গোমতী পারের উজান-ভাটায় আজও মন ধায়

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 16 April 2012, 09:53 AM
Updated : 16 April 2012, 09:53 AM

একাত্তুরের যুদ্ধদিনে – তখন দুর্দিন জেনেও বারবার গোমতী পারের উজান-ভাটায় অজান্তে মন ভেসে যেতো বড়ো। তখন দিনগুলি-রাতগুলি গৃহবন্দীর মতো – তবুও মন গোমতিপারে / প্রিয় ধর্মসাগরপারে উড়ে যেতোই যখন-তখন অবকাশের প্রহরে। শত শঙ্কানীল পাকিজান্তার হানার আশঙ্কা নিয়ে আমরা দিনরাত করেছি পার নয়টি মাস। কত না অসহ্য যাতনাময় সেই যুদ্ধদিনের দিনগুলি-রাতগুলি। আজও অশ্রুজলে তাড়িয়ে ফেরে। আজও প্রিয় অনেক মুখ যাদের সনে দেখাও নেই – তাদের কথা বিষম মন জাগায়।

আজ প্রিয় গোমতী নদীটিও দারুণ খরতোয়া নেইতো সেই আগের মতো। কতভাবে কতদিকে কত ভাঙচুর-বর্জ্যে বিষিয়ে গেছে তার এপার-ওপার। অথচ একদিন বড় অমল ছিলো তার দুধার। দেখে দুচোখ জুড়ানো রূপোলি ঢেউ খেলে যেতো হৃদি-মনোহরপুরে। কি তার আশ্চর্য সিম্ফনি – কি তার আশ্চর্য উদাস ছলচ্ছ্বল-কলক্কল ধ্বনি – যে শোনেনি – সে বুঝবেনা কোনওদিনই। অনেক কাল পরে তার কথা ভেবেই লেখা আমার – ' কাগজের ডানা ' কবিতা বইয়ে গোমতি নদীটির কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম। ওই বইয়ের শুরুটি ছিলো চট্টগ্রামে, প্রখ্যাত শিল্পী-প্রকাশক-কবি চট্টগামের সুপরিচিত নাম খালিদ আহসান, তাঁর ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কশপ থেকে সযত্নে প্রকাশ করেন আমার – ' কাগজের ডানা '। বেশ নজরকাড়া প্রচ্ছদ করেছিলেন। অনেকেই শংসা করেছিলেন এবঙ এমন কি বইমেলায় কঠিন স্বভাবখ্যাত প্রয়াত ডঃ হুমায়ুন আজাদ স্যারও পড়ে শংসা করেছিলেন – আজও অই স্মৃতির জলছবি তাড়িত করে আমায়। কাগজের ডানা-র কিছু পঙক্তি এখানে পাঠক-বন্ধুদের জন্য নিবেদন করছি –

প্রিয় মফস্বল, তোমাকে পড়ছে মনে। তুমি কিন্তু
যেমনটি জানতাম, তেমন তেজালো নেই। উপরন্তু
স্মৃতির চে' তুমি ঢের বেড়েছো বাহুল্যে। অথচ আশ্চর্য
এই, আত ডামাডোলেও, তোমার বিপনিতল কত নষ্ট
পদচিহ্নে কেঁপে ওঠে ..কত অন্ধ মনস্তাপে
দুইশো মাইল পোড়ে ..
সে খবর জানেওনা নতুন জনতা।
কাল শুধু জানে কত
ছায়াময় ছিলো আমাদের ঘুম …
ঘুমপাড়ানি হাওয়ায় ঝরতো
স্নেহমুখ …. স্বপ্নিল বিস্ময়ে কি অভিন্ন ছুটতাম ….
মায়া এসে হাত ধরতেই মওসুমী শস্যলে
ভরে উঠতো উঠোন আমাদের।

প্রিয় মফস্বল, তুমিও কি তাহার আকুল গন্ধ পাও ? শিশুতোষ
শিথানের ঘোরে তোমারও কি কান্না মনে পড়ে ? উসখুস
রক্তজলে বুড়ো গোমতীর গান শুনে শৈশবের জন্য
হৃদয় ক্যামন করে ? তবে এসো, এ উদাস তৃষ্ণারথে ….
দ্যাখো, চালশে চর্চায় আজও পড়ন্ত স্বপ্ন ওড়ে প্রিয় বাংলার 'পরে ….
প্রিয় মফস্বল, তুমি বেড়েছো বাহুল্যে, আমি ভেসে যাচ্ছি বাতসল্যে।

( নুরুন্নাহার শিরীন-এর নির্বাচিত দেশজ কবিতা, পৃষ্ঠাঃ ১১ )

এই ভেসে যাওয়া মানে হয়তো অদম্য শিকড়-এর টান। হয়তো অন্যতর বাতসল্যের নাম। তারই জন্য আমৃত্যু এক অপার-উদাস-অভিন্ন উচ্চারণমালা। অনেক আপন্নতা আচ্ছন্ন অপালনে ভরা, তবুও তার পানেই সততঃ হৃদয় সমর্পিত। অবলীলায় যারে বলা যায় অমল দেশপ্রেম। একান্ত আত্মালীন শিকড়জাত এই প্রেমের কথা হতে পারে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের যে কোনও মানব-মানবীর গভীর নদীময় অভিন্ন কথামালা। কেউ লেখে কেউ লেখেনা এইটুকুই তফাত। আজ আমার চাওয়া, আমরা যেন আমাদের অভিন্নতাবোধ ও বোধের শিকড়ে প্রতিনিয়ত জল ঢেলে তারে উজ্জীবিত করার কাজে কার্পণ্য না দেখাই।

আমার প্রিয় নদী গোমতী-র কোনও ছবি আমার সংগ্রহে নেই। আছে কেবল প্রিয় শহর কুমিল্লা-র অপরূপা ধর্মসাগর-এর ছবিটি। সেটিই দিলাম। তারে নিয়েও লিখেছিলাম স্মৃতির কিছু পঙক্তি, তাও আজ এখানে নিবেদন করলাম –

সে এক কৈশোরকাল।
ভেসেছিলাম তুমুল লাল।
বসেছিলাম ধর্মসাগর পারে।
ও প্রিয় শহর ভুলিনি তোমারে।

আজও আশ্চর্য নির্জন পদভারে
তোমার অমল গন্ধ উড়ে আসে এই বয়েসি পথের ধারে।
যেন অতুল বকুলবেলা ডেকে নেয় মনোহরপুরে !
বলেঃ কি গো মনে পড়ে কি বিষম উড়েছি রোদ্দুরে !

আহ কি বিষম পাল্লা দিয়ে ছুটেছি আলোর সনে !
আজও সব-সব-ই অবিকল আছে মনে !
ও ধর্মসাগর ও প্রিয় শহর তুমি যে শিকড়
ভোলা দায় শিকড়ের গান
যোজন কুয়াশাতলে আজও ঠিকই শুনি
তোমার অতুল গান।

জানুয়ারী। ২০১৫ সাল।
১৪২১ বঙ্গাব্দ।।