‘ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত’

তৌহীদ রেজা নূর
Published : 13 Feb 2012, 10:14 AM
Updated : 26 June 2021, 12:16 PM

প্রারম্ভিক কথা

মুখে ক্যান্সার নিয়ে জাহানারা ইমাম নেতৃত্ব দিলেন মহান এক আন্দোলনের এমন এক সময়ে যখন মানুষের হাতে হাতে যোগাযোগের জন্য আজকের মতো কোন ধরনের মোবাইল ফোন ছিল না। ছিল না বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোন টিভি চ্যানেল। শুধু ছিল বাংলাদেশ বেতার। অন্য কোন রেডিও চ্যানেলও ছিল না। মূলত প্রিন্ট মিডিয়া সেদিন এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। আর সঙ্গে ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পক্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি এবং দেশপ্রেমিক মানুষেরা। সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ সমর্থন ও ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার কারণে ১৯৭২ সালে উত্থাপিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কৃত অপরাধের বিচার হচ্ছে শাস্তি হচ্ছে বাংলাদেশে যা বিশ্ব ইতিহাসে অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করেছে। এই মহাযজ্ঞ সম্পাদনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। একই সাথে শহীদ পরিবারের সদস্যদের নির্ভীক সহযোগিতা এই আন্দোলনকে সফল করতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনে জড়িত হওয়া ছিল প্রজন্ম '৭১-এর সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা। আমার সৌভাগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম '৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হবার কারণে এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার মহাযজ্ঞে অনেক গভীরে থেকে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল। পেছন ফিরে তাকিয়ে অনেক কথা অনেক ঘটনা মনে পড়ছে যা বিস্তারিতভাবে লিখতে গেলে গ্রন্থাকারে লিখতে হবে। এ লেখায় শুধু বিক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতির কথা লিখছি ।

।।এক।।

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন। বর্ষাকাল শুরু হয়েছে কিন্তু বাদলের দেখা নেই। তপ্ত দুপুরে সংগঠনের ব্যানার নিয়ে ঘেমে-নেয়ে আমরা সকলে জমায়েত হয়েছি জাতীয় শহীদ মিনারে। গতকালের মিটিং থেকে আমাদের সবাইকে জানানো হয়েছে ওনার অবস্থা ক্রমশ আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি যে কোন সময় যে কোন দিকে যেতে পারে। তাই আজ শহীদ মিনারে ওনার মঙ্গল কামনা করে নাগরিক সমাবেশ হচ্ছে জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে। একে একে নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা আসছেন শহীদ মিনারের পাদদেশে। ব্যানার হাতে মিছিল নিয়ে নানা দল, পেশা, শ্রেণির মানুষেরা আসছেন। এর মধ্যে শহীদ জননীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে কয়েকজন বক্তব্য রেখেছেন। মাইকে ঘোষিত হলো বিশিষ্ট রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুর রাজ্জাকের নাম। তিনি ধীরপদে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলা শুরু করেছেন। এর মধ্যে দেখি এক ছেলে দৌড়ে এসে শাহরিয়ার কবিরের কানে কানে কি যেন বলল। আর শাহরিয়ার কবির এগিয়ে গেলেন আব্দুর রাজ্জাকের দিকে এবং অস্ফুটস্বরে কিছু ইঙ্গিত করলেন। মাইকে ভারী কণ্ঠে আব্দুর রাজ্জাক তখন বলছেন – 'এই মাত্র খবর এসেছে সুদূর আমেরিকা থেকে যে এই আন্দোলনের নেত্রী ও আহবায়ক আমাদের সবার প্রিয় জাহানারা আপা আর নেই। তিনি কিছুক্ষণ আগে জগতের মায়া ত্যাগ করেছেন…।' আর আমার সকল ইন্দ্রিয়গুলো যেন আড়ষ্ট হয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতরটা যেন খালি হয়ে যেতে লাগল। পাশে দাঁড়ানো বাবুলদা (শহীদ মধুসূদন দে-এর ছেলে এবং প্রজন্ম একাত্তরের সে সময়ের প্রচার সম্পাদক) এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। তার চোখ বেয়ে জলের ধারা। আমাকে বলছেন, "তৌহীদ, কি হয়ে গেল রে! আমাদের তো সব শেষ হয়ে গেল!" অসীম সাহসী, রাজপথের লড়াকু যোদ্ধা বাবুলদাকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে আমার যেন সম্বিত ফিরে এলো। আমি ফের সজাগ হয়ে উঠতে লাগলাম। ইতোমধ্যে শাহরিয়ার কবীর মাইকে গিয়ে ঘোষণা দিলেন – আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাই যেজন্যে আজকের এই সমাবেশের আয়োজন তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তাই আমরা এই সমাবেশ এখানেই শেষ করছি। আপনারা আজ ফিরে যান। আমাদের এখুনি জরুরি সভায় বসতে হবে…।' ইথারে এই কথাগুলো ভেসে আসছে আর এক অদ্ভূত বিষণ্নতা যেন সারা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণকে নিমিষে গ্রাস করে নিচ্ছে। শুধু মাঝে মাঝে কারো কারো কান্নার শব্দে নীরবতা ছিন্ন হচ্ছে।

।।দুই।।

আজকের সমাবেশে প্রজন্ম '৭১-এর আরো যারা এসেছিল তাদেরকে নিয়ে সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মেঘের কালো ছায়া সকলের মুখে। খুব কেউ কথা বলতে পারছি না। বললাম: "আমরা এখন যে যার বাড়ি ফিরে যাবো। পরে কি সিদ্ধান্ত হয় সে অনুযায়ী আবার যুক্ত হবো।" একে একে সকলেই চলে গেল। ভীষণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রয়ে গেলাম আমি আর বাবুলদা। সূর্যের প্রখরতা তখন কমে এসেছে। কেমন এক সোনালী আভায় চকচক করছে চারপাশ, কিন্তু আমাদের টানতে পারছে না সেই আভা। বাবুল দা বললেন, "চল, আগাই।" শহীদ মিনার থেকে হাঁটা শুরু করলাম আমরা কিন্তু কেউ কোন কথা বলতে পারছি না। মাথার ওপর থেকে মহীরুহের ছায়া হঠাৎ অপসৃত হওয়ায় অন্তরে-বাহিরে শুধুই খালি খালি লাগছে। ভাবতেই পারছি না এলিফ্যান্ট রোডের কণিকা ভবনে যাব কিন্তু আর কখনোই ওনার দেখা পাব না।

হাঁটতে হাঁটতে এলিফ্যান্ট রোডের ঔষধ ঘরের গলিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বাসায় এলাম সোজা। এই বাসায় যাবার পথে নিশান (শহীদ ডাক্তার আজহারুল হকের সন্তান)-দের বাসা। প্রজন্ম '৭১ গঠিত হবার অল্প সময় পর যুদ্ধাপরাধী-বিরোধী আন্দোলন সূচিত হবার কারণে আমাদের সাংগঠনিক কাজের জন্য নিশানদের বাসাটি বেশি সুবিধাজনক ছিল। ওদের বাসা থেকে তিনটি বাসা পার হলেই জাহানারা ইমামের বাসা। আজ ওদের বাসায় না গিয়ে আমি আর বাবুলদা এলাম কণিকায়। মানিকদা (বাসার কেয়ারটেকার) দরজা খুলে আমাদের দুজনকে দেখে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। নিজেদের বেদনা ভুলে মানিকদাকে সান্তনা দিতে দিতে আমরা দোতলায় বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম।

এই আন্দোলনের সূত্র ধরে কত স্মৃতি সঞ্চয় করেছি আমরা এই বাসাকে ঘিরে! ঐ তো সোফাখানা যেখনে বসতেন জাহানারা দাদী। একে একে দেশের বরেণ্য মানুষেরা আসতেন জরুরি সভা করতে। আর কখনোই তাকে দেখতে পাবো না, কথা শুনতে পাবো না, ফোন করবেন না – এসব ভাবনা মনের মাঝে ভীড় জমাচ্ছে আর গুমরে গুমরে উঠছি। মানিক দা আবার নীরবতা ভাঙ্গলেন, "আজ আমি এই বাসায় একা থাকতে পারব না। আপনাদের থাকতে হবে আমার সাথে।" আমি ও বাবুলদা কোন সময় না নিয়েই উত্তর করলাম, "এ বাড়িতে কত রাত থাকলাম। আপনাকে আজ একা রেখে চলে যাবার প্রশ্নই আসে না। আমরা অবশ্যই থাকব"। সোফার পাশে থাকা ল্যান্ড ফোন দিয়ে বাসায় ফোন করে শহীদ জননীর অনন্তযাত্রার কথা জানালাম, আর বললাম যে আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। আমি আর বাবুল দা থাকব কণিকায়।

ধীরে ধীরে চারপাশে আঁধার নেমে এলো। মানিকদা ভেতরে গেলেন। বৈঠকখানায় দুই সোফায় এখনো প্রায় নির্বাক হয়ে মুখোমুখি বসে আমরা দুজনে। চোখের তারায় ভেসে বেড়াচ্ছে কত স্মৃতি।

।।তিন।।

আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে ওনার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি। পরে জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে তার বাড়িতে শহীদ জননীকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেবে প্রজন্ম '৭১-এর সদস্যরা। পাশাপাশি আস্থাভাজন তরুণ সাংবাদিকদের একটি দল তাদের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে সময় সময় আসবে কণিকায়। প্রজন্ম '৭১-এর জন্য আমি ও জাহিদ ভাই (শহীদ মোহাম্মদ সাদেক-এর সন্তান ও প্রজন্ম '৭১-এর সাংগঠনিক সম্পাদক) মিলে একটা রোস্টার তৈরি করে আমাদের সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেই। রোস্টার তৈরি করার সময় যুগ্ম সম্পাদক আসিফ মুনীরও (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে) আমাদের সযোগিতা করেছিলেন। সে অনুযায়ী আমাদের ভাইবোনেরা জাহানারা ইমামের বাসায় পাহারা দিতে যেত। আমি নিজে রোস্টার ডিউটির বাইরে সকাল, দুপু্‌র সন্ধ্যা ও রাত সবসময় যখনই প্রয়োজন হতো হাজির থাকতাম কণিকায়। তিনিও আন্দোলনের প্রয়োজনে নানা কাজের জন্য যখন তখন আমাকে ডেকে পাঠাতেন।

।।চার।।

খুব ভোরে তিনি উঠে যেতেন ঘুম থেকে এবং উঠেই ডায়েরিতে লেখা তালিকা মিলিয়ে তার কমলা অথবা ধূসর রঙের ল্যান্ডফোন থেকে সবাইকে ফোন করতেন।

আমারও ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস কিন্তু তার ফোনের ক্রিংক্রিং শব্দে অনেকদিন ঘুম ভেঙেছে। তিনি ফোন করতেন মূলত সেদিনের কোন জরুরি কাজের বিষয়ে নির্দেশনা দিতে এবং বুঝেছি কিনা তা আমার কাছ থেকে আবার শুনে সন্তুষ্ট হলে ফোন রাখতেন। তা না হলে এই বিষয়টি আরও সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। এক্ষেত্রে তাকে ধৈর্য্যহারা হতে দেখিনি। আবার যখন তিনি ঢাকার বাইরে আন্দোলনের কাজে যেতেন বা তার চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন তখন পরবর্তী কয়েক দিনে কি কি কাজ করে রাখতে হবে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে যেতেন। নির্দেশনা মোতাবেক তার অনুপস্থিতিতে কণিকায় গিয়ে আমরা তখন কাজগুলো গুছিয়ে রাখতাম।

মনে পড়ছে অফসেট কাগজের ভালো কোয়ালিটির লম্বা খাম কিনে জামায়াত বাদে সকল সাংসদদের নাম কনস্টিটিউন্সি ও দলের নাম লিখে ভেতরে জাতীয় সমন্বয় কমিটির স্মারকলিপি পাঠিয়েছি। এই কাজে যুক্ত ছিলাম জুলফিকার মানিক, আশরাফ কায়সার, জাহিদুল হাসান, আমিসহ আরও কয়েকজন। একারণে ১৯ নভেম্বর ১৯৯৩-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শাহরিয়ার কবিরের কাছে লেখা চিঠিতে আমাদের প্রশংসা করেছেন জাহানারা ইমাম। তিনি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বোস্টন নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন ডিসি প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত স্মারকলিপিটি সাংসদদের কাছে পাঠাবার কাজে আমাদের সহযোগিতা নেবার জন্য শাহরিয়ার কবিরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

।।পাঁচ।।

সকল রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সমন্বয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রজন্ম '৭১-এর পক্ষে ছিলাম আমি বাবুল চন্দ্র দে ও জাহিদুল হাসান। তবে কখনো কখনো রবিউল আফতাব (শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার সন্তান) আমাদের সাথে হাজির থাকতেন তাহের মিলনায়তনের সভাগুলোতে। রাজনৈতিক দলের গতানুগতিক কর্মসূচির প্রতি জাহানারা ইমামের আগ্রহ কম ছিল। যদিও সমন্বয় কমিটির আন্দোলনে চিরাচরিত কর্মসূচি হিসেবে জনসভা বিক্ষোভ মিছিল মশাল মিছিল ঘেরাও অবরোধ-হরতাল ইত্যাদি পালন করতে হয়েছে কিন্তু শহীদ জননী সবসময় চাইতেন নতুন কিছু করতে। গণআদালত, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, কুশপুত্তলিকা দাহ ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্যে অভিনবত্ব থাকায় তিনি সেগুলো সাগ্রহে অনুমোদন করেছেন। একই ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি আমার প্রস্তাবিত মানববন্ধন কর্মসূচির ক্ষেত্রে। তাহের মিলনায়তনে জাতীয় সমন্বয় কমিটির মিটিংয়ে নতুন কর্মসূচি বিষয়ে আলোচনার একপর্যায়ে আমি প্রজন্ম '৭১-এর পক্ষে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের প্রস্তাব দিলে জাহানারা ইমাম এর অভিনবত্ব বিবেচনা করে সমন্বয়ের জন্য নেতাদের অনাগ্রহের বিপরীতে দ্রুত এই প্রস্তাব অনুমোদন করেছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় সমন্বয় কমিটির ব্যানারে সারাদেশব্যাপী পালিত হয়েছিল দেশের দীর্ঘতম মানববন্ধন কর্মসূচি। সে সময়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিল এই কর্মসূচি। এই সাফল্যের কারণে তিনি এত আনন্দিত হয়েছিলেন যে এর পরেরদিন কণিকায় তার বাসায় দেখা করতে গেলে নিজে চপ ভেজে খাইয়েছিলেন এবং কর্মসূচির প্রশংসা করতে করতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়েছিলেন।

মনে পড়ছে – এই আন্দোলনে আমাদের সময়ানুবর্তিতা, সক্রিয়তা, সিরিয়াসনেস দেখে সারা দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের জন্য ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে আয়োজিত সম্মেলনের নিবন্ধন-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রজন্ম '৭১কে। এ কাজে আমরা প্রজন্ম '৭১-এর একটি ছোট দল সফলভাবে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে তা কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রশংসিত হয়। জাহানারা ইমাম আমাকে বাসায় ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে আমাদের কাজে তার সন্তুষ্টির কথা জানান।

।।ছয়।।

কি করে ভুলব সেই ঈদের দিনের কথা! জাহানারা ইমাম আমাদের আগেই বারণ করে দিয়েছেন যে আমাদের কারুরই ঈদের সময়ে ওনার বাসায় পাহারা দিতে আসতে হবে না। আমরা যেন পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারি সেজন্যেই এই নিষেধাজ্ঞা। বারণ করার সময়ই জানিয়েছিলেন যে তিনি ঈদের দিন কণিকায় থাকবেন তিনটে পর্যন্ত। এরপরে আর থাকবেন না। বিষয়টি জানার পর থেকেই ঠিক করেছিলাম যে আমি ঈদের সাক্ষাৎ করতে যাবো ওনার বাসায়। ঈদের দিনে আম্মার রান্না করা বিশেষ কিছু খাবার তিনটি বক্সে ভরে ওনার বাসায় এসে হাজির হয়েছিলাম। উনার সাথে দেখা করতে এসেছি সেজন্য খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু কষ্ট করে খাবার বহন করেছি সেজন্য আমাকে মৃদু বকাঝকা করেছিলেন। "তোমাকে একটা নতুন খাবার খাওয়াব" বলেই আমাকে বসিয়ে শহীদ জননী ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে ট্রে হাতে ঢুকলে দেখি একটি বাটিতে পেস্তা, কাজু বাদাম আর কিসমিস দেয়া শুকনা সেমাই আর অন্য আর একটি বাটিতে একটি খাবার আইটেম এনেছেন যা আমি আগে কখনো দেখিনি। জানতে চাইলাম এটা কি। উনি সহাস্যে বললেন, "এটা খেয়ে দেখ। আমি বানিয়েছি। নতুন আইটেম – কখনো খাওনি"। বাটিতে তুলে নিয়ে চামচে করে মুখে নিতেই টক-মিষ্টি-ঝাল-এর এক মিশ্রিত স্বাদ পেলাম খুবই পছন্দ হলো আমার। নাম জানতে চাইলে বললেন, "এটি দই বুন্দিয়া"। আমি জাহানারা ইমামের কাছেই জীবনে প্রথম এই দই বুন্দিয়া খেয়েছিলাম, যা এখন আমার পছন্দের খাবারের একটি।

আমার খাওয়া শেষ হতেই বললেন, "শোন, একটু পরে বেরিয়ে যাব – হাইডিং-এ যাচ্ছি। কেউ জানবে না আমি কোথায় আছি। আমারও দুদিন রেস্ট দরকার"। আমি মাথা নেড়ে বললাম, "খুব ভালো হবে, দাদি। আপনি বিশ্রাম নিয়ে ফিরুন। আবার তো আন্দোলনের কাজ শুরু হবে"। কৌতুহলের বশে জিজ্ঞেস করলাম, "ঢাকাতেই থাকবেন?" মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি টেনে বললেন, "বলব কেন?" আমি একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, "না, না বলতে হবে না"। একথা শুনে তিনি কেটলি থেকে চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, "তোমাকে বলি – কাউকে বলবে না – শাহরিয়ার জানে – আমি দুদিন থাকব জুয়েলের বাসায় -মানে বিশ্বনন্দিত যাদুকর জুয়েল আইচের বাসায়। ওখানে থাকলে আমার কোন ভয় নেই। ও যাদু দিয়ে আমাকে অদৃশ্য করে রাখবে!" একটু থেমে আবার বললেন, "ওর বাসাতে থাকলে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারি"। চা পান করা শেষ হতেই তিনি বললেন, "তুমি এখন যাও। বাসায় গিয়ে পরিবারের মানুষদের সাথে আনন্দ করো। আর যাবার সময় দরজাটা ঠিক করে আটকে দিও। একটু পরে জুয়েল এসে আমাকে নিয়ে যাবে"। বেরিয়ে যাবার আগে উনার পায়ে হাত ছুঁয়ে ঈদের সালাম করতে গেলে "পায়ে হাত দেবে না, একদম পায়ে হাত দেবে না" বলে হৈ হৈ করে উঠলেন। আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত ছুঁয়ে হাসিমুখে বললেন, "দীর্ঘজীবী হও"। শহীদ জননীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আমি বাড়ীর পথ ধরলাম।

।।সাত।।

রাত গভীর হচ্ছে। বাবুল দা আর আমি মুখোমুখি দুই সোফায় বসে নিজেদের মতো মেমোরি লেনে হেঁটে বেড়াচ্ছি। চারধার শুনশান। নীরবতা ভেঙ্গে নিজের অজ্ঞাতেই আমার কন্ঠে উঠে আসলো কিছু গানের কলি – আমি কন্ঠ উচু করে গাইতে লাগলাম

"আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত…"

বাবুলদার চোখে জল। আমার চোখও ক্রমশঃ ঝাপসা আসছে। কাল সকালে মানিকদার কাছে চাবিটি দিয়ে ফিরে যাবো বাসায়। জাহানারা ইমামের নির্দেশে কণিকায় ঢোকার জন্য আমার কাছে একটি চাবি দিয়েছিলেন মানিকদা। অনেক সময় বিভিন্ন কাজে যখন জাহানারা ইমাম বা মানিকদা কেউই বাসায় নেই তখন কোন কাজের প্রয়োজন থাকলে আমি চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে পারতাম। চাবিটি রাখার প্রয়োজন নেই আর।