অর্বাচীনের জখমিত এলিজি

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 30 April 2012, 09:52 AM
Updated : 30 April 2012, 09:52 AM

বহুকাল আগের কোনও প্রহরে আজকের মতোই প্রায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম – " ঠাঁই " শিরোনামের কয়েক লাইন –

মেঘলা চড়ায় খুঁজছিলাম যখন একফালি ঠাঁই
মাথায় মগজে এসে ঠেকলো আকাশরেখা !
কে যেন রোদ্দুরের কণ্ঠে পড়লো কবিতা
তা শুনে হৃদয় লাফিয়ে ওঠে !

সুখ যায় বনে তাই পাই হাওয়ার উত্তেজনা।
আঁকাবাঁকা জলঝড় আর ছেঁড়াপাতা ভরা
জটিল ধূলোর ঢেউ ধাক্কায় উপল চুরমার করে
আমাকে বসতে দিলো ব্যাথার ভিতরে।

আজ তারও ঢেরদিন পরে একইরকম প্রহরে প্রায় কি এক অজানিত বোধের উদাস আপন্নজালে আটকা পড়া পড়ন্ত অস্তমিত মানুষদের দলে নিজেকে দেখি যেন বা অর্বাচীন বড়ো। এবঙ অদ্ভূতুড়ে শুনতে পাই কারা যেন অন্ধকারের কন্ঠে বলছে আমায় –
" এখানে কোনও খালি নেই তাড়াতাড়ি জায়গা ছাড়ুন যত্তসব অর্বাচীনের দল " !

আমি বিষম আনত আপন্ন মানুষের মতো ভাবিত সরে বসি সূর্যাস্ত ঘিরে ধরা যোজন দূরবর্তী বধ্যভূমিতলে। অজস্র জখমিত নমস্য মেঘমুখগুলি অবাঙমুখর ভাষায় কথা বলে আমার একান্ত মনোজ অবেলায় ডুবন্ত হিঙুল প্রহরে। আমি আচ্ছন্ন ডুবে যেতে যেতেও ভেসে উঠি জেগে উঠি আশ্চর্য আবাহনে। মনোটোনাস এক মেদিনীগর্ভ ভেদ করে স্বপ্নজারিত হয়ে আমার পাঁজরের হাড়মজ্জায় আশ্চর্য ছড়িয়ে পড়ে আগুনে বীজ। সন্ধের গভীর ছুঁয়েই যেন শিকড় হতে শিখরে ওড়ে অই আগুনবীজ। অচিরেই আঁধার চিরে সবুজ হবে বলে। বাংলার সনাতন ছায়ায় শাখা-প্রশাখায় নব-সালোকসংশ্লেষণে সূর্যোদয়ের আলোয় পল্লবিত হবে বলে।

হয়তো এই ছবিটা আমার ছোঁয়াও হবেনা আদতে। তা না হোক। আমার অন্তরাত্মা আজ আমায় অগণিত নমস্যদের জখমিত মেঘভাষায় জাগিয়ে তুলেছে। আমি তারই তরে সন্ধের দিকে যেতে-যেতে গভীর বোধনে বুঝি যে আমি না হই আগামীর অজস্র জাগ্রত হাত ছোঁবে তাঁহাদের তৃষ্ণার্ত ছবিটি সহস্রে সহস্র হয়েই। ভাবামাত্র এই অর্বাচীনের হাত ভরে ওঠে শিখায়। যে শিখা নেভেনা। জ্বলে শিকড়ে-শিখরে।

সেই ভেবেই আমার পঙক্তিঘোরে লেখা পঙক্তি নিবেদন করছি –

কতকাল সত্যবদ্ধ অভিমানে অপমানে
জেগে আছি দেশপ্রেমে
অভিন্ন অতন্দ্র শত স্বপ্নবিদ্ধ কবিতার মতো !
যেন আজন্ম আপন্ন এক শিখা পরিণত !

কে কবে কখন কবন্ধ কুয়াশা চিরে
রক্তে জ্বেলেছিলো তারে গভীর বোধনপারে
বেদনাজারিত করে হৃদয়জ চোখ
দিয়েছিলো ভরে !
তীব্রতম এক দেশ জেগে ওঠে
পাঁজরের হাড় ভেদ করে !

কড়া নাড়ে জোরে মৃত মগজের অন্ধকারে।
রোদ্দুরের কণ্ঠে বলে – কি গো মনে পড়ে ! স্মৃতির রক্তাক্ত বধ্যভূমি খুঁড়ে রিম-রিম
আলো মাথা কুটে মরে !
আমি তার মাথায় দুহাত রেখে
আদ্যন্ত জাগ্রত হই বহুকাল পরে।

ঢাকা। বাংলাদেশ।