বাজেট-এর কত শতাংশ সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য?

নুরুন্নাহার শিরীন
Published : 9 June 2012, 03:53 PM
Updated : 9 June 2012, 03:53 PM

বাজেট-এর অর্থনীতি আমার বিষয় না। এবঙ এটি নির্জলা সত্য যে বিজ্ঞান-সাহিত্য কিঞ্চিত বুঝলেও বাজেট-অর্থনীতি বুঝিনা একদম। কেবল এইটুকু বুঝি যে "আমার সোনার হরিণ চাই" গানটি শুনতে যতই সুমধুর লাগুক আদতে তা পাওয়া অসম্ভব। যদিও জানি হাজার কোটি টাকার বাজেট অনেক মাথা খাটিয়ে তৈরী করেন বাজেট প্রণেতা আর মহাসমারোহে তা পেশ করা হয় জাতীয় সংসদে। তা নিয়ে তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। তার কোনও কোনওটির সপক্ষে যায় একদল। অন্যদলের যথারীতি বিপক্ষে তৈরী হয়েই থাকে বাজেট-বর্জনের খসড়া / নখরামি। এসবেরই মধ্যে বাজেট পাশ হয়ে যায় সংসদে। এ কিন্তু বহুকালের প্রথায় আবর্তিত। অনেক শুনেছি এসব মিডিয়ার কল্যানে ঘরে বসেই। বাঘা-বাঘা যত পাঁচশালা-দশশালা প্ল্যানমালা। কিন্তু না, ছুঁয়ে দ্যাখার আগেই যেন বা সব শালা ফুসমন্তর! মুহূর্তেই কোথায় যে উবে যায় কে জানে! অন্যদিকে আমজনতার দল বাজেট-এর মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝেও আশা-মরিচিকার মতো ভাবে যে হয়তো বা তাদের নিত্য সঙ্কটভর্তি দিনের শেষে দু'মুঠো শাকান্নের অভাবটুকু অন্ততঃ ঘুচবে … ভাবনাটি বেশিদূর এগুতে পারেনা অভুক্ত পরিবারের কচিকাচা অনেকগুলো মুখ-এর কথা মনে হতেই! এটি নিতান্ত বাস্তব একটি চিত্র এদেশেরই নিম্নবিত্ত / বিত্তহীনের। ধনাঢ্যরা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণী। তাদের বাজেটের বরাদ্দ নিয়ে মাথাব্যাথার প্রশ্ন ওঠেনা / অবান্তর বিষয়। মধ্যবিত্তের বিস্তর মাথাব্যাথা স্বত্তেও তাদের কথাটি যারা বাজেট প্রণয়ন করেন তাঁরা তেমন মনে রাখেন না / রাখতে পারেন না। অথচ বিষয়টি অগ্রাধিকারযোগ্য হয়েও কেন যে অগ্রাধিকার বঞ্চিত! হয়তো বোধগম্যতার অধিক কোনও দায়বদ্ধতার কারণেই বাজেট প্রণেতার ক্ষমতা থাকেনা এদের জন্য তেমন সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ ঘোষণার। এখানে আজ আমার একথাও বলার নয়।

আমি আসলে আমারই চারপাশের অগণিত সুবিধা বঞ্চিত শিশুর কথা ভাবছিলাম যখন মিডিয়া জুড়ে বাজেট আলোচনা-সমালোনার ঢেউ। সে ঢেউ আমায় ভাবায় বৈকি। যেহেতু আমি সামান্য একজন লিখিয়ে মাত্র তো, আমিতো আমার চারপাশের মানুষদের কথা ভাববো, যা আমার রোজের দায়-এর মধ্যেই পড়ে। কেননা ঘর ছেড়ে বেরুনো মাত্রই পথের ধূলো-জানযট-ট্রাফিক-সিগন্যাল সব ছাড়িয়ে চোখে পড়েই পথশিশুদের বাড়ানো হাত। যে হাত হতে পারতো আমারই গর্ভজাত শিশুর, যদি না আমার জন্ম হতো মধ্যবিত্তর ঘরে। হ্যাঁ এই কথা আমায় প্রায়শঃই বড়ো বেদনাতাড়িত অক্ষমতায় পীড়াদায়ক বাস্তব অভিজ্ঞার মুখমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমার নিজেকে অসহ্য লাগে। কেননা এই অগণিত শিশুর ভাগ্য নিয়ন্তা আমি নই, অথচ আমারও নিশ্চয় কিছু দায়ভার রয়েই যায়। অনন্যোপায় আমি তখন হাত বাড়ানো দু'চারজনের হাতে আমার সাধ্যমতো সামান্য কিছু নোটের যোগান দিয়েই দায়মুক্ত হবার হাস্যকর প্রয়াস সেরে নিজের গন্তব্যে ধাবিত হই। যদিও জানি এ শুধু ওই শিশুর সেদিনের ভিক্ষাবৃত্তির উপার্জন হলেও তার হাতকে নিবৃত্ত করবার কোনও পথ-ই না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পথশিশুর জন্য নির্দিষ্ট বাসস্থান-শিক্ষা-অন্নের ভার নেয়া। এদেশে যা তেমন করে ভাবাও হয়না, অথচ খুব বক্তৃতা-বিবৃতিতে ফলাও করে শিশুর জন্য কত না
দরদ প্রচার করা হয়। আমার জানামতে বিভিন্ন এনজিও এদেশে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখলেও সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ-এর অভাবে অগণিত পথশিশুর ভাগ্য পরিবর্তন-এর কোনও নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। সরকারী সকল শিশুকেন্দ্র অত্যন্ত সীমিত ও স্বল্প ব্যবস্থাপনার জন্য যেনতেনভাবেই পরিচালিত, যেখানে স্বল্প সংখ্যক শিশুই কোনওমতে থাকতে পায়। আশপাশের সহৃদয় কেউ-কেউ সহায়তা দেয় বলেই অইসব কেন্দ্রের শিশুরা অনিয়মিত কিছু পুষ্টির যোগান পায়। মোদ্দাকথা, এদেশে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য সরকারের হাত যথেষ্ট সম্প্রসারিত তো নয়ই নিতান্ত অপ্রতুল বলেই আজ আমার এই লেখায় সেই কথাটি বলতে চাইছি যে অযথা বাজেট-বক্তৃতা-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে দয়া করে পথশিশুর জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করুন। যাতে তাদের যথোচিত আহার-বাসস্থান-শিক্ষার বন্দোবস্ত হয়। এ নিশ্চয় "আমার সোনার হরিণ চাই" গোছের অসম্ভব চাওয়া নয়। এ খুব বাস্তব একটি অবস্থানগত অধিকারভিত্তিক অগ্রাধিকারযোগ্য চাওয়া। কেন আমার দেশের শিশুরা এত অধিকহারে পথশিশু হয়েই কাটাবে জীবন জীবনের সবচে' ভয়ঙ্কর অন্ধকারের নীচে! তাদের জন্য কি চিরকালই বন্ধ থাকবে আলোর দুনিয়া!

সেই কবে এমন এক তাড়না থেকে লিখেছিলাম কতিপয় পঙক্তি, আজ এখানে নিবেদন করছি …

মাঝেমাঝে রক্তের ভিতরে শুনি ছিন্নতার ডাক।
মাঝেমাঝে হৃদয় বাজায় চতুর্মুখী বন্দীত্বের ঢাক।
আবছা শৈশবগন্ধ আর কৈশোরের বালিয়াড়ি ঠিকানা
হারিয়ে এখন কতটা মানুষ কতটা ফানুস জানিনা।

শুধু ছিন্নভিন্ন লোনায় শেকলে শ্যাওলায় পা রাখার
অনুভূতি টের পাই পথের গভীরে টের পাই দায়ভার।
সম্ভাবনার হরিণশিশুরা গর্ভের ওম ছেড়ে অন্ধকারে।
শিকারী কালচে দাগ ভয়ঙ্করের পায়ের দাগ নির্বিচারে।

আমার সকল সবুজ খামার
শিশুর ইস্কুল ফেটে চৌচির বারংবার।
ভাবনারা ফাটল চিরেই কড়া নাড়ে ঝনাতঝনাত।
ভাবনারা ফাটল চিরেই কড়া নাড়ে ঝনাতঝনাত।

২৬ জৈষ্ঠ ১৪১৯