সৌদি সামরিক জোট ও নার্ভাস বাংলাদেশ

বিজন সরকার
Published : 25 August 2011, 05:58 AM
Updated : 17 Feb 2016, 07:35 AM

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। স্কাইপে আমার এক আমেরিকান বন্ধুর ফোন আসে। সময় থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি রাজি হলাম। প্রথমেই বন্ধুটি সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলে নেওয়া আবশ্যক। বন্ধুটি দীর্ঘ দিন থাইল্যান্ডের একটি সামরিক ইন্সটিটিউটে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে ফিলিপাইনের একটি সামরিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ইরাকে ও আফগানিস্তানে মার্কিন নৌবাহিনীর উপরের স্তরের কমান্ড অফিসার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। কাবুলের তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর পায়ে গুলি লাগে। সেই থেকে তিনি স্নায়ুরোগে ভুগছেন। প্রসঙ্গত, আমাদের মধ্যে বয়সের তফাৎ প্রায় পনের বছরের।

শুরুতেই তিনি জানালেন, মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একটি সামরিক জোটের ঘোষণা সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আসতে পারে। আগেও যতবার কথা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে একটি সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতেন আমার বন্ধু। তাঁর মতে, সামরিক জোট গঠন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলির জন্য বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশেরই এককভাবে সম্ভাব্য নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলা করার সামর্থ্য নেই। বন্ধু অনুযোগ করলেন, জোট করেও নতুন মধ্যপ্রাচ্যের পথ রুদ্ধ করা অসম্ভব। প্যালেস্টাইন স্বাধীন হওয়ার আগেই আরব বিশ্বে আরও কয়েকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে।

জানতে চাইলাম, যেখানে মুসলিম বিশ্ব অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এবং আরব লীগের মতো বেসামরিক দুটি সংস্থায় গতি সঞ্চার করতে পারেনি, সেখানে সুপিরিয়র নেতৃত্ব-নির্ভর সামরিক জোট কীভাবে পরিচালনা করবে? আপত্তি জানালাম, গণতান্ত্রিক মানসিকতা ছাড়া একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সামরিক জোটের নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলির অধিকাংশ সরকারপ্রধান স্বৈরশাসক। ফলে এটি অকল্পনীয়।

তিনি বললেন, না, এটি খুবই সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজতন্ত্রগুলির মধ্যে সামরিক জোট গঠন হয়েছিল। এমনকি গণতান্ত্রিক শক্তি ও স্বৈরশাসকদের মধ্যে জোট গঠনের উদাহরণ আছে। উদাহরণ দিলেন, ব্রিটিশ সেনাদের সহযোগিতায় সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আল-সৌদ জোট গঠন করে মক্কা দখল করেছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোটের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম বন্ধুর কাছে। বিশ শতকের শুরু থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তাছাড়া এখন প্রতিটি দেশেই কম-বেশি সামরিক বাহিনী রয়েছে।

বন্ধুর বক্তব্য, সামরিক জোট গঠন ব্যতীত অন্য বিকল্প দেশগুলির হাতে নেই। বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার এবং একই সঙ্গে আইএসের উত্থানের ফলে ভূরাজনীতিতে অনেক প্রতিষ্ঠিত সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। তিনি পাঁচটি বিষয়ের আলোকে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়ন করলেন।

প্রথমত, পশ্চিমা দেশগুলি আগের মতো মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের পাহারা দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি গত কয়েক দশকের যুদ্ধে সাময়িকভাবে ক্লান্ত, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও নৈতিকভাবে আতঙ্কিত। ইরাকে বহুজাতিক বাহিনীর আগ্রাসন চরম অন্যায় ছিল। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েক হাজার সেনা নিহত হয়েছে। ফলে এশিয়ায় মিত্রদের রক্ষা করার জন্য গ্রাউন্ডে সেনা পাঠানোর সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পশ্চিমা দেশগুলির সমাজ দ্বিধাগ্রস্ত। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূলের লক্ষে গ্রাউন্ডে সেনা পাঠানোর বাস্তবতা পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক সমাজে নেই।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা দেশগুলির জনগণের ট্যাক্সের কয়েক শত বিলিয়ন ডলার খরচ করা হলেও মধ্যপ্রাচ্যে ন্যূনতম স্থিতিশীলতা আসেনি। হয়েছে উল্টো। যেখানে সামরিক হামলা হয়েছে, সেখানেই ধর্মীয় জঙ্গিবাদ হাজার গুণে বেড়েছে। আগে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি একটি বিশেষ এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন জঙ্গি কার্যক্ষম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে আগে বিবেচনা করলেও এখন বিষয়টি সামাজিক ক্যান্সার হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। আইএসের পক্ষে নানা শ্রেণির মানুষের মৌন সমর্থন রয়েছে। ফলে গ্রাউন্ডে বুট পাঠিয়ে এই যুদ্ধের শেষ হবে না।

তৃতীয়ত, পশ্চিমা সমাজে উগ্র ওয়াহাবিজম প্রসারের অপচেষ্টার বিষয়টি পশ্চিমারাও বুঝতে পেরেছে। সৌদি আরব একজন সিরিয়ান শরণার্থী গ্রহণ করতে রাজি না হলেও জার্মানিতে সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্য দুশ মসজিদ নির্মাণে জার্মান সরকারকে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাবটি সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এসব কারণে সৌদি আরবের উপর থেকে পশ্চিমা দেশগুলির দৃষ্টি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। পশ্চিমা সমাজ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, মধ্যপ্রাচ্যের নয়।

চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির মোট সামরিক সেনার সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ লাখ। অথচ আইএসের ত্রিশ হাজার সেনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশের সেনা ততটা ইচ্ছুক নয়। কেন ইচ্ছুক নয়, সেটির পিছনেও অনেক কারণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনে যুদ্ধের জন্য দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভাড়া করে বেসামরিক সেনা নিয়ে এসেছে। নিজস্ব সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ ফুঁসে উঠতে পারে। নিজস্ব সেনাদের গ্রাউন্ডে পাঠাতে ইতস্তততা প্রকাশের জন্য জন্য দেশগুলিকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। গরিব সুন্নি রাষ্ট্রগুলির সেনাদেরকে মাঠে রাখার একটি প্রেরণাও এই জোট গঠনের পিছনে কাজ করতে পারে বলে বন্ধু মত দিলেন।

সর্বশেষ, ইরান ক্রমশ মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কেবল সিরিয়া নয়, ইরাক ও ইয়েমেনের উপর ইরানের প্রভাব সকল প্যারামিটারে সৌদি আরবের চেয়ে বেশি। কয়েক শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেও পশ্চিমা বিশ্ব ইরাককে নিজেদের হাতে রাখতে পারেনি। ইরান তার প্রতিবেশি দেশকে দলে ভিড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের নিস্ত্রিয়তার ফলে রাশিয়ার প্রভাবও বাড়ছে। ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের চুক্তির ফলে সৌদি আরব প্রবলভাবে দিশেহারা। তারাও আগের মতো মার্কিন প্রশাসনকে বিশ্বাস করছে না।

এত সব বাস্তবতায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মিলে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট গঠন ছাড়া বিকল্প নেই।

সামরিক জোট গঠনের ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম। উল্লেখ করলাম ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আলীকে মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন একটি নতুন প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য যে চাপ দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ। প্রস্তাবটি ছিল এ রকম, গ্রাউন্ডে দশ হাজার মার্কিন সেনা থাকবে এবং নব্বই হাজার সেনা থাকবে মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই জোট ইরাকের পশ্চিমাংশে এবং প্রয়োজনে সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

হায়দার আলী জানান, ইরাকের গ্রাউন্ডে বিদেশি সেনার দরকার নেই, দরকার বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট। ম্যাককেইন বললেন, গ্রাউন্ডে অবশ্যই সেনার দরকার আছে। ইরাকের বিরোধী দল ইরাদা মুভমেন্টের প্রধান হান্নান ফাটলাওউ জানান, ম্যাককেইন বলে দিয়েছেন যে, প্রস্তাবে কোনো আপত্তি জানানো যাবে না।

আমার বন্ধুর মতে, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়া সিরিয়ায় হামলা করার কারণে পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনীতি একশ আশি ডিগ্রি উল্টে যায়। পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা মার্কিন রাজনৈতিক সমাজ যে কোনো ভাবেই হোক চ্যালেঞ্জ করতে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সুন্নিপ্রধান রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে সিরিয়াকে রাশিয়ার জন্য আরেকটি আফগানিস্তান করে তোলার চেষ্টা আমেরিকা করতেই পারে।

সুন্নিপন্থী মার্কিন রিপাবলিকান দলের নীতিনির্ধারকরা মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট গঠন নিয়ে পর্দার আড়ালে গত কয়েক মাস ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন। সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলার পর সামরিক জোট গঠনের চিন্তাটি খুব গতি পায়। জোট গঠনে আমেরিকার ডেমোক্রেট দলের প্রভাবশালীদেরও সায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সীমাহীন ব্যর্থতার ফলে ডেমোক্রেটদের হাতে বিকল্প প্রস্তাবও নেই।

বন্ধুর উদ্দেশে আমার সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিল এ রকম, কোন কোন মুসলিম দেশ এই সামরিক জোটে যোগদান করতে পারে?

সামরিক জোটটি সুন্নিপ্রধান দেশগুলিকে নিয়ে যে গঠিত হবে, তা স্পষ্ট করেই বললেন বন্ধু। তবে কোন কোন দেশ যোগদান করবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। জানালেন, তুরস্কের যোগদান নিশ্চিত। সেই সঙ্গে মিশরেরও। মালয়েশিয়ার যোগদান না করার সম্ভাবনাই বেশি। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি।

মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ক্ষেত্রে সৌদি আরব মিশরের সামরিক বাহিনীকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিল। ওরা ছাড়াও উপসাগরীয় অন্যান্য আরব রাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে মিশরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এখনও ওদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে জোটে মিশরের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত।

জোটে মালয়েশিয়ার যোগদান না করার পিছনে দুটি কারণ উল্লেখ করলেন তিনি। প্রথমত, আমেরিকা যেখানে আছে সেখানে মালয়েশিয়া ততটা আগ্রহী হবে না। দ্বিতীয়ত, মালয়েশিয়া সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আইএসপন্থী দেশি ও বিদেশি রয়েছে যারা দেশটির পর্যটন শিল্পের জন্য হুমকি। এসব বিবেচনায় দেশটির অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা শূন্য।

পাকিস্তান অর্থের জন্য দেন-দরবার করতে পারে এবং চাহিদামতো পেলে জোটে ঢুকেও যেতে পারে। যদি না যায় সে ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে আমেরিকা ও পাকিস্তানের তিক্ত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেন তিনি। পাশাপাশি, পাকিস্তানের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলির সম্পর্ক তেমন ভালো যাচ্ছে না। ইয়েমেনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চেয়েও পায়নি সৌদি আরব। পাকিস্তানের মূল রাজনৈতিক সমাজের একটি বড় অংশ দেশের জঙ্গিবাদের জন্য ধর্মীয় স্কুলগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলির অর্থায়নের বিষয়টির দিকে আঙুল তোলেন। সব মিলিয়ে দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে চীনের দিকে হাঁটছে।

বাংলাদেশের বিষয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন বন্ধু। আমার মত ছিল, সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। কারণ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে স্তরেই থাকুক, সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণ নীতি গ্রহণ করতে পারে। কারণ আমরা বহু বেসামরিক জোটের সদস্য হলেও সামরিক জোট গঠনের প্রস্তাব দেশটির জন্য প্রথম।

আমার মতে, দুটি বিষয় সরকার বিবেচনা করতে পারে। প্রথমত, সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটি। আমাদের রেমিটেন্সের অধিকাংশ আসে সৌদি আরব থেকে। তাছাড়া, ইসলাম ধর্মের দুটি প্রধান পবিত্র স্থান সে দেশে থাকায় আমরা সামাজিকভাবেও ওদের প্রতি অনেকটাই দুর্বল। ফলে সৌদি আরব যদি কোনো প্রস্তাব দেয়, তাতে সরাসরি না করে দেওযা আমাদের জন্য সমস্যা বটে।

অপরপক্ষে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আমদানিকৃত উগ্র ওয়াহাবিজমের কারণেই আমাদের সামাজিক ফ্রেব্রিক ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে। আমাদের দেশে আজ যে উগ্রবাদের প্রসার ঘটছে, সেটির দায় ওই দেশগুলি এড়াতে পারে না। অধিকন্তু, আমাদের কাছের প্রতিবেশি দেশ ভারত। একই সঙ্গে, প্রস্তাবিত সামরিক জোটটি বাংলাদেশের বড় দুটি বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে। দেশ দুটি হল রাশিয়া ও চীন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ 'ধীরে চল' নীতি গ্রহণ করতে পারে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বে ইসলামিক সামরিক জোট গঠনের ঘোষণাটি আসে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ঘোষণাটি দেন  ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহামেদ বিন সালমান। ঘোষণায় বলা হল, প্রধানত মুসলিম বিশ্বের চৌত্রিশটি দেশকে নিয়ে জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি সামরিক জোট গঠন করা হল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল-আল জুবায়ের প্যারিসে সাংবাদিকদের বলেন, মুসলিম বিশ্বের জন্য এটাই সুবর্ণ সময়। তিনি অনুযোগ করলেন, মুসলিম বিশ্ব জঙ্গিদেরকে মোকাবেলা ও জঙ্গি আদর্শ পরাস্ত করার লক্ষ্যেই সামরিক জোট গঠন করেছে।

তবে ইসলামিক সামরিক জোট' গঠন করার ক্ষেত্রে সৌদি আরব বড় মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা যে করেনি তা অনেক দেশের প্রতিক্রিয়া থেকে প্রমাণিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরী সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহামেদ বিন সালমানের ঘোষণার ঠিক একদিন পরই সামরিক জোটে থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির কথা গণমাধ্যম থেকে দেশটি জানল বলে জানালেন আহমেদ চৌধুরী। আগে কেউ তাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি।

মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাতুক শেরি হোসেন সরাসরি জানালেন যে, মালয়েশিয়া এই জোটে যাবে না। তবে আন্তর্জাতিক যে কোনো সন্ত্রাসবাদ দমন কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার প্রধান নিরাপত্তা মন্ত্রী লুহুত পান্ডজায়তান রয়টার্সকে জানালেন, তাঁর দেশ এ ধরনের কোনো সামরিক জোটে যেতে ইচ্ছুক নয়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরনাতা নাজির জানালেন, জোট বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। কেউ এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। প্রসঙ্গত, এ বছরের ১৪ জানুয়ারি জাকার্তায় বোমা হামলায় অন্তত ৭ জন মারা গেছেন। হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। ফলে সামরিক জোটে যোগদানের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে জাকার্তা আগ্রহ দেখাবে না।

মজার বিষয় হল, কথিত সামরিক জোটের নাম দেওয়া হয়েছে 'ইসলামিক সামরিক জোট'। অথচ আফ্রিকার অনেক খ্রিস্টান-প্রধান দেশের নাম এই জোটে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন উগান্ডা, বেনিন, গ্যাবন। উল্লিখিত দেশগুলির জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশই খ্রিস্টান। হাস্যকর বিষয়, ইরান, ইরাক, সিরিয়ার মতো মুসলিম দেশগুলিকে এই জোটে রাখা হয়নি। এই না রাখার পিছনে যে ধর্মীয় গোত্রভিত্তিক সহজাত আঞ্চলিক সংঘাত কাজ করেছে, তা হলপ করেই বলা যায়। তাই জোটের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন উঠেছে।

সৌদি আরব কখনও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেনি। এমনকি দেশটির নির্ধারিত সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় অনেক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিবেচ্যও নয়। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় জঙ্গিবাদী আদর্শ যে ছড়িয়ে পড়ছে তার সিংহভাগ দায় এই দেশের। জঙ্গিবাদ যখন নিজের জন্য ব্যাকল্যাশ হয়ে দেখা দিল, ঠিক তখনই তারা নড়েচড়ে বসল। এতেও কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না ওদের। ইসলামিক স্টেটের বিদেশি সেনাদের এক পঞ্চমাংশ সৌদি আরবের নাগরিক। সিরিয়া যদি শান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সৌদি আরবে বড় ধরনের অরাজকতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জঙ্গিবাদের মূল আদর্শ উগ্র ওয়াহাবিজমের প্রভাব থেকে দেশটির মুক্তি দৃশ্যত অসম্ভব। কারণ সেখানকার জনগোষ্ঠীর ৪৪ শতাংশ উগ্র ওয়াহাবিজমে বিশ্বাসী।

ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যে সৌদি প্রশাসনের জন্য বড় ভুল ছিল, তা ওরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে ইয়েমেনে হামলা শুরু করে ওরা। তরুণ এই সৌদি নেতার আরও কিছু হঠকারী সিদ্ধান্তে খোদ সৌদি রাজপরিবারের ভিতরেই ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং তাতে পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্বের সায় মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বের অশান্তির অন্যতম কারণ। আসাদকে রেখে সিরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন করতে পশ্চিমা গোষ্ঠীর তেমন আপত্তি নেই। কেবল সৌদি আরবের চাপে আসাদকে সরিয়ে দেবার বিষয়ে আমেরিকা অটল রয়েছে।

সৌদিদের এমন কট্টর অবস্থানের পিছনে অবশ্য অন্য কারণ রয়েছে। মূল ঘটনা হল, সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক। ২০১৪ সালের জুলাইয়ের শেষের দিকে সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমান রিয়াদে বাশার আল-আসাদ সরকারের প্রধান গোয়েন্দা উপদেষ্টা আলী মামলুকের সঙ্গে একটি গোপন মিটিংএ বসেন। রাশিয়া নেপথ্যে থেকে এই সাক্ষাতের আয়োজন করে। সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রস্তাব দেন, আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারবেন একটি শর্তে। আর তা হল, সিরিয়ার ইরানকে ত্যাগ করতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় গোত্রভিত্তিক। এটি খোদ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন। তাই বাংলাদেশের তড়িঘড়ি করে এই কথিত জোটে যোগদানের ফলে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।

সৌদি আরব যেখানে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তানে মতো প্রভাবশালী মুসলিম দেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করার সম্ভাবনা সকল প্যারামিটারেই শূন্য। তারপরও যদি আলোচনা হয়ে থাকে সেটি কোন ধরনের, তা জনগণকে পরিষ্কার করে জানানো দরকার। দেশের জনগণকে অন্ধকারে রেখে সামরিক জোটে যাওয়ার মতো সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত সরকার একা নিতে পারে কি? যে কোনো সামরিক জোটে যাওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে সংসদে ও সংসদের বাইরে বিস্তর আলোচনা হওয়া উচিত ছিল।

আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারে এমন যে, কোনো ধরনের আলোচনাই হয়নি। সৌদি জোটে দেশের নাম দেখেই বাংলাদেশ সরকার নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সৌদি আরবের সাথে বহুমাত্রিক সম্পর্কের কথা চিন্তা করেই সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্তির কথা বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ধরেই নিয়েছেন যে, সৌদি আরবের প্রস্তাবিত জোটে অন্তর্ভুক্তিতে বড় বড় মুসলিম দেশগুলির কোনো আপত্তি থাকবে না।

বাংলাদেশ যদি আমেরিকার মতো পরাশক্তির সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া শিখতে পারে, নিজের স্বার্থে সৌদি আরবের বিপক্ষে কেন নয়? সরকারের বুঝতে হবে, সৌদি আরব চাইলেও বাংলাদেশি শ্রমিকের চেয়ে ঝুঁকিমুক্ত প্রবাসী শ্রমিক অন্য কোনো দেশ থেকে পাবে না।