আজ আমার আনন্দ নির্ঝর …

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 20 April 2012, 12:08 PM
Updated : 20 April 2012, 12:08 PM

বৈশাখী বাতাসে একান্ত অবকাশে চিলতে বারান্দায় দেখছিলাম পড়শির আমগাছের ডালে-ডালে পাতার ফাঁকে অজস্র কাঁচা আমের দোল খাওয়া। দেখামাত্র বিষম মনে পড়ে যাওয়া কৈশোরের নানাবাড়ির আম-জাম-জামরুল-কাঠবাদাম-এর বিশাল সমারোহময় আনন্দদিন বিষম পড়লো মনে। তখন অধীর আগ্রহে গুণতাম কবে আসবে যে কোনও ছুতোয় নানাবাড়িতে যাওয়ার অবাধ বেড়ানোর দিন। ইস্কুল ছুটির সুযোগ আসামাত্র দারুণ খুশিতে ব্যাগ গুছোনো। বাবার রেলের টিকিট কেনা। এবঙ নির্ধারিত দিনে কুমিল্লা রেল স্টেশনে ওয়েটিং রুমে বিস্তর আগ্রহের সঙ্গে মা-ভাই-বোনের সঙ্গ উপভোগ সমেত হরেক লোকজনের হল্লায় মালপত্তর নিয়ে টেনশন। এদিকে প্রায়শই ট্রেন-লেইট-এর ঘোষণা বারংবার গমগমে মাইকে বেজে ওঠা। বাবার ওয়েটিং-রুম-বয়কে ডেকে চা-চপ-কাটলেটের অর্ডার। আহ কি রোমাঞ্চকর প্রহরই না ছিলো ! অাশপাশের নানারকম মানুষের ছোটাছুটির সঙ্গে অদ্ভুত সুরে ফেরিঅলার হাঁক! সে এক মহাযজ্ঞ। যতই দেখি ততই ভালোলাগার বিস্তৃত পটভূমি। কোনও সীমানা না মানা ভাবনার উড়াল – দেখার, শোনার। প্রকৃতির ভিতর রেলের বাজনা মিলে যে সুর তার কোনও তুল্য হয় না। অাবার সকল ভ্রমণযাত্রার ভিতর রেলযাত্রার তুল্য হয় না। দুই মিলেই এক অভূত অানন্দন সে এক।

অবশেষে আমাদের সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উল্কা-এক্সপ্রেস-এর তীব্র সিটি বাজাতে-বাজাতে স্টেশনে আগমন। উত্তেজনায় বুক ঢিপ-ঢিপ। বাবা দাঁড়িয়ে থেকে একে-একে সবার ওঠায় সাহায্য করতেন। কুলিরা দিব্যি কোন ফাঁকে আগেই মালপত্তর নিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়তো। অার সবার শেষে বাবা। উঠেই খুব খেয়াল করে দেখতে থাকতেন অামরা ঠিকঠিক উঠেছি কি না। মালপত্তর সব উঠলো কি না। অত্যন্ত দ্রুত ঘটতো সব মিনিটে যেন। তারপরেই চটজলদি কুলির পাওনা মিটিয়ে আমাদের টিকিট অনুযায়ী নির্ধারিত সিটে বসিয়ে নিজে বসতেন। মাত্র মিনিট তিনের মধ্যেই এসমস্ত সমপন্ন হতো। অতঃপর আমাদের আনন্দযাত্রা। ট্রেনের তীব্র সিটির সঙ্গে ঝমঝমঝটাংঝটাংঝনাৎঝনাৎ সে যেন অসীম অাশ্চর্য ধাতব যন্ত্রের সঙ্গে ছুটন্ত প্রকৃতির পাল্লা দেওয়া গান ! অবাঙ আমি বিমুগ্ধচিত্তে ট্রেনের জানালায় কান পেতে শুনতাম সুবিস্ময়ের সেই গান। উড়ন্ত চুল-চোখ-মুখে সুতীব্র বাতাসের ঝাপট উপভোগ করতাম। উপভোগ করতাম অপার দৃষ্টিসীমায় অধরাপানে ছুটন্ত আকাশরেখার দিঙদোলানো ধুমতানানা। ছোটরা ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে যেতো। বাবাও একটু-আধটু ঝিমুতেন। মা চুপচাপ কোনের সিটে বসে সবার দিকে নজর রাখতেন। মাঝেমাঝেই ডেকে বলতেন – ' আহ মাথাটা একটু সরিয়ে বস ' – আমি বিশেষ ভ্রূক্ষেপ না করে মাকে একটু হাসি উপহার দিয়েই আমার দেখার চোখ-মন মেলে দিতাম উধাও হাওয়ায়-হাওয়ায়। রেলের ঝিকঝিকঝকঝক অাওয়াজের অপার ডাকে অামার মনের ভিতর শত সুরের ওড়াউড়ি ঝিকঝিকঝকঝকের সনে পাল্লা দিয়েই। লাকসাম জংশনের – "এ –ডিম — বয়েল ডিম —" / 'চা এ — চা গরম —' অাজও অবিকল শুনতে পাই স্মৃতির চোখে। কতকাল রেলভ্রমণ হয়ইনা !

চিলতে বারান্দায় পড়শির আমের ডালে ঝুলন্ত কাঁচা আমের আবাহনে যেন আবার অন্তরে-অন্তরে জেগে উঠলো মধুর অতীত …. যার কোনও তুল্য হয়না …. হৃদিমন জুড়ে অমল ঝর্ঝর …. নির্ঝর সে কি ! মন উদাস করা সেইসব কবেকার ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাই অন্তরে-অন্তরে হঠাৎ অবকাশে। নিটোল ছবিময় আনন্দদিনগুলি আমার। মনে পড়তে আবার সেই সে ধাবমান মাথায়-মগজে-মননে সেই একান্ত অবগাহনে। আহ কি এক মনোজিয়া ঘোরে অতীত ডেকে নেয় আমায়। আমি শুনি ছুটন্ত ট্রেনের ঝমঝমঝটাংঝটাংঝনাৎঝনাৎ গান। অসীম- আশ্চর্যঘোরে নিমজ্জমান।

১৪২১ বঙ্গাব্দ।।