মনমোহনের ঢাকা সফর: আমাদের প্রত্যাশা

আরিফুল হক
Published : 3 Sept 2011, 01:53 PM
Updated : 3 Sept 2011, 01:53 PM

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এবং তা স্বাভাবিক এই কারণে যে, মনমোহনের এ ঢাকা সফর অনেক দিক থেকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে দেশটির পাঁচজন মন্ত্রী থাকবেন। মনমোহনের সফরসঙ্গী হিসেবে এই প্রথম এতগুলো মন্ত্রী থাকছেন। এমনকি সফরের প্রস্তুতি হিসেবেও বেশ আগে থেকেই দুই দেশের নীতি নির্ধারনী মহলে বেশ কয়েক দফা বৈঠকের খবরও শোনা যাচ্ছে। এছাড়া সফরকে সামনে করে, ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের বেশ কয়েক জন কর্তা ব্যাক্তি। অবস্থাদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে মনমোহনের এই সফর ভারতের জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের মত বুমিং একটা বৃহৎ অর্থনীতির দেশের প্রতিবেশী হিসেবে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের জন্য লাভজনক এবং ন্যায়সঙ্গত। এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য সরকারকে ঐতিহাসিক গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। চুক্তির শর্তগুলো অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। জনগণকে যদি দেশের মালিক বলে মনে করেন, তাহলে দেশের স্বার্থ নিয়ে যে কোন চুক্তির শর্ত জানার অধিকার তাদের অবশ্যই আছে, এটা ভুললে চলবে না। সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা, ফেনী নদীর পানির,হিস্যা সংক্রান্ত চুক্তিও হতে পারে। হতে পারে এমন নয়; হতে হবে। কারণ, ৭৪ সালের মুজিব ইন্দিরার যৌথ পানি চুক্তির অধিকাংশ শর্তগুলোই লঙ্ঘন করেছে ভারত। এজন্য আমাদের পরবর্তী সরকারগুলোও কম দায়ী নয়। তাদের পররাষ্ট্র নীতি খুব বেশি সুখকর ছিল না। ভারতের মত এমন একটা বৃহৎ অর্থনীতির প্রতিবেশীকে তারা মুল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে উত্তরবঙ্গের প্রায় ৬টি জেলার মানুষকে মূল্য দিতে হচ্ছে এখনও। মরুকরণ চলছে একরকম ওইসব জেলাগুলোতে। কৃষিসহ নানা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। এমনকি ওপাশ থেকে আসা পানির প্রবলচাপে জমিজমাসহ ভিটেমাটিও হারিয়েছেন অনেকে। এসব সমস্যাকে উপলব্ধি করতে হবে। নতুন করে পানি চুক্তির শর্তগুলো অবশ্যই দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই করতে হবে। এজন্য অবশ্যই দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয়, চুক্তির আগে তাদের সাথে কথা বলা।

ট্রানজিট নিয়ে অনেক বিতর্ক দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে হয়েছে। অনেকে বলেছেন, এটা ট্রানজিট বা কানেকটিভিটি না: করিডোর। যদি ট্রানজিট হয়, তাতে খুব বেশি আপত্তি নেই দেশের মানুষের। ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু দেশের মধ্যেই ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু আছে। আর দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকল্প নেই। ভৌগলিক ভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এমন জায়গায় যাতে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির মাধ্যমে আমাদের সুযোগ আছে অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু ট্রানজিটের নামে যদি করিডোর হয়, তাহলে ভারত আমাদের দেশের জমি ব্যবহার করবে বেপরোয়াভাবে। যা ইচ্ছা তাই বহন করবে আমাদের রাস্তার উপর দিয়ে। এমনকি যদি তারা দেশের একমাথা থেকে আরেক মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা পারমানবিক অস্ত্রও ব্যবহার করে আমরা কিছুই বলতে পারব না।

আর ভারত যদি আমাদের সড়ক ব্যবহার করতে চায় বিনা টাকায়!!! তা হবে কেন??? পৃথিবীর বহু দেশে ট্রানজিট ব্যবস্থা যেমন আছে; তেমনি সেইসব ট্রানজিটের মাশুলও তাদের দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ভারতের কাছ থেকে মাশুল আদায়কে অসভ্যতা বলে মন্তব্য করেছেন: যা অনাকাঙ্খিত। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও বেশী দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে জাতি।

এটা ট্রানজিট নাকি করিডোর নাকি কানেকটিভিটি তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। আমরা যদি দেখতে পায় কানেকটিভিটির মাধ্যমে, আমরা নেপাল, ভুটান কিংবা চীন পর্যন্ত পৌছাতে পারছি তা হলে তা দেশের জন্য এক শুভ অধ্যায় রচিত হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বেড়ে যাবে যা আমাদের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করে তুলবে। সভ্য পৃথিবীতে তাই কানেকটিভিটির চিন্তা আসতেই পারে। কিন্তু তা অবশ্যই যেন করিডোর না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সবার আগে বিবেচনা করতে হবে, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার মত অবকাঠামোগত অবস্থা আমাদের আছে কিনা। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে আমাদের এখনও সে রকম অবস্থা তৈরি হয়নি। তাই এবিষয়ে আরও গবেষণার অবকাশ রয়েছে।

বাণিজ্য ঘাটতির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ ভারত থেকে কি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। তার বিপরীতে দেশটাতে আমাদের রপ্তানি কিন্তু অনেক কম। আমরা জানি ভারত বৃহৎ অর্থনীতির দেশ তাদের সাথে আমাদের বাণিজ্য সমান হবে না। ব্যবধান থাকবেই। তবে তা অবশ্যই ভারসম্যপূর্ণ হতে হবে। এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী মহল ও আমদানি রপ্তানী সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিলে ভাল হবে। কারণ সরকারে থাকা চুক্তিকারীরাই একমাত্র ব্যবসা ভাল বোঝেন, এমনটি নয়।

সীমান্ত সমস্যা দুদেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৫২টি ছিটমহল, অমীমাংসীত সীমানা, অপদখলীয় জমিসহ বেশ কিছু জটিলতা রয়েই গেছে ১৯৪৮ সালের পর থেকে। এগুলো সমাধান হওয়া জরুরী।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের দিক থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা পড়তে দেখেছি। গত তিন মাসে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা করেনি বিএসএফ। তবে বিভিন্নভাবে অত্যাচার বন্ধ হয়নি। এটা কিভাবে শুন্যের কোঠায় আনা যায়, তা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে।

সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হই সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনও বাধে তা বাধবে পানি নিয়ে। তবে আশার কথা, দেরীতে হলেও বঙ্গোপসাগরে আমাদের অধিকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আদালতে আমাদের দাবি উপস্থাপিত হয়েছে। যা ভারত ও মায়ানমার আগেই করে ফেলেছে। তবে ন্যায্য হিস্যা থেকে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসা যাবে না।

একটা উদ্বেগের বিষয়, আমাদের দেশে ভারতের প্রায় ৮০টির বেশি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারিত হয়। ভারতে আমাদের একটা চ্যানেলও সম্প্রচারিত হয়না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ভারতের এ আচরণ প্রতিবেশী সুলভ না। এ অবস্থান থেকে ভারতকে সরে আসতে হবে। আর এর জন্য আমাদের নীতি নির্ধারক মহল থেকে জোর দাবি আসতে হবে।

আর একটা বিষয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে ১৯৯৯ সালে। বিশ্বের সব শক্তিধর দেশকেই আমরা হারিয়েছি ক্রিকেটে। এমনকি ভারতকেও। তবে দুঃখের বিষয় যে, বিশ্বের সব দেশে খেললেও ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ কখনও ক্রিকেট খেলেনি। এটা কি ধরনের আচরণ প্রতিবেশীর প্রতি!!!!!

ভারতের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা আমরা সবচেয়ে বেশি চাই। আর চাওয়াটা বাস্তবসম্মত। তবে সে চাওয়া অবশ্যই হতে হবে মর্যাদাপূর্ণ। একটা বিষয় খুব মনে রাখা দরকার; ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ উগ্র। টপ টু বটম তারা এই জাতীয় দর্শনে খুব সচেতন।

নেহেরু থিয়েরী (ভারত সাগরের পানি যে ভূমি স্পর্শ করবে, সেখানে আমাদের কর্তৃত্ব থাকবে) অনেকের মনে থাকার কথা। আমরা কিন্তু ভারত সাগরের বাইরে নই। এটাও মনে রাখতে হবে। তবে, হ্যা পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে অবশ্যই ভারতের সাথে আমরা সুসম্পর্ক চাই। তবে যেন, বাবু মোসাহেবের পর্যায়ে না পড়ে কোন রকমে। পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ন, প্রতিবেশীসুলভ একটা দৃষ্টিভঙ্গি ভারত দেখাবে বলে আমরা আশা করি।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আমাদের চেয়ে ভাল অবস্থানে। বিশ্বে তারা তাদের পররাষ্ট্রনীতির যে সফলতা দেখিয়েছে তার স্পষ্ট প্রমাণ, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির সাম্প্রতিক উঞ্চ সম্পর্ক। তাই এমন একটির দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বেশি কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে জুজুর ভয়ে বসে থাকাটাও হবে বোকামী। এই শতব্দীতে অগ্রসর অর্থনীতিতে ভারতের ভূমিকা থাকবে প্রথম সারিতে। তাই এই অর্থনীতির কাছাকাছি থেকেও আমরা যদি নিজেদের এগিয়ে নিতে না পারি; ইতিহাসের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আজ যারা আমাদের দেশ পরিচালনা করছেন। যাদের কাধে সমস্ত জাতির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।