এখন পারেন শুধু তিনিই

আবেদ খান
Published : 12 June 2014, 08:25 PM
Updated : 12 June 2014, 08:25 PM

সাতচল্লিশের দেশবিভাগের প্রায় পর থেকেই আমরা ঢাকা শহরে ঠাঁই নিয়েছি। এই সুদীর্ঘ সাতষট্টি বছরে আমার জানামতে একটি সংখ্যালঘু পরিবারের কোনো সদস্য তা তিনি হিন্দুই হোন কিংবা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান অথবা আদিবাসী যে-ই হোন না কেন, কারও কোনো উচ্চারণে মুসলমান ধর্ম সম্পর্কে সামান্যতম কটুবাক্য আমি শুনিনি। তাদের কেউ কখনও ঘরোয়া বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও ভিন্ন ধর্মের বা ধর্মপ্রবর্তকের বিরুদ্ধে সামান্যতম নিন্দাবাক্য ব্যবহার করেননি।

সাতচল্লিশের দেশবিভাগ অন্ততঃপক্ষে তৎকালীন পূর্ববাংলায় বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তেমনভাবে মেনে নিতে পারেননি কিংবা রাজনৈতিক পাশাখেলার চাল বা দ্বিজাতিতত্ত্বের বোলচাল তাদের এতটুকু আলোড়িত করেনি। এজন্য সাতচল্লিশের আগে থেকেই দাঙ্গা বাধিয়ে বারবার তাদের ভয় এবং অসহায়ত্ব প্রবিষ্ট করা হয়েছিল যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দেশত্যাগ এবং সবকিছু ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ।

এই অসহায়ত্ব, এই বিপন্নদশা তাদের গোটা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তাদের কারও পক্ষে এমন কোনো ভূমিকা গ্রহণ কিংবা বাক্যপ্রয়োগ কখনও সম্ভব হয়নি যা তাদের সার্বিক অর্থে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, দুর্ভাগ্য আমাদের এবং দুর্ভাগ্য এদেশের বিবেকবান অসাম্প্রদায়িক মানুষের। যে রাজনৈতিক স্বার্থে, বৈষয়িক স্বার্থে যে কোনো ধরনের ক্ষুদ্র সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে এদেশে বারবার তাদের ওপর ঝামেলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত দেড় বছরে এই ঘটনা অন্যান্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘটেছে। এই সময়কালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি আসবাবপত্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন উপাসনালয়ের ওপর যে তাণ্ডবীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।

রামুর প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, সহস্রাধিক বৎসরের প্রাচীন বিগ্রহ ভাঙচুর থেকে শুরু করে বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর গত চার দশকের অধিককাল ধরে নানাভাবে পীড়ন চলেছে। তাদের জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাদের ক্রমাগত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছে।

আমার সরাসরি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই কি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের নমুনা? এই কি আমাদের গণতান্ত্রিক মন ও মানসিকতার পরিচয়? এই কি আমাদের সংবিধানে বর্ণিত সকল মানুষের প্রতি সমান অধিকারের অঙ্গীকারের চিত্র?

সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি এদেশে বসবাসরত এমন একটি সংখ্যালঘু পরিবারকে দেখিনি কিংবা এমন কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে এই আশাবাদ শুনিনি যে তিনি পারিবারিকভাবে, বৈষয়িকভাবে, সামাজিকভাবে নিরাপদ বোধ করছেন। আমার এই উচ্চারণ দায়িত্ব নিয়ে করা উচ্চারণ।

যে কথা আমি এখন আমার জন্মসূত্রের অধিকারের কারণে এদেশে বলতে পারছি, সে কথার একটি বর্ণও প্রকাশ্যে উচ্চারিত হবে না কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি শিশুর মুখেও। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, গত দেড় বছর ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত হামলার পেছনে অজুহাত একটাই– ফেসবুকে রসুলকে নিয়ে অশ্লীল স্ট্যাটাস এবং সর্বক্ষেত্রেই অভিযুক্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবক।

আরও অদ্ভুত যে, পুলিশ যখন বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, তারা সেই স্ট্যাটাসের প্রিন্ট আউট বের করে নানা কৌশলে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যে প্রকৃতপক্ষে অপরাধটি যুবকেরই। আর নিরপেক্ষতার মোড়কে নিজেকে সাজিয়ে অত্যন্ত নিরীহভাবে বলার চেষ্টা করে, যুবকটি না বুঝেই করেছে, কিংবা দুষ্ট সঙ্গীর পাল্লায় পড়ে করেছে। এভাবে তদন্তের সূচিমুখ ঘুরে যায়। প্রশাসন যন্ত্রও ঠিক ওই ধারাতেই কার্যক্রম চালাতে থাকে।

এজন্যই এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কিংবা তার আগেও পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার কিংবা তাদের বিষয়সম্পত্তি দখল করে দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রশ্নে কোনো অপরাধী খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য এখন আমাদের দেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচার চলছে। কিন্তু তা দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বস্তি হবে না, কিংবা তাদের সামান্যতম নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে না।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের যে কোনো নিরাপত্তা গত সাতষট্টি বছরেও নিশ্চিত হয়নি তার একটা সাধারণ পরিসংখ্যান এখানে তুলে ধরা যেতে পারে–

১৯৪৭ সালে বিভাগের সময় এই অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৩৮% এর কিছু বেশি। ৫০-এর দাঙ্গা এবং তৎপরবর্তীতে লিয়াকত-নেহরু চুক্তির পর এই সংখ্যা ৩৫ ভাগে নেমে আসে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এই সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়ে ৩০%-এ দাঁড়ায়। এরপর এই হার কমতে কমতে ২২% এ এসে ঠেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সবচাইতে সুরক্ষিত থাকার কথা ছিল সেখানে দেখা গেল এই সংখ্যা যেন থমকে রইল এবং পঁচাত্তরের মমান্তিক রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের পর অতিদ্রুত সেটা হ্রাস পেতে থাকল। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই নিয়ে তৃতীয় দফা শাসনক্ষমতায় এল। কিন্তু তাতেও কি এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এতটুকু নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে?

না, পারেনি। কারণ তারা পরম বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে, পীড়নকারীর চেহারা বদলেছে কিন্তু পীড়নের মাত্রা রয়ে গেছে তেমনটিই। এমন কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা আইনগত ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি এই আমলেও যা তাদেরকে অন্তত এই ধারণা দেবে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক সরকারই তাদের নিরাপদ আশ্রয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা রাজনৈতিক দর্শনে অসম্প্রদায়িক হতে পারেন, কিন্তু যে প্রশাসনযন্ত্র, যে রাজনীতি-প্রতিবন্ধী স্বার্থসন্ধানী, বিবেকহীন গোষ্ঠী, যে আদর্শবিবর্জিত অকর্ষিত চেতনাবিবশ এক শ্রেণির নেতাকর্মী দ্বারা তিনি ক্রমাগত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন, সেটা তাঁর জন্য যে কল্যাণকর হবে না। অথচ এখনও তাঁর হাতে আছে সংকট-মোচনের অমিত সম্ভাবনা।

বাস্তব সত্য হচ্ছে, এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস রাখে তাঁর ওপর– তাঁর দলের ওপরে নয়, তাঁর কর্মীবাহিনীর ওপর নয়, যে প্রশাসনযন্ত্রের ওপরে তিনি আসীন সেই প্রশাসনযন্ত্রের ওপরও নয়। কাজেই সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে, কারণ তিনি এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারীদের সর্বশেষ ভরসার মানুষ। এখন তাঁর হাতেই এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পতাকার অস্তিত্ব, জাতীয় সঙ্গীতের অস্তিত্ব, জাতির জনকের অস্তিত্ব।

তিনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে কতকগুলো বিষয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। জানি না, এই বিষয়গুলো তাঁর পার্শ্বচরদের কেউ তাঁকে অবহিত করেছেন কিনা। সাহস করে কেউ যদি এই সত্যগুলো তাঁর কাছে তুলে ধরতেন তাহলে বোধ করি তিনি অনুধাবন করতেন এবং দেশের ও তাঁর খারাপ হত না।

প্রথমত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন:

নিবন্ধের প্রথমদিকে যে পরিসংখ্যান আমি তুলে ধরেছি তা তথ্যভিত্তিক এবং সেই কারণেই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পাকিস্তান আমলের কথা বাদ দিলাম, বাংলাদেশ আমলে কেন এভাবে এই আশঙ্কাজনক হ্রাসের চিত্র দেখতে হবে?

পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ২২% থেকে বেড়ে বর্তমানে ৩৩%-এ দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা গুরুতরভাবে কমছে। কেন ঘটছে এই ঘটনা? কারণ তাঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো রকম নিরাপত্তা পাচ্ছে না। কোনো রাজনৈতিক নীতিমালা কিংবা কার্যক্রমে তাদের অবস্থান বিবেচিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় তাদের সংখ্যা ছিল ২২%। অথচ ৭৫-এর পর থেকে সুদীর্ঘ একুশটি বছর ধরে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হল, তাদের বিশাল অংশকে সুকৌশলে দেশত্যাগে বাধ্য করা হল কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের সমর্থক এই ছুতোয় এবং তাদের পরিত্যক্ত বিষয়সম্পত্তি গ্রাস করার লোলুপ বাসনায়।

ছিয়ানব্বই-এ আওয়ামী লীগ সরকার এল, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হল না। তখনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শতকরা হার ছিল ১৭%-এ মতো। কিন্তু যখন দেখা যায় সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলটি উঠে পড়ে লাগছে শতকরা ৫ ভাগের অধিকারী জামায়াতকে তোয়াজ করার জন্য বিভিন্ন নীতিমালা প্রণীত হচ্ছে, যাতে তারা অসন্তুষ্ট না হয় সেজন্য, তখন তাদের মধ্যে অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই আস্থার সংকটের সূত্রপাত ঘটে।

উগ্র ধর্মবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চুক্তিসম্পাদন যে কেবলমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই নয়, বিশাল সংখ্যক নারীসমাজ এবং বিশাল নতুন প্রজন্ম ও প্রগতিশীল সমাজকেও আশাহত করেছিল। ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দল সেই চুক্তি থেকে পিছিয়ে এলেও দল এবং সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের যে হতাশার সৃষ্টি হয় তার প্রতিফলন দেখা যায় ২০০১ সালের নির্বাচনে।

নির্বাচন-পরবর্তী ভয়াবহ সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নিধন-পর্বের ফলে অসহায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আবার বাধ্য হয়ে ফিরে যায় আওয়ামী লীগের আশ্রয়পুটে। সরকারের উচিত ছিল জনগণের শতকরা সাড়ে ৯ ভাগের আস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে স্থায়ী সমর্থকের উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু সেই কাজটি হয়নি।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রে একটি মামলা প্রক্রিয়াও চালু হয়নি–তথাকথিত শত্রুসম্পত্তি আইনকে নানা আইনি আচ্ছাদনে বহাল রাখা হয়েছে।


দ্বিতীয়ত, তরুণ প্রজন্মের জাগ্রত চেতনা ব্যবহার:

এ ক্ষেত্রেও সমধিক দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। দেশে নতুন প্রজন্মের ভোটারের সংখ্যা আনুমানিক আড়াই কোটি এবং এদের ভেতরকার বিশাল অংশ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে জয়ী করেছিল। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের, বিচার ও চরমদণ্ড বিধানের দাবিতে। সরকার এবং বিশেষভাবে বলব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় উদ্যোগের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে এবং জনাদশেকের রায়ও প্রদান করা হয়েছে। একজনের দণ্ড কার্যকর করা হলেও আইনি জটিলতার চক্রে পড়ে রায় কার্যকর প্রক্রিয়া ঝুলে গেছে।

তার ফলে নতুন প্রজন্মসমেত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জানি না, প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা করার মতো যথাযথ রাজনৈতিক পরামর্শক আছে কিনা। নতুন প্রজন্ম কিন্তু অপরিমেয় শক্তির অধিকারী। সেই শক্তি দৃশ্যমান নয় এবং তাকে কোনো বাহ্যিক শক্তি দিয়ে হয়তো সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়, কিন্তু পরাজিত করা যায় না। বায়ান্নর শক্তি, চুয়ান্নর শক্তি, বাষট্টি কিংবা ঊনসত্তর অথবা একাত্তরের শক্তি থেকেই এই শক্তির অভ্যুদয়।

রাজনীতিকের উত্তরাধিকার হিসেবে এবং সুদীর্ঘ সক্রিয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আলোকিত শেখ হাসিনা অবশ্যই তাঁর পথচলায় এই শক্তিকে জয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভোটশক্তির তুলনায় নতুন প্রজন্মের কিংবা নারীর ভোটশক্তি কয়েকগুণ বেশি– এটা প্রমাণিত হয়েছে বহুবার। মিশরে মুরসির মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো শক্তিশালী সংগঠনও কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে প্রগতিশীল নতুন প্রজন্মকেও জয় করতে পারেনি– তাই বিনাশের মাধ্যমেই তার চরম মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে।

ভারতের নির্বাচনেও কিন্তু যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতাই জয়ী হয়েছে, ধর্মান্ধতা নয়। এমনকি নরেন্দ্র মোদীর মতো ঘোরতর দক্ষিণপন্থীকেও ধর্মের লেবাস পরিত্যাগ করতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশার কারণে। কংগ্রেসের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠনও নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন ঠিকমতো স্পর্শ করতে না পারায় তাদেরকে বরণ করতে হয়েছে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম পরাজয়।

তাই বলছি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আজ দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অনুপম সুযোগ লাভ করেছেন, তার সদ্ব্যবহার করতে পারলে ইতিহাসের স্বর্ণদ্বার উন্মুক্ত হবে তাঁর জন্য।

তৃতীয়ত সংগঠন:

আওয়ামী লীগের সবচাইতে শক্তিশালী অঙ্গ ছিল এর সংগঠন। এই সংগঠনের বিস্তার ছিল গ্রামের পর্ণকুটির পর্যন্ত। নির্বাচনী প্রতীক নৌকা ছিল সাধারণ মানুষের আবেগের প্রতীক। সততা, নিষ্ঠা এবং দলীয় আনুগত্য ছিল এই সংগঠনের প্রাণশক্তি। এই সংগঠনের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত কিংবা ক্ষুদ্র ধনীর অন্তরের ভাষা এবং আবেগ বোঝা এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা।

বঙ্গবন্ধু সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনে মন্ত্রিত্ব পরিত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ মূল আওয়ামী লীগের মূলমন্ত্রই ছিল সংগঠন। দলের নেতৃত্ব বিশ্বাস করতেন যে, সরকার গঠিত হবে দলের নেতৃত্বে, আবার দল পরিচালিত হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় মূল্য দিয়ে। সংগঠন যদি অথর্ব এবং মেরুদণ্ডহীন হয় তাহলে সরকার হয়ে ওঠে আমলানির্ভর এবং স্বেচ্ছাচারী।

আর যখন আমলানির্ভরতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা সরকারের ওপর ভর করে তখন অতি সহজে সেখানে দুর্নীতির আবাস গড়ে ওঠে। আবার সরকারের মধ্যে যখন দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটে তখন তা সংক্রমিত হয় দলের ভেতরেও। এই দুর্নীতি যখন প্রসারিত হতে থাকে তখন শাখা বিস্তার করে নানাবিধ অপরাধ এবং তা ক্রমান্বয়ে ঘুণপোকার মতো প্রশাসন ব্যবস্থাকেও ঝরঝরে করে দেয়।

এই অনুভব যে কতখানি বাস্তবসম্মত তা বোঝা যায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর বর্তমান চেহারা দেখলে। এই অবস্থায় কেবলমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব সংগঠনের মরা গাঙে জোয়ার সৃষ্টি করা। সে ক্ষেত্রে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা আনতে তাঁকে কঠোর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।

আজ আওয়ামী লীগের প্রচারাভিযান সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বর্ণাঢ্য সেমিনার এবং ব্যয়বহুল সুদৃশ্য পোস্টার প্ল্যাকার্ড আর মুখস্ত শ্লোগানে। এখনও যদি সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে সরকারের সাফল্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেন এবং স্বাধীনতাবিরোধী-জঙ্গিবাদী শক্তি ও তার মদদাতাদের স্বরূপ উদঘাটনের উদ্যোগ নেন তাহলে দলের ঘুরে দাঁড়াবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে।

সরকার কিংবা সরকারের প্রধান এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা অথবা তাঁর দল বা সরকার আমার কথা মানতে পারেন, অথবা নাও মানতে পারেন। তবে একদিন অতীতের লেখা ঘাঁটলে একটি সত্যই উঠে আসবে যে, যত তিক্তই মনে হোক না কেন আমরা যারা পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি তা হয়তো অযাচিত, কিন্তু ক্ষতিকর নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সেই সব মন্ত্রী এবং সাংসদ সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেন যাঁদের ব্যাপারে জনমনে নেতিবাচক পারসেপশন তৈরি হয়েছে এবং যদি কারও ব্যাপারে পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি মন্তব্য প্রদান থেকে বিরক্ত থাকেন, তাহলে তা সরকার ও দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।

ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, ফুলগাজীর আওয়ামী লীগ নেতা খুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে দলীয় সংগঠনের ভেতরকার খুনাখুনি এবং দলাদলি সংগঠনকে কোণঠাসা এবং বিরোধীদের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এ সবই সামলাতে হবে তাঁকেই, কারণ তিনি একটি তেজি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন।

আর তিনিই দেশের স্বাধীনতার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার সর্বশেষ ভরসাস্থল।

আবেদ খান: সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।