পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িকতা: চেতনা যখন অবচেতনে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 Jan 2012, 03:16 PM
Updated : 26 Jan 2020, 08:53 AM

আমরা ধরে নেই এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। শেখ হাসিনার কারণেই এমন ভাবনা। বাদ বাকী অন্যকিছু এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। এই সরকারের আমলে নানা বিষয়ে মৌলবাদের দাপট পরে তাদের সাথে আপসকামিতা দেখেছি আমরা। মতিঝিলের ঘটনায় ঢাকাকে অস্থির করা, দেশ তোলপাড় করার সময় হঠাৎ-ই সামনে চলে আসে হেফাজত। সত্যি বলতে কি আমরা চট্টগ্রামের মানুষ হবার পরও এই সংগঠনের তেমন কোনো নামডাক শুনিনি। তাদের নেতারাও ছিলেন অপরিচিত। শফি হুজুরের হঠাৎ আগমন জামায়াতের পর সংঘবদ্ধ কোনো ধর্মীয় শক্তির প্রকাশ, যার সাথে প্রায় সব রাজনীতিই হাত মিলিয়েছে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ গিয়েছিলেন দোয়া চাইতে। তিনি অবশ্য মতিঝিলের ঘটনার দিন সমাবেশে আগত মুসুল্লীদের পানি পান করানোর জন্যও নির্দেশ জারি করেছিলেন। অথচ সেই থেকে আজ অবধি তারা আওয়ামী লীগের জোটমিত্র বা সহায়ক রাজনৈতিক দল। খালেদা জিয়ার বিএনপি তখন সুযোগ নেয়ার জন্য সরাসরি ইন্ধন দিয়ে মাঠে নেমে গিয়েছিল। তাদের কদর্য রাজনীতি সে সময়ই মূলত আত্মঘাতী পথে হাঁটে, তার নিজের পায়ে কুড়াল মারে। মূলত সব বড় দলগুলোই যেকোনো কারণে ধর্মীয় রাজনীতির নতুন দল হেফাজতকে আমলে নিতে শুরু করে। যার পথ ধরে আওয়ামী লীগও বুঝে যায় তাদের কৌশল পাল্টাতে হবে। হঠাৎ করে লাইমলাইটে চলে আসা শফি হুজুর আর বাবুনগরীরা এখন নীরব হলেও তাদের তোয়াজ করা আর খুশি রাখার নানা কাজ কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতকে আঘাত হানতে প্রস্তুত। ২০১৭ সালে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি নিউজ নতুন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। নিউজটা এমন:

"অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শ্রেণির বাংলা বই 'সাহিত্য সংকলন' থেকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' ও জ্ঞানদাসের 'সুখের লাগিয়া', ভারতচন্দ্রের 'আমার সন্তান', লালন শাহের 'সময় গেলে সাধন হবে না', রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'স্বাধীনতা' ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সাঁকোটা দুলছে' বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে শাহ মোহাম্মদ সগীরের 'বন্দনা', আলাওলের 'হামদ', আব্দুল হাকিমের 'বঙ্গবাণী', গোলাম মোস্তফার 'জীবন বিনিময়' ও কাজী নজরুল ইসলামের 'উমর-ফারুক'।

অষ্টম শ্রেণির বাংলা দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'রামায়ণ-কাহিনী' বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই সপ্তবর্ণাতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'লাল ঘোড়া' বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে হবীবুল্লাহ বাহারের 'মরু ভাস্কর'। অন্যদিকে, ষষ্ঠ শ্রেণির দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ থেকে শরৎচন্দ্রের 'লালু' ও সত্যেন সেনের 'লাল গরুটা' এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাংলাদেশের হৃদয়' বাদ দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালরে মে মাসে হেফাজতে ইসলাম প্রধানমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে এবং ইসলামী ঐক্যজোট সংবাদ সম্মেলন করে পাঠ্যবই 'সংশোধনে'র দাবি জানিয়েছিল। ওই সময় অবিলম্বে পাঠ্যবই সংশোধন না হলে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিলো কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড।

সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, এসব কারণে পাঠ্যবইয়ে এত ব্যাপক পরিবর্তন এনে অমুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও এমন অভিযোগ সত্যি নয় বলে দাবি করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'এই অভিযোগ সঠিক নয়। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।" সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ অনেকের লেখা বাদ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাদের অবদান মানুষ ভুলে যায়। এটা খুব বেদনাদায়ক।

ঘটনা খেয়াল করুন। এসব অশুভ পরিবর্তন জায়েজ করানোর জন্য সামনে আছে একজন হিন্দু। নারায়ণ সাহা বলছেন ঘটনা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। কি জঘন্য আর নীচু মনের কথা। বাধ্য হয়ে বলুক, মনের আনন্দে বলুক বা চাকরির প্রয়োজনে বলুক একজন অমুসলিমকে দিয়ে এসব বলানোর ভেতর যে রাজনীতি তা আমরা বুঝি। মানুষও বোঝে। কিন্তু এতে কি সমস্যার ভার লঘু হবে না পাপ কমবে?

একটা কথা বলা দরকার, শুধু বাংলা বই সমস্যা? ইংরেজিতো আমাদের দেশে অবশ্য পাঠ্য একটা বিষয়। প্রাইমারি, সরকারি, বেসরকারি সব লেভেলে ইংরেজি জরুরি একটা বিষয়। বিশেষত প্রাইভেট বা বেসরকারি খাতে এখন ইংরেজির রমরমা। রবীন্দ্রনাথের মত কবির কবিতা যদি 'দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে' বাক্যের মন্দির শব্দের জন্য বাদ দিতে হয় ইংরেজি সাহিত্যেতো শতবার চার্চ বা লর্ডের কথা আছে, তার বেলায় কি হবে? অমুসলিম নামগুলো যদি ফ্যাক্টর হয় শেক্সপিয়র, শেলি কিটস বা মিলটন কি এমন পূণ্য করলেন যে তাদের নাম রাখতে হবে? বিষয়টা বুঝতে কষ্ট হবার কথা না। মূলত ভারতের নামে হিন্দু বিরোধিতার মূল্য চুকাচ্ছেন ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

এই প্রবণতা ভালো না। বাদ গেলে বা যোজিত হলে এদের কারো কিছু আসবে যাবে না। এরা সবকিছুর ওপরে। যা কিছু ভুল-ভ্রান্তি আর পাপ তার মূল্য দিতে হবে জাতিকে। এই ভুল আমাদের নতুন প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে ভাবতেও ভয় লাগে। আমরা চেতনার ধারক নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের আমলে যা দেখছি তার সাথে কি বঙ্গবন্ধু বা চার জাতীয় নেতার ইমেজ কিংবা আদর্শ যায়? না সমার্থক? আজকের আওয়ামী লীগ ধুমধাম আর উৎসবে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করলেও মনে ধারণ করে কি না তা প্রশ্নময়। মুজিববর্ষের প্রাক্কালে এমন একটা ঘটনা তাদের আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। প্রশ্নবিদ্ধ করল মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও মহিউদ্দীন চৌধুরীর পুত্র নৌফেলের ভূমিকা। তারা কি ঘুমিয়ে আছেন? না তারা এসব জানেন না? আমরা ধরে নিতেই পারি তাদের অনুমোদনেই হচ্ছে সব। তাহলে কার কাছে কি চাইবে জাতি?

প্রশ্ন একটাই কাদের খুশি করার জন্য এসব করা হচ্ছে? কোন অপশক্তিকে তোয়াজ করে এত সব অঘটন ঘটানো? তারা কি আওয়ামী লীগ বা কাউকে ছাড় দেবে? তাদের টার্গেট আসলে এখন আর আওয়ামী লীগ না তাদের টার্গেট প্রগতিশীলতা। সে কাজটি বা পথটা সুগম করে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দল নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের সরকার। আর একটা বিষয় বেদনার। যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তাদের পরিবর্তে এদেশের নতুন বা সামনে আসা লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাদের কারো কথা মনে পড়েনি কর্তাদের। তারা চায় এদেশের সবকিছু প্রতিক্রিয়াশীলদের দখলে যাক। বলাবাহুল্য সেদিন এই আওয়ামী লীগারদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকের মুজিবকোটগুলো সেদিন সাফারী বা জোব্বা হলেও অবাক হবো না।

বিএনপি এরশাদ সরকার যা করেনি সে পাপ, সে ভুল হচ্ছে আওয়ামী আমলে। এমনিতেই দেশে মেধা, প্রতিভা, মুক্তবুদ্ধি আছে বিপদে। টাকা পয়সা ধনে সম্পদে বাড়লেও সমাজ মানসিকভাবে বাড়ছে না। নবীন প্রজন্মে সঠিক চিন্তা, লেখাপড়া বা জ্ঞানের অভাব বলে ফাল পাড়া অভিভাবকরা তাদের হাতে কী তুলে দিচ্ছেন সেটাই তারা ভাবেন না।

পাঠ্যক্রমে অপশক্তির এই দৌরাত্ম্য প্রমাণ করে চেতনাবাহী নামে পরিচিত সরকার আজ ঘুমে অবচেতনে।  আমি নিশ্চিত পাঠ্যপুস্তকে অমুসলিম লেখকের লেখা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া জারি আছে। এ সংক্রান্ত কোন সাম্প্রতিক সংবাদও চোখে পড়েনি। এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরনো ব্যাপারটি যাতে ধামাচাপা পড়ে না যায়, যাতে অনেক ভাইরাল খবরের মধ্যে হারিয়ে না যায়- সেটি মনে করিয়ে দেওয়া।

কি যে হবে আমাদের? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শেষ ভরসা। জানি না তিনি এতোদিনে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না!