ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা এবং আমাদের বাস্তবতা

রাইসুল ইসলাম সৌরভ
Published : 9 Dec 2011, 03:53 AM
Updated : 9 Dec 2011, 03:53 AM

সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো নিয়ে সোচ্চার হয়েছে ভারত সরকার। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেট-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আপত্তিকর বিষয় শনাক্ত এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে বলেছে সে দেশের সরকার। ভারতের যোগাযোগমন্ত্রী কাপিল সিবাল জানিয়েছেন, ইন্টারনেটে অনেক আপত্তিকর তথ্য পোস্ট করা হচ্ছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। ফেসবুক, গুগল, টুইটার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ব্যর্থ হয়ে ভারত সরকারকে জানায় যে তারা বিষয়বস্তু পোস্ট না হবার আগে তা বন্ধ করতে পারবে না, তার জবাবে ভারত বিগত ৬ ডিসেম্বর ঘোষণা দিয়েছে যে তারা নিজেরাই ইন্টারনেটের আপত্তিকর উপাদানগুলোকে নিষিদ্ধ করবে।

কাপিল সিবাল জানান যে, তিনমাস আগে আপত্তিকর ছবির ব্যাপারে তিনি যে অভিযোগ জানিয়েছিলেন সে ব্যাপারে এখনো কোন সমাধান দিতে পারেনি ইন্টারনেটের বড় বড় কোম্পানিগুলো। কাপিল সাংবাদিকদের এ সময় বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি দেখিয়েছেন যেখানে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ এবং ধর্মীয় ব্যক্তিদের নগ্ন ছবি রয়েছে।

কাপিল বলেছেন, "আমার ইচ্ছা হচ্ছে অপমানকর বস্তু কখনোই আপলোড করা যাবে না। আমরা এ সমস্যা সমাধানের জন্য গাইড লাইন এবং ম্যাকানিজম তৈরি করবো। কোথা থেকে এই ছবিগুলো আপলোড করছে এবং কে করছে, এই তথ্য তারা (ইন্টারনেট প্রভাইডার ও গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক) আমাদেরকে দিতে বাধ্য।" যেসব ইন্টারনেট সাইট আপত্তিকর বিষয়গুলো বন্ধের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছেন।

যোগাযোগমন্ত্রীর মতে, ইন্টারনেটের এ সকল বড় বড় কোম্পানিগুলো (গুগল, ইয়াহু, ফেসবুক, টুইটার) সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করছে না। গুগল ৫ তারিখে কাপিলের সাথে একটি বৈঠকে অংশ নিলেও এ ব্যাপারে তারা কোন মন্তব্য প্রকাশ করেনি।

হিন্দুস্থান টাইমসের তথ্যানুযায়ী, ইন্টারনেটের কোম্পানীগুলো কাপিলের অনুরোধ রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে। তাদের মতে, এত বিশাল সংখ্যক তথ্য প্রতিদিন আপলোড হয় যে তার উপর নজর রাখা সম্ভব নয় এবং এ সকল তথ্য সঠিক বা সঠিক নয় সেটা বিচার করা তাদের কাজ নয়। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-ই ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে।

কাপিলের এই ইন্টারনেট স্ক্রিনিং-এর ঘোষণাটি ভারতের নাগরিকদের মাঝে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। টুইটারের মাধ্যমে অনেকেই সমালোচনার ঝড় তুলেছেন এবং বেশির ভাগ ব্যবহারকারীই যে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাদের মত প্রকাশ করেছেন।

সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর জনপ্রিয় সাইট ফেসবুকের ভারতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ফেসবুক একটি বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে "আমরা ফেসবুককে বানাতে চাই এমনভাবে যেখানে লোকেরা স্বাধীনভাবে আলোচনা করতে পারবে, সাথে সাথে তারা অন্য সকলের অধিকার এবং অনুভূতি সম্পর্কে সমীহ প্রকাশ করবে। আর এ কারণেই ইতিমধ্যে আমাদের কিছু নীতি রয়েছে এবং রয়েছে অন-সাইট কিছু বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে আমাদের ব্যবহারকারী অবমাননাকর বিষয়বস্তু দেখলে আমাদেরকে জানাতে পারছে।" ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অনলাইনে অপমানকর বিষয়বস্তু কমানোর ব্যাপারে সরকারের যে উদ্দেশ্য তা অনুধাবন করতে পারছে এবং তারা তাদের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে এমন কোন বিষয়বস্তু আপলোডের সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলবে বলে তাদের ওই বিবৃতিতে জানিয়েছে।

কাপিল বার বার এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জনগণকে পরিষ্কারভাবে জানাতে চাইছেন যে, সরকার সেন্সরশিপ চাইছেনা বরং চাইছে সুপারভিশন। কিন্তু, কোন বিষয়বস্তুকে যদি বিষয়টি নৈতিকভাবে ভুল আখ্যায়িত করে সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে তা সুপারভিশন না হয়ে সেন্সরশিপ হয়ে পড়ে। ভারতের অধিবাসীদের মূল্যবোধ সম্পর্কে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর সংবেদনশীল হওয়া উচিত এবং এ সমস্যার সমাধান বের করার দায়িত্ব তাদেরই বলেও জানান কাপিল।

ওদিকে ইন্টারনেট সংযোগদাতার জানিয়েছেন কেবল সরকার নির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে অভিযোগ করলেই তারা ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বিধি-নিষেধ আনার ব্যাপারে অনেকে দ্বিমত পোষণ করলেও বেশিরভাগই এ বিষয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্বশীলতা আনার ব্যাপারে মত দিয়েছেন।

আমাদের দেশেও ইদানিং সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট, ব্লগ ও বিভিন্ন নাগরিক মত প্রকাশের মাধ্যমগুলোতে অপব্যবহার পরিলক্ষীত হচ্ছে। ভারতের মত এ দেশের সরকারও এসব বন্ধে বিভিন্ন সময় মন্তব্য ও কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমনকি কখনো কখনো কিছু কিছু জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সাময়িক বন্ধও করে দিয়েছে। ব্যবহারকারীদের যেমন এসব বিষয়ে দায়িত্বশীলতার স্বাক্ষর রাখার বিষয় রয়েছে ঠিক তেমনি সরকারকেও এ ব্যাপারে সহনশীলতার পরিচয় দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না।

বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশেষ করে নারীদের হেনস্তা করার প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসমস্ত অনাচার রুখতে আইন থাকলেও তার খুব একটা প্রয়োগ চোখে পড়ছে না। অথচ ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনানুযায়ী (ধারা ৫৭ ও ৬৭) এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়া ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৯৯, ৪০৫ ও ৪০৯ ধারানুযায়ীও এ ধরনের কার্যাবলী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব ক্ষেত্রে কোন কারণে কেউ মামলা না করলেও রাষ্ট্র নিজে পক্ষ হয়ে পুলিশের মাধ্যমে উদ্যোগ নিয়ে মামলা করতে পারে।

৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় তাহলে এগুলো হবে অপরাধ, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

এই অপরাধসমূহ অআমলযোগ্য হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলে পুলিশ প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে অপরাধ তদন্তসহ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্তসহ অন্য যে কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালতে এ ব্যাপারে সরাসরি মামলা করতে পারেন। আইনের ৬৮ ধারায় এই অপরাধগুলোর বিচারের জন্য আলাদা সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার সে রকম কোন ট্রাইব্যুনাল গঠন করেনি। তবে ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই আইনের অধীন অপরাধগুলো দায়রা আদালত বিচার করতে পারবেন।

তবে এ ধরনের সাইবার অপরাধসমূহের বিচারিক প্রক্রিয়া যেহেতু যথেষ্ট জটিল এবং আমাদের দেশে এখনও সুলভ না, তাই ব্যবহারকারীদেরই ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর বিষয়াবলী আদান-প্রদানে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। অনেকেই আবেগের বশবতি হয়ে কিংবা অন্ধবিশ্বাস থেকে ব্যক্তিগত গোপনীয় অনেক কিছুই অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। এসব ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা বজায় রাখা উচিত। কোনক্ষেত্রে ইন্টারনেটে অবমাননাকর কিছু প্রকাশিত হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবগত করলে সে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে ব্যবহারকারীদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা অন্যের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের আইন ও ভাবাবেগের ওপর শ্রদ্ধা রেখে নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ইন্টারনেটের সুবিধা উপভোগ করলে সামগ্রিক ব্যবস্থার সুফল পাওয়া যাবে। অপরদিকে সরকারও যদি নাগরিকদের দমন করার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে আরও বেশি সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে সুষ্ঠু পন্থায় ও আইনানুসারে সমাজের জন্য অগ্রহনযোগ্য বিষয়াবলী নিয়ন্ত্রণ করে তাহলেই নাগরিকেরা অবাধে তাদের আইনসম্মত অধিকারগুলির অবাধ চর্চা অব্যাহত রাখতে পারে। কারণ সরকারের উদ্দেশ্য নিশ্চয় রাষ্ট্র ও নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত করা, অধিকার চর্চায় বাধা তৈরি করা নয়।

*তথ্য ঋণঃ হিন্দুস্থান টাইমস, এএফপি ও বিবিসি