দৃষ্টি সংযত রাখা ইসলামী পর্দার একটি মৌলিক বিষয়…

পুস্পিতা
Published : 12 April 2011, 10:52 AM
Updated : 12 April 2011, 10:52 AM

আমাদের মাঝে একটি বিষয় প্রচলিত পর্দা শুধুমাত্র নারীদের সাথে সম্পর্কিত এবং পর্দা মানে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পোষাক বা নির্দিষ্ট ভাবে কাপড়-চোপড় পরাকে বুঝায়। কিন্তু ইসলামের আলোকে পর্দা একটি ব্যাপক বিষয় এবং তা পুরুষ নারী উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত। পোষাক পর্দার একটি অংশ। কিন্তু শুধু পোষাকই পর্দা নয়।

সুরা নুরে আল্লাহ বলেছেন, "হে নবী, মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। … আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।"

এ আয়াতটি সরাসরি দৃষ্টি সংযত রাখার সাথে সম্পর্কিত। এখানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সবাই যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে। এর অর্থ অবশ্য সবসময় দৃষ্টি নিচের দিকে রাখা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, পূর্ণ দৃষ্টি ভরে না দেখা এবং দেখার জন্য দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে না দেয়া। অর্থাৎ যে জিনিসটি দেখা সংগত নয় তার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হবে। আবার এর মাধ্যমে সমস্ত দৃষ্টি সংযত করার হুকুম দেয়া হয়নি বরং কোন কোন দৃষ্টি সংযত করতে বলা হয়েছে। এখানে পুরুষদের মহিলাদরকে দেখা অথবা অন্যদের লজ্জাস্থানে দৃষ্টি দেয়া কিংবা অশ্লীল দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ হুকুমটির ব্যাখ্যা হাদীসে যেভাবে করা হয়েছেঃ
নিজের স্ত্রী বা মুহাররাম নারীদের ছাড়া কাউকে নজর ভরে দেখা পুরুষের জন্য ঠিক নয়। তবে হঠাৎ নজর পড়ে গেলে ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হলে সেখানে আবার দৃষ্টিপাত করা ক্ষমার যোগ্য নয়।
নবী (সা) এ ধরনের দেখাকে চোখের যিনা বলেছেন। তিনি বলেছেন, "মানুষ তার সমগ্র ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যিনা করে। দেখা হচ্ছে চোখের যিনা, ফুসলানো কন্ঠের যিনা, তৃপ্তির সাথে কথা শোনা কানের যিনা, হাত লাগানো ও অবৈধ উদ্দেশ্য নিয়ে চলা হাত ও পায়ের যিনা। ব্যভিচারের এই সব ভূমিকা যখন পুরোপুরি পালিত হয় তখন লজ্জাস্থানগুলো তাকে পূর্ণতা দান করে অথবা পূর্ণতা দান থেকে বিরত থাকে। (বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদ )

হযরত বুরাইদাহ বর্ণনা করেছেন, নবী (সা) হযরত আলীকে (রা) বলেন, "হে আলী! এক নজরের পর দ্বিতীয় নজর দিয়ো না। প্রথম নজর তো ক্ষমাপ্রাপ্ত কিন্তু দ্বিতীয় নজরের ক্ষমা নেই।" (আহমাদ,তিরমিযী, আবু দাউদ, দারেমী)

হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ বাজালী বলেন, আমি নবী (সা) কে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ চোখ পড়ে গেলে কি করবো৷ বললেন, চোখ ফিরিয়ে নাও অথবা নামিয়ে নাও। (মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস, নবী (সা) আল্লাহর উক্তি বর্ণনা করেছেন, "দৃষ্টি হচ্ছে শয়তানের বিষাক্ত তীর গুলোর মধ্য থেকে একটি তীর, যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে তা ত্যাগ করবে আমি তার বদলে তাকে এমন ঈমান দান করবো যার মিষ্টি সে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে।" (তাবারানী)

আবু উমামাহ রেওয়ায়াত করেছেন, নবী (সা) বলেন, "যে মুসলমানের দৃষ্টি কোন মেয়ের সৌন্দর্যের ওপর পড়ে এবং এ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, এ অবস্থায় আল্লাহ তার ইবাদাতে বিশেষ স্বাদ সৃষ্টি করে দেন।" (মুসনাদে আহমাদ)

ইমাম জাফর সাদেক তাঁর পিতা ইমাম মুহাম্মাদ বাকের থেকে এবং তিনি হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারীর থেকে রেওয়ায়াত করেছেন, "বিদায় হজ্জের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাত ভাই ফযল ইবনে আব্বাস (তিনি সে সময় ছিলেন একজন উঠতি তরুণ) মাশআরে হারাম থেকে ফেরার পথে নবী করীমের (সা) সাথে তাঁর উটের পিঠে বসেছিলেন। পথে মেয়েরা যাচ্ছিল। ফযল তাদেরকে দেখতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুখের ওপর হাত রাখলেন এবং তাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলেন।" (আবু দাউদ)

আরেকবার খাসআম গোত্রের একজন মহিলা পথে রসূলুল্লাহক (সা) থামিয়ে দিয়ে হজ্জ সম্পর্কে একটি বিধান জিজ্ঞেস করছিলেন। ফযল ইবনে আব্বাস তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। নবী (সা) তার মুখ ধরে অন্য দিকে ফিরিয়ে দিলেন। (বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ)

দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশের এ অর্থও হতে পারে যে, কোন নারী বা পুরুষের সতরের প্রতি মানুষ দৃষ্টি দেবে না। নবী (সা) বলেছেন, "কোন পুরুষ কোন পুরুষের লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি দেবে না এবং কোন নারী কোন নারীর লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি দেবে না।" (আহমাদ, মুসলিম, আবুদ দাউদ, তিরমিযী)

এ সমস্ত কুরআন-হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, দৃষ্টি সংযত রাখা পর্দার একটি মৌলিক বিষয়। আবার পর্দা করা শুধুমাত্র মহিলাদের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী পর্দা করতে হবে। তাই পর্দা পুরুষ-নারী উভয়ের জন্যেই প্রযোজ্য। তবে ধরন ভিন্ন।

আরেকটি মৌলিক কথা হলো, বর্তমান সময়ে উপরোক্ত কুরআন-হাদীস অনুযায়ী যদি পুরুষরা নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখত তাহলে আমাদের দেশে ইভ-টিজিং নামের অনাচার থাকতো না। এসিড নিক্ষেপের মতো জুলুমের কাজ চলতো না। অশ্লীল ছবি, ভিডিও সেটা ইন্টারনেটে হোক, টিভিতে হোক দেখার চিন্তাও আসতো না। অশ্লীল বিষয় শুনা, পড়া ইত্যাদী থেকে সবাই বিরত থাকত। এই বিধান সবাই যদি মেনে চলে তাহলে চারিত্রিক অধঃপতন থেকে যুব সমাজ রক্ষা পাবে।