সেদিন ১০ এপ্রিল আমাদের বাড়িতে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 16 April 2012, 03:03 AM
Updated : 16 April 2012, 03:03 AM

আজও খুব মনে আছে সেদিন সকাল থেকেই মায়ের শরীর বেশ খারাপ। বাবা ডাক্তার যোবাইদা হান্নান-এর বাড়ি গেছেন। ডাক্তার হলেও তিনি আবার আমাদের প্রিয় খালাও। বাবার সঙ্গেই চলে এলেন আমাদের বাড়ি। মায়ের অবস্থা দেখেই ডেকে আনলেন অভিজ্ঞ নার্স সায়েরা খাতুনকে। নির্দেশ দিয়ে গেলেন সায়েরা নার্স যেন মায়ের সার্বক্ষণিক টেক-কেয়ার করে এবঙ তেমন সমস্যা মনে হলেই যেন তাঁকে সঙ্গে-সঙ্গেই ফোন দেয়া হয়। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দিয়েও গেলেন।

মা সায়েরা নার্সের জিম্মায়। হাসুর মা খালাও সারাক্ষণ মায়ের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখছেন। আমরা ও বাবা চিন্তিত মুখে বসে আছি কখন কি হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়, হঠাত সমস্ত নির্জন খানখান করে ' ওঁয়াওঁ ' কান্নায় আমরা বিচলিত হয়ে উঠি। বাবাও। দু'চার মিনিট-এর মধ্যেই হাসুর মা খালা একগাল হাসির সঙ্গে জানান দিলো ' ও মিয়া ভাই, ও আম্মা, আমরার সোন্দর এক মানিক আইছেগো ' ! বাবা ও আমরাও আনন্দে শুধোই একই সঙ্গে ' মা ভালো আছেতো ' ! হাসুর মা খালা জানায় ' মা ভালো আছে, কোনও চিন্তা নাই '। শুনে আমরা শুকরিয়া আদায় করি আল্লাহ-র কাছে। আর বাবা ফোন করতে ছোটেন ডাক্তার খালাকে।

বাবা ফিরলে আমরা সবাই একে-একে মায়ের ঘরে যাই, দেখি কি আশ্চর্য উজ্জ্বল ফুটফুটে আমাদের সবচে' ছোটভাই মায়ের পাশে শুয়ে ! অই দুর্দিনে জন্ম নেয়া ভাইটি আমাদের যেন এক নতুন দিনের আশার আলো ছড়িয়ে দিলো। আমার মন বল্লোঃ আসছে জয়, আসছে জয়। আর কি জানি কি ভেবে আমার মনে এলো একটি নাম ভায়ের জন্য ' সুজন '। মনে আসা মাত্রই বলেও ফেললাম ' বাবা, ওর নাম সুজন রাখি ' ! মা যেন একটু হাসলেন, আর বাবা বললেন ' বাহ, বেশ, তবে তোদের নাম সুজন-ই হউক ' !

সেদিন থেকেই সে সুজন নামে বেশ পটপটিয়ে তাকাতে লাগলো। তার স্বল্প বড় সুমন, সুমন-সুজন দুই ভাই পিঠেপিঠি প্রায় আমাদের পুরো পাড়ায় পরিচিতি পেলো এমনই, আজ তাদের দুজনেই ' ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো '-র মতোন অবস্থায় ! সুমন সেই ছোট্টকাল থেকেই যা শোনে যা পড়ে ঠোটস্থ-কন্ঠস্থ করতে ওস্তাদ বলা যায় ! এস-এস-সি-র পাঠ শেষ হতে না হতেই চৌকস আবৃত্তিকার-সংগঠক হয়ে ওঠে। আজও সেই তার সবচে' প্রিয় নেশা। মা-বাবা তার নেশার আতিশয্যে অতিষ্ঠ-তিক্ত হয়েছেন কত যে তার কোনও লেখাজোখা নেই। আর সুজন বেশ সজ্জন ভবঘুরের দলে বলা যায়। মা-বাবা বেঁচে থাকতেই সবাই মিলে তাকে একবার মালয়শিয়া-র কে-এফ-সি-তে চাকরী-র ব্যবস্থা করে পাঠানো হলো, তো, বছর তিনেক কোনওমতে কাটিয়ে চুক্তি শেষ করেই আবার স্বস্থানে, মানে, পৈত্রিক বাড়িটিতে বাবার অন্ন খেয়ে পরোপকারের পাকাপাকি বন্দোবস্তে। দুজনেরই ফুটফুটে দুই কন্যাও আজ আমাদের প্রিয়মুখের দলে।

যদিও আজ মা-বাবাহীন আমরা জাগতিক কারণে যার-যার বৃত্তবন্দী, তবুও মাঝে-মাঝে বাবার বাড়িটিতে সবাই মিলি, সবকিছু কি যে মনে পড়ে যায় ! গাছগাছালির অনেকই ঝড়ে কি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কাটা পড়েছে। পেয়ারাতল-নেবুতল-বড়ইতল-লিচুতল কিছুই নেই আর। হারিয়ে গেছে নিম-এর চিরল ছায়াও। কেবল মায়ের হাতের সুপারির সারি আজও আছে যথাযথ। আছে বাবার হাতের অজস্র পাতাবাহারের সারি। বছরে একবার অন্ততঃ যাই বাবার বাড়ি। চুপচাপ টানা বারান্দায় বসি, মনের চোখে দেখি মা-বাবার সাধের বাড়ি-বাগান-এর শ্রীহীন স্তব্ধতার গন্ধ আর সেদিনকার শ্রীমন্ডিত জলছবিদের অশরীরি চলাচল-ফিসফাস-ছমছমে-অপরূপ চিত্রকলা …. আজ অইটুকুই আমার অনেক পাওয়া।

আমার ' বাড়ি ও বাবা ' শিরোনাম-এর পঙক্তিমালা নিবেদন করছিঃ

বেদনারা যায় কত কি আপন্নতায় ….
বিপর্যয়ে …. হাহাকারমানতায়।
বাবা ও বাড়ির ছায়া তবু বড়ো সত্যবদ্ধ দায় ….
আদ্যোপান্ত শিশুকাল মনে পড়ে যায়।

যে কোনও বিভাসায় কি ব্যাপ্ত শিকড়প্রবণতায়
বাবা বলতেই বুঝি বাড়ি আর বাড়ি বলতেই বাবা।
বুঝি অবাঙ স্বভাবে বাড়ি বোঝে বাবার স্বভাব।
বড়ো ঝাড়ন বাতিক তাঁর, রোজ ঝাড়পোছ
বাড়ির সীমানা-ত্রিসীমানা। আমাদেরও দুরস্ত বেশ
গা-ধুইয়ে, চুল আঁচড়ে, স্নো ও পাউডারে স্নেহজ প্রশ্রয়ে।
আত্মীয়-পড়শি এলে তুচ্ছাতিতুচ্ছে যজ্ঞ বাধাতেন
কুতর্কের। মা এসবের বাইরে থাকতেন। মৃদুমুখে স্টোভে
সামান্য ব্যাঞ্জন রাঁধতেন অসামান্য করে। বাবা ও সকলে
শংসা করতেন। আমরা নিতাম মজা। মাঝেমাঝে বাবা
মেতে যেতেন বাগানযত্নে। অবেলায় বৃক্ষের শুশ্রূষা দিয়েছেন
নিজের নিয়মে। রুয়েছেন বহুল বিরল চারা। সঙ্গে শান্ত
পাতাবাহারের ঝোপ। মধ্যে বিবিধ কেয়ারি। ফুল ও ফলের।
ভোরে দেখতাম নিমফলে ছেয়ে আছে বাবার বাগান।
সন্ধেকাশে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
উড়তো লিলির গন্ধ। এভাবে বেড়েছি
বিমুগ্ধ বাংলায় …. ক্রমে আয়ুর বাড়ন্ত চক্রে
আজ ছুঁয়েছি ধোঁয়াশা …. ক্রান্তি। এখন সবুজ ধস্ত প্রায়
বাবার বাড়িটি জীর্ণ …. মা-বাবাহীনতায় বসে আছি
একা স্মৃতিবিদ্ধ, দেখি, স্মৃতির বয়েসি বাড়ি থেকে খসে গেছে
বহু কাঠ, বহু ইট, বহুল আনন্দ সমারোহ।
স্বপ্ন ও কান্নাও কিছু কম নয়।
অবিকল প্রিয় বাংলার প্রাগৈতিহাসিক মুখ মনে হয়
অবিকল প্রিয় বাংলার প্রাগৈতিহাসিক মুখ মনে হয়।

২ বৈশাখ ১৪১৯