল্কা হউক আগে।

ঘন্টা খানেক পরে খানিক ধাতস্থ হয়ে হাসুর-মা খালা মা-র নির্দেশে গোসল সারেন। আমি থালায় ভাত-তরকারী এনে তার সামনে দিই – "ও আম্মা, আমি আমার হাসুরে ফালায়া এই ভাত ক্যামনে খাই " – বলেই আমায় জড়িয়ে আবারও কান্না। আমরা পরে হাসুর মা খালা একটু ধাতস্ত হবার পর জানতে পাই – কি ভয়ঙ্কর জান্তব-লেলিহান আগুনে পুড়ে গেছে হাসু-র মা খালার গোটা গ্রাম। ২৫ মার্চ-এর ঠিক দুদিন আগে হাসু-র মা খালা সাত দিনের ছুটি নিয়ে মেয়েকে দেখে আসতে গাঁয়ে যায়। মিয়াবাজার সীমান্তবর্তী এক গাঁয়ে সে তার মেয়েকে নানীর হেফাযতে রেখে আমাদের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়েই মেয়েকে গাঁয়ের স্কুলে পড়ায়। আমি আমার সাধ্যমত বই-খাতার যোগান দিতাম। সেবারও টাকা-বইখাতা-কাপড় নিয়ে গাঁয়ে মেয়ের সঙ্গে কাটাচ্ছিলো আনন্দদিন। সেইসময় সেই গাঁয়েও খবর এসেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা শেখমুজিবকে ধরে নিয়ে গেছে আর ঢাকাকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামসুদ্ধো মানুষ মহাচিন্তিত। হাসু-র মা খালাও চিন্তায় পড়ে আমরা ক্যামন আছি ভেবে। গ্রামেও রোজই খবর এসে যেতো দেশের কোথায়-কোথায় পাকিস্তানী সৈন্য আক্রমণ চালাচ্ছে। আবার দলে-দলে যে মুক্তিযোদ্ধারাও সীমান্ত পেরুচ্ছে, যুদ্ধে যাচ্ছে সেই খবরও আসতো। সেইদিন হঠাত গ্রামে খবর আসে মিয়াবাজার সীমান্ত দিয়ে যে লোকজন ভারত পাড়ি দিচ্ছে বিশেষত হিন্দুরা আর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈন্যরা সেই খবর পেয়েই আসছে, গ্রামের মানুষ যেন তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে পালায়। কিন্তু কোথায় পালাবে তারা ? ভেবে দিশেহারা সবাই। অই ভাবার মধ্যেই হঠাত মসজিদ-এর হুজুর নির্দেশ দিলেন – ' পালাও-পালাও মিলিটারী আসছে ' বলে। ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামের মানুষ হতভম্ব হয়েই যে যেভাবে পারে ছুটেছে, হাসু-র মা খালা স্বভাবতই একটু বোকা ধরণের ছিলো, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই মা-মেয়ে-বোঁচকা-বেঁধে ছুটতে গিয়ে ছুটন্ত মানুষের চাপে, কখন যে হাতছাড়া হয়েছে মা ও মেয়ে – ভালো করে বুঝার আগেই হাসু-র মা খালা নিজেকে দেখে – গাঁয়ের হাওড় পেরুনো কাঁটাঝোপে। আর সারি-সারি মিলিটারী জীপ থেকে লাফিয়ে নাবছে তাগড়া বুটধারী সৈন্যরা। তারা সেদিন গ্রামের নিরীহ লোকজনদের যাকেই সামনে পেয়েছে গুলি করেছে। আর সুন্দরী মেয়েদের টেনে-হিঁচড়ে জীপে তুলেছে। তারপর যাবার কালে – গ্রামের ঘরবাড়িতে কামানের গোলা ছুঁড়ে লেলিহান আগুনে পুড়িয়েছে। হাসু-র মা খালা সারারাত অই কাঁটাঝোপেই কাটিয়েছে। মিলিটারীরা গ্রাম ছেড়েছে কি না বুঝতে না পেরেও দিনের আলো ফোটার পরে মা-মেয়ের খোঁজে দগ্ধ গ্রামের ধিকিধিকি আগুন মাড়িয়েই স্তব্ধবাক-মানুষহীন-ধংসের মধ্য থেকে রক্তপোড়া গুলিবিদ্ধ লাশের মধ্য থেকে তার মেয়ের মা ডাক শুনতে পোড়া ঘরবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরেছে নির্ভয়ে …. কোথাও কোনও জন-মনিষ্যির বেঁচে থাকার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে না পেয়েও কাঁদেনি ! হৃদয় পাথরসম তখন …. অবশেষে – আমাদেরই কাছে ফেরার তাড়নায় দু'ঘন্টারর পথ চব্বিশ ঘন্টায় অনেক ঘুরপথে পেরিয়ে তবে পৌঁচেছে। আর আমার হাত ধরার পরেই – তার বুকভাঙা কান্নার পালা …. আমরা তার সেই কান্নার সঙ্গী / সাক্ষীমাত্র।

হাসু-র মা খালার মুখে শোনা সেই সময় সেই জ্বলন্ত-পুড়ন্ত-ছুটন্ত-গুলিবিদ্ধ-রক্তপোড়া গাঁয়ের হতবাক জলছবি তুলে ধরতে চেয়েছি আমার পঙক্তিতে –

সেদিন একটি গ্রাম তার সহজ জীবন ফেলে
জ্বলন্ত-পুড়ন্ত-ছুটন্ত গ্রামবাসিকে অসহায়
কঠিনে দিয়েছে ঠেলে !
কত হাসু-হরিপদ-হরিদাসী ছেড়েছে সাধের ঘরদোর তাদের কতটা জানি আমরা নিতান্ত স্বার্থপর !!

তবুও ঘৃণায় জ্বলি
বাংলার অগণিত হাসু-হরিপদ-হরিদাসীদের মারবার দৃশ্য মনে এলে।
আমি যেন না দেখেও দেখি
সেই দগ্ধ সময়, জান্তব ধকধকে
হাসু-র মা খালার গ্রামের ছবি –
এই বাংলা ছাড়া কোথাও কোনও ঠাঁই
ছিলোনা যাদের –
তাদের হঠাৎ কামানের গোলার আগুনে হারিয়ে গেলো সবই !!

আমি না শুনেও শুনি – মসজিদের হুজুর হেঁকে উঠেই বলেন –
পালাও-পালাও ….
মিলিটারি আসছে …. হাজার গ্রামবাসি
দিগবিদিক দৌড়ুচ্ছে ….
কিছু না বুঝেই হরিপদ-হরিদাসী
তাদের কন্যাকে নিয়ে
উঠোনে পা …. সগর্জনে মিলিটারি ট্রাক
ঢুকলো যমের মতো, কালো-কালো বুটের ধাক্কায় চৌচির জমিন, ধূলোরা মুহূর্তে লাল !!
অজস্র গুলিতে লাশ হয়ে গেছে
হরিপদ-হরিদাসী।
সঙ্গে পালাতে না পারা আরও অনেক গ্রামবাসী।
দীপালিকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে ক্যাম্পে – আমাদের হাসুও কি …
ভাবতে পারিনা আর।
কিন্তু জানি, সেদিন অনেক হাসু ও দীপালি-র আর্তনাদে
বাতাস কেঁদেছে।

আজ কি আমরা তাহাদের জন্য একটুও কাঁদবোনা ?
আজ কি আমরা অই পশুদের বিচারের জন্য ফুঁসে উঠবোনা ?

জানুয়ারী। ২০১৫ সাল।
১৪২১ বঙ্গাব্দ।।