সারবাঁধা গরুর গাড়িতে বরযাত্রীরা / কনে চলেছে – এই ছবিটি আমাদের চিরন্তন গ্রামবাংলার অতীত ঐতিহ্য মনে করিয়ে দেয়। তখন গ্রামগঞ্জের বিয়েতে গরুর গাড়িকে এভাবেই সাজিয়ে বরযাত্রী যেতো। আবার বধূ নিয়ে ফেরার দৃশ্যও এমনই ছিলো। আমার খুব মনে আছে তখন নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলেই কারও না কারও বিয়ে লাগতো। বরের গরুর গাড়িযাত্রার দৃশ্য দেখতে আমরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কাগজের ফুলপাতায় সাজানো গরুর গাড়ি চড়ে বরযাত্রী / বরবধূর যাত্রা দৃশ্য অপলক মুগ্ধতায় চেয়ে-চেয়ে দেখতাম। মনের ভিতর ক্যামন ভিন্নতর অজানিত রোমাঞ্চ টের পেতাম। যেন বা একদিন হয়তো আমারও …. তার বেশি আর ভাবাও যেতোনা সেদিন। ১৯৬৫ সালের কথা।
আজ গ্রামগঞ্জের চিত্র বদলে গেছে আমূল প্রায়। শেষ যেবার নানাবাড়িতে গেছি ১৯৮০ সাল, আমার বিবাহত্তোর বরের সঙ্গে তাঁর টয়োটা কার-এ চড়ে, তখন গরুর গাড়ির দৃশ্যটি / গরুর গাড়ি সাজিয়ে বরবধূর যাত্রাদৃশ্যের রোমাঞ্চিত অধ্যায় মনেই নেই। তখন আমার নানাবাড়ির হরিনারায়নপুরেও লেগেছে শহুরে হাওয়া। ধানীপথের চারপাশে দিব্যি শহুরে আদলের দোকানপাট দালানকোঠা উঠেছে এমন হারে মনে হচ্ছিলো যেন হরিনারায়নপুরে আসিনি। অন্য কোনও জায়গায় চলে এসেছি পথ ভুল করে। কিন্তু যখন বাড়ির পাশের বিখ্যাত গোদার মসজিদ-এর দেখা মিললো তখন বুঝি যে নাহ , আমার স্বামী ভদ্রলোকের রাস্তাজ্ঞান যথেষ্ট ভালো। আমায় তিনি ঠিকই নিয়ে এসেছেন গন্তব্যে।
তো, এই লেখায় আদতে যা ধারণ করতে চাইছি তার কথা বলি। আজ যা বিলুপ্ত স্মৃতির ছবি তার কিন্তু কদর কিছুমাত্র কমেনি। জীবনধারার দিন বদলের পালায় বাস্তবতা বদলে গেলেও সে অমূল্য চিত্রকলা আজও। আমাদের কলোনিয়াল যান্ত্রিক জীবন তার নাগাল পায়না বটে তবুও সেইসব চিত্রকলার বিস্তর প্রয়োগ হচ্ছে শিল্পে-সাহিত্যে-নাটকে-চলচিত্রে। যা চিরন্তন গ্রামবাংলার অসাধারণ চিত্রকলা হিসেবে ঠাঁই করে নিচ্ছে বৈশ্বিক আবেদনে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর ঐতিহ্যের ধারক হয়ে। হৃদয় গর্বে ভরে ওঠে। আরও আশ্চর্যের যা তা এই যে আজকাল অনেক বিয়েতেই ঘটা করে গরুর গাড়ি সাজিয়ে বরযাত্রী যাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। রাজধানীর অনেক বিত্তবানরাও দিব্যি মহানন্দে গ্রামবাংলার সনাতন ঐতিহ্যে নিজেদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গরুর গাড়ি অন্তরভুক্তির কাজটি করছেন। তাদের সাধুবাদ জানাই। পরম আনন্দদিনে বাংলার চিরন্তনতায় ফিরে যাওয়ার প্রয়াসে আনন্দন নিশ্চয় অন্যমাত্রা পায়।
কেবল আমার নিজের ক্ষেত্রে তা আর হয়ে ওঠেনি বলে মনের মধ্যে ক্যামন এক খচখচানি টের পাই আজও। আহ অমন কাগজের ফুলে সজ্জিত গরুর গাড়িতে চড়া হলোনা এ জীবনে …. অগত্যা ছবি দেখেই মনভর্তি আনন্দ কিনে বাড়ি ফেরার ভাবটি ধারণ করে আমার আজকের এই লেখা ….
এবঙ নিবেদন করছি নুরুন্নাহার শিরীন-এর নির্বাচিত দেশজ কবিতা-র কিছু লাইনঃ
আমি কি ভুলেও জানি সামনে কি কবিতা না গল্প
না নতুন না পুরনো না জেনেই আসে চিত্রকল্প।
এইমাত্র রাস্তায় দ্যাখা নতুন মুখটি মনে করে
হয়তো কবিতা হবে কিংবা গল্প, পাতারা রাখবে ধরে।
ওইতো সূর্যাস্ত দেখে পাখিরাও ঝাঁক বেঁধে নীড়ে।
কাল আবার দ্যাখা হবে যথারীতি সূর্যওঠা ঘিরে।
তবেতো শাদাকালোর ঝগড়া মিটে যাওয়াই ভালো।
দেখো তবেই ঝাপসা মতো গতকালও আলো।
যে আলোয় ভেসে আসে সবুজের গান।
সে আমার উড্ডীন স্বদেশ ছেলেবেলা আনচান।
সততঃ সে ছবি কথা বলে, ভাসায় সাম্পান।
সে আমার স্তব্ধতায় বাজায় মুক্তির গান।
ও আমার গান যাও যেখানে হৃদয় নত।
শোনে মুগ্ধতার বাঁশি অন্তর্গত।
ও আমার গান যাও পাতায় থাকো।
মনভাঙা সব চাপেও হৃদয়জয়ী গন্ধে ডাকো।
জানুয়ারী। ২০১৫ সাল।
১৪২১ বঙ্গাব্দ।।