আনন্দময়ী মজুমদারের তিনটি কবিতা

আনন্দময়ী মজুমদার
Published : 11 Jan 2019, 03:37 PM
Updated : 11 Jan 2019, 03:37 PM


চিত্রকর্ম: মোহাম্মদ ইকবাল

সক্কলে কবি নয়
সক্কলে কবি নয়,
কেউ কেউ কবি –
এই বোধোদয়-বিভা
গ্রহপথে সত্যময় পাঠ
কবে হয়ে গেছে!

তবু,
তবু, দোলনচাঁপা আগুনে
ফুলে-ওঠা
মশারির ভিতর
জাহাজের স্বপ্নসফর
বাধা নেই মহাকাশ,
বাধা নেই
তারাবাতি হয়ে ফেরা কবিতার
সমুদ্রের শ্বাস

লেখার ক্ষমাহীন লোভে
সারসের উড্ডীন বাগান,
খাতা ভরে ওঠে

পৃথিবীর খিলখিল তালি
বেজায়গায় বেজে ওঠে খালি
কান লাল হয়ে গেলে
মুখ টিপে চলে যায় প্রিয়ম্বদা
কোনো কথা না ব'লে।

মনে আছ ত্রয়োদশীর
করুণ অঙ্গার
মাটিতে মিশে যাওয়া
একাকী প্রহর
ঘাসের বীজ বেলুন হয়ে
হাত থেকে উড়ে যায় ওর

অষ্টাদশী মধুরতার আগে
এক নীলাভ খাঁচায়
পালক খসে পড়া
লালন করা বুনো জানোয়ার
তারপর
পেশল আগুন হয়ে যাওয়া

নারী নয়, মানুষ হবার
বরফ-সুচালো গ্লেসিয়ার
উঠতে যেয়ে
পড়ে যাওয়া,
পড়ে যাওয়া,
আর কোনো হাত নেই
যেন চরাচর
এক নিঃশব্দ হাওয়া

তাই পড়তে পড়তে
নিজেকে ধরে ফেলা
শিশুর মতন,
মজেসের মতন ত্যক্ত হৃদয়
জলে জলাঞ্জলি

যাপিত করুণ
এক রক্তের অধিকার
ছাঁকনিতে সারাৎসার
জীবন মেপে
আনাড়ি অঞ্জলি।

কলম চেয়ে নিয়েছে সে
হাতেখড়ির কালে
মামার কোলে, চন্দ্রকলায়
বিশ্বস্ত কাজলে।

কবিতার অপ্সরা
আংকোর ভাট হয়ে
নাচে ওকে ঘিরে,
বিপন্ন করে
মৎস্যকন্যার মতো
অধরা
স্বপ্নে ফিরে ফিরে

পৃথিবীর তাপমাত্রা
পালটায়
ক্ষয়ে যায় বিশ্বাস
আত্মশ্লাঘার ফসলে
আসে শিশুর নিঃশ্বাস

অদলবদল হয়
স্বপ্নের গৃহ
রুপালি রোদ্দুর।
কবিতার গহনকৃষ্ণ ভাষা
যদিও
শেখা হয় নাই।

বাছুরের চোখ
নীল আকাশের মতো ঝকঝকে
মাতৃশোক
চশমার আড়ালে ঝাপসা বেদনা
বিভার তরলতা
শেখা হয় নাই

হৃদয়ের বিহান পদ্মপুকুর
গন্ধ নির্জন, পাখিদের
বিশ্রামের গান
শেখা হয় নাই।

লোভ থেকে গেছে তবু।
যেন চুরি করে পাওয়া
গোলাপি জিলিপি,

জাড়ে জবুথুবু,
জাদু খোঁজে শিশু
জাদু খোঁজে কানাকড়িহীন
জিভে জড়িয়ে নেয় রেণু
চটচটে
মাটিময় অনভ্যস্ত ঠোঁটে।

করুণ সন্তান, পবিত্র জোনাকি
করুণ সন্তান, পবিত্র জোনাকি,
এখনো কোন না-দেখা অরণ্যে বাড়ে
তোর হৃদয়ের পাখি?
চোখে এখনো কেন বেদনাখোঁড়া বিভোর বিস্ময়?
যেন মনে হয়,
লুফে নিবি পাহাড়ের আপরিসর হাওয়া
যেন মুহূর্তের ঢেউ তোর কাছে পাওয়া।

তোর পারিজাত-প্রেম, মৃত্তিকার নিভন্ত আগুন
রহস্যের রুপালি আভাস…
আকাশের হাঁস, জলের সন্তান
পাহাড় আগলে রাখা ঘোরলাগা এতখানি সুখময় তোর
সাম্রাজ্যের গান …

ঝুরঝুরে সোনাবালির নিবিড় আঁচড়ে
টেনে নিবি নীরব অধিকারে
প্রেমের পরিধি, পাখির ভালবাসা
সাজাবি প্রশ্নে সজাগ, ব্যাকুল, মানুষী প্রত্যাশা
তারার উজ্জ্বলতা।
প্রশ্নবিদ্ধ বিশ্বের শতায়ু আদিম গভীরতা

চুমুক দাও
ঝড়ের ফুঁ অনেক জানা আছে। জানা আছে, মেঘ, বৃষ্টি, রোদের সীমানা। রক্তপাত হাসিমুখে ঝরে পড়ে পাহাড়ের ঠিকরানো আলো থেকে। ঝিকমিকে জলের তেরছা তিকোণ ঢেউ থেকেও। আকাশে শূন্যতা নেই। স্তব্ধতা নেই। নম্রতা নেই। মানুষ তবু বসতে চায়। কোলাকুলি করতে চায় নিজের আলোর সঙ্গে।

আজকের সূর্যমুখী কি কাল ফুটবে? আজকের নদী কি শেষে জমাট বরফ? কুঁড়িমেলা স্বচ্ছ আকাশ কাল কি বজ্রপাতে গাঢ়? ঘাসের নিচেই কি চোরাবালির বাস? নিরাময়, নিরাময় – কতো দূর?

মুহূর্তে থাকতে গিয়ে মুহূর্তের সফেদ সবু্‌জ ঝিকমিকে অথবা ফেনীল চুমুক। পাঁজরের নির্জনতা বুঝতে না পেরে দুইমুখ টিনের তলোয়ারের উতলা উষর কলরব। রক্তের সুরায় ঝনঝন করে অপার্থিব পৃথিবী। তীব্র নিখাদ। কষায় সংগীত। চুমুক দাও, আবার চুমুক। এভাবে আলোর প্রান্ত থেকে চোখ, প্রেম, বাতাস নিজের নিজের অবয়ব নিয়ে ফিরে আসে।