“বাঁশি শুনে আর কাজ নাই” জেনেও যে বাঁশি বাজায়

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 18 May 2012, 07:46 AM
Updated : 18 May 2012, 07:46 AM

এই উপমহাদেশের সুবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মণের "বাঁশি শুনে আর কাজ নেই" গানটি আজও অনেকেরই প্রিয়। আমার মনেও হঠাত গুনগুনিয়ে ওঠে। আবার লতাজী-র কণ্ঠের সেই গান "ও বাঁশি, বাঁশি কেন গায়" তারও আবেদন কিছুমাত্র কমেনি আজতক। তো, এই সেই বাঁশের বাঁশি,মোহন সুরে শ্রীকৃষ্ণ বাজিয়ে আউলা করেছিলো রাধার মন, "প্রাণসখীরে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে" এ গান লোকমুখে / রেকর্ডে বাজে যে কোনও গ্রামগঞ্জের বিবাহ-বাসরে।

এ বাঁশি কিন্তু বাংলার বাঁশ দিয়ে তৈরী। বংশিবাদকের ফুঁ-এ যেমন সুরের যাদুর ইন্দ্রজাল ঝরায়, তেমনই কাঁদায়, জাগায়ও। এদেশে লোকগান বংশীবাদকহীন অসম্পূর্ণ। আমার খুব মনে আছে ছেলেবেলায় আমাদের শহর কুমিল্লার নিঝুম রাত্রি ভেদ করে আমাদের ঘরেও ভেসে আসতো কোনও পাগল বংশিবাদকের অভূত সুরের আশ্চর্য মায়াজাল। কান পেতে শুনতে-শুনতেই দু'চোখে ঘুম নামতো। কতকাল পেরিয়ে গেছে তবুও বাঁশি তার মোহন মন্ত্রে ঠিকই নিয়ে যায় সুদূর থেকে সুদূরে। তার চেয়েও আশ্চর্য যে ধোঁয়াশাময় আজকের যান্ত্রিক নাগরিক জীবনও মাঝেমাঝেই কোনও মার্কেট / রেস্তোরাঁর গেইট-এর এককোণায় বসে / দাঁড়িয়ে আপন মনেই বাঁশিতে নিবিষ্ট বংশীবাদক-এর দেখা মেলে। কারও মনে তার প্রতি দরদ জাগলে বংশিবাদকের ঝুলিতে কিছু টাকাকড়িও জোটে। কোনওদিন হয়তো কিছুই জোটেনা। তবু বংশিবাদক বাঁশিতে ফুঁ দিয়েই যায়। তাদের তরে মনে-মনে প্রার্থনা করি "ওদের দিন ভালো যাক"।

এবঙ বাঁশি বাজিয়ে প্রতিষ্ঠিত এমন বংশিবাদকও আছেন অনেকেই এদেশে, বিদেশেও। এমন একজন বংশিবাদকের কথা পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে "আনন্দবাজার" পত্রিকায়। তার কথাই শেয়ার করছি ব্লগে। পশ্চিমবঙ্গের সিঁউড়ি-র ইন্দিরা পল্লীর সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মন্টু মাজি। স্কুলের আসা-যাওয়াকালে এক বাঁশি বিক্রেতার বাঁশি শুনে বাঁশির প্রেমে মজেন। একদিন স্কুলফেরতকালে বাঁশিওয়ালার কাছ থেকে একটি বাঁশি কিনেই ঘরে ফেরেন। অতঃপর বাজানোর চেষ্টায় কাটে ক'দিন। ফাঁক পেলেই ফুঁ দেয়ার অক্লান্ত চেষ্টা। অবশেষে তালিম নেন দু'জন বংশিবাদক শিক্ষক-এর কাছে। শিখেই তিনি সুযোগ পেয়ে যান প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী জগন্নাথ মাজি-র রেওয়াজ-এর সঙ্গে বাঁশি বাজানোর। সেই সূত্রেই অনেক নাট্যসংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বংশিবাদক-এর কাজ পান। অনেক নাটকের আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। পান বংশিবাদক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি। তো, আজও তাঁর অগ্রযাত্রা বাঁশির সঙ্গেই ৩৫ বতসরাধিক কাল। কীর্তনপালা, যাত্রাপালা, বাউল আসর, আধুনিক গানেও বংশিবাদক তিনি। ৮ হাজারেরও অধিক অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়ে অর্জন করেছেন সুনাম। তাঁর জীবনের উজ্জ্বলতম স্মৃতি ৮ বছর আগে ভারত-এর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাউল গানের সঙ্গে বাঁশি বাজানো। তাঁর বাঁশিতে মুগ্ধ হয়েছেন মনোমোহন সিং , সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী। আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে বংশিবাদক মন্টু মাজি-র ছবিটি আমার প্রিয় ছবির ফাইলে সংগ্রহ করে রাখি তখনই।

এমন বংশিবাদক সহ সকল বংশিবাদক-এর জন্য আজ আমার হার্দিক প্রণতি।

১৮ মে ২০১২ ইং