থানায় মামলা নিতে না চাইলে যা করবেন

রাইসুল ইসলাম সৌরভ
Published : 18 March 2012, 03:28 AM
Updated : 18 March 2012, 03:28 AM

আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর কেউ থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ বিনামূল্যে সে মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায় যে, পুলিশ থানায় মামলা নিতে চায় না। কোন কারণে পুলিশ যদি কখনো থানায় মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের আদালতে নালিশি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়। তবে সংঘটিত অপরাধ আমল অযোগ্য হলে সবসময়ই সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নালিশি মামলা দায়ের করতে হয়। আমল অযোগ্য অপরাধ হলো সেই সমস্ত অপরাধ যে সকল অপরাধ সংঘটনের দরুণ পুলিশ বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না এবং এ সকল অপরাধ বিষয়ে তদন্ত করতেও সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। কোনটি আমলযোগ্য এবং কোনটি আমলঅযোগ্য অপরাধ তা ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় তফশীলের তৃতীয় কলামে বিধৃত করা রয়েছে।

ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী নালিশ মানে হলো কোন অপরাধ সংঘটন বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নিমিত্তে মৌখিক বা লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের নিকট আবেদন জানানো। যদি কোন আমলঅযোগ্য অপরাধ সংঘটনের খবর কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে যায় তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (O.C) বিষয়টি সাধারণ ডায়েরিতে (G.D) লিপিবদ্ধ করে অভিযোগসহ অভিযোগকারীকে মহানগরের ক্ষেত্রে মুখ্য মহানগর হাকিম বা মহানগর হাকিম এবং মহানগরের বাইরের এলাকার ক্ষেত্রে মুখ্য বিচারিক হাকিম বা কোন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবেন। এক্ষেত্রে থানায় না যেয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যেয়েও লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করা যায়। অথবা পুলিশ যদি আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর থানায় এজাহার নিতে অস্বীকৃতি জানায় সেক্ষেত্রেও সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নালিশি মামলা দায়ের করা যায়।

ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতিঃ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট মৌখিকভাবে অভিযোগ দায়ের করতে চাইলে ঘটনার আদ্যোপান্ত আদালতে খুলে বলে ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আবেদন করতে হবে। তারপর দায়েরকৃত অভিযোগের কোন ভিত্তি আছে কি-না তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোন সাক্ষী থাকলে তাঁদেরকে শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারীর এবং কোন সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নিবেন। তবে কেউ দরখাস্তাকারে ঘটনার পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করে প্রতিকার দাবী করলে এরূপ পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে বা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটিকে একটি সি.আর কেস নম্বর (Complaint Register case number) বা সি.আর.পি কেস নম্বর (Complaint Register Petition case number) দিয়ে নথিভুক্ত করবেন। এজন্য একে সি.আর মামলাও বলে।

তবে শপথ পরীক্ষার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা যদি অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি (Prima facie) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন। নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে উক্তাদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।

অভিযোগ আমলে নেয়ার ফলাফল ও তদন্তে প্রেরণঃ অভিযোগটি আমলে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদী পক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারী করে আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করবে। আবার অআমলযোগ্য অপরাধের বেলায় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত করতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রেও আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযোগটি বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং তদন্তকালীন সময়ে আমলযোগ্য অপরাধ তদন্ত করার মতোই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। অভিযোগের তদন্ত শেষে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে কিংবা অভিযোগের কোন ভিত্তি খুঁজে না পেলে পুলিশের দাখিলকৃত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নারাজি দিতে পারেন অর্থাৎ পুলিশ প্রতিবেদনে তিনি কেন সন্তুষ্ট নন আদালতে সে কারণ দর্শীয়ে অভিযোগটির পুনঃতদন্তের আবেদন করতে পারেন।

তবে প্রয়োজন মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্ত কার্যে সম্পৃক্ত করতে পারেন।

মনে রাখা জরুরিঃ নালিশি মামলার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রথম থেকেই পক্ষ হয়ে মামলা শুরু করে না। যেমনটা থানায় এজাহার রুজুর মাধ্যমে মামলা দায়ের করলে রাষ্ট্র নিজে পক্ষভুক্ত হয়ে পরবর্তীতে মামলা পরিচালনা করে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নেয়ার আদেশ দিলে রাষ্ট্র তখন মামলার পক্ষ হয়ে পরবর্তীতে মামলা পরিচালনা করে। তাই নালিশি মামলার ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ দায়ের করে পরবর্তী শুনানির দিন যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির না হন কিংবা ঘটনা তদন্তান্তে যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হয় তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দিতে পারেন। অভিযোগকারী চাইলে এ ধরনের খারিজাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে উক্ত আদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন আবেদন করতে পারেন। নালিশি মামলা সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই রুজু করতে পারেন।

শেষ কথাঃ কাজেই থানায় কখনও মামলা নিতে না চাইলে বিচলিত হয়ে নিজেকে অসহায় ভাবার কোন কারণ নেই। আইনানুযায়ী যে কেউই এরকম পরিস্থিতিতে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা দায়ের করে আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা থানায় আইনের আশ্রয় না পেলে পুলিশকে টপকে অজ্ঞতা, দৈনতা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার দরুণ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। জনগণের ন্যায় বিচার পাবার অধিকার নিশ্চিত করতে তাই এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের আইনগত সহায়তা প্রদান কর্মসূচীও ব্যাপক পরিসরে বাড়ানো উচিত।