অপরাধী পুলিশ আর আতঙ্কিত আমরা

রাশেদুজ্জামান
Published : 1 Nov 2012, 04:22 PM
Updated : 1 Nov 2012, 04:22 PM

যখন ছোট ছিলাম তখন পুলিশকে দেখে রাস্তা থেকে দৌড়ে বাড়িতে আসতাম। একটু বড়দের কাছে শুনতাম পুলিশের দিকে আঙ্গুল তাক করা যাবে না। আইনের রক্ষক এবং জনগণের পুলিশের চরিত্র যে এটা নয় এবং এটা পুলিশের ভাবমূর্তির আতঙ্কের দিক তা অনেক পরে বুঝতে পারি।

পুলিশের বিভিন্ন অনিয়মের কথা আমরা প্রতিনিয়ত পত্রিকা এবং যারা ভুক্তভোগী তাদের কাছ থেকে জানতে পারি। রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন, মামলা-ধরপাকড়ে ঘুষ-দুর্নীতি, ক্ষমতাসীনদের সেবা করা, এমনকি পুলিশী হেফাজতে মৃত্যুও আমাদের আজ আর খুব বিচলিত করে না।

কিন্তু জানা থাকলেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের অপরাধের মাত্রা ও পরিমাণ যে এতো বৃদ্ধি পেয়েছে তা জানতাম না। দৈনিক কালেরকণ্ঠের আজকের একটা প্রতিবেদন পড়ে শুধু যে আতঙ্ক বাড়ছে তা নয়; তার চেয়ে বড় কথা পুলিশ শব্দটির প্রতিই একধরণের ঘৃণা বোধ জন্ম নিচ্ছে।

রিপোর্টটিতে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,
প্রতিবছর পুলিশের বিরুদ্ধে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার গুরুতর অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ জমা পড়ে। শাস্তির মুখোমুখি হন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার। বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ শুধু নয়, হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ জমা পড়ছে অনেক।

এতেই শেষ নয়। রিপোর্টটিতে গত ১০ মাসে কর্মরত পুলিশের অপরাধের একটা পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তাও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রের উদ্ধৃতি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ১০ মাসে সারা দেশে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩১ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। এর আগের বছরেও এ সংখ্যা ছিল প্রায় অভিন্ন। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেলে জমা পড়া অভিযোগের বেশির ভাগের তদন্ত শেষ হয়েছে। তাতে প্রায় ১৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

দুটো পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে অপরাধী পুলিশের শাস্তির পরিমাণ অর্ধেকের কম। আর এটা যদি পুলিশের সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান হয় তাহলে বাস্তবে চিত্রটা আরো অনেক ভয়াবহ হবে নির্ঘাত। কারণ যে অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে সেগুলোই পুলিশ সদর দপ্তরের রিপোর্টে স্থান পেয়েছে। কিন্তু আমরা জানি এর বাইরে এর চেয়ে বেশি পরিমাণের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে খাল কেটে কুমির আনতে চায় না বলে হয়ত অনেক অভিযোগ আসে না। আর মফস্বল এলাকার অপরাধগুলো এখনও পুরোপুরি আমাদের সংবাদ পত্রে আসে না।

পুলিশের অপরাধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির যে চিত্র উঠে আসছে ভবিষ্যতে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়বে? ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়।

কিন্তু কেন পুলিশের এই চরিত্র? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আজকের চরিত্র তার সাথে এর সম্পর্ক কি?

বর্তমান রাষ্ট্রই হল ফ্যাসিবাদী এবং আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ক্ষমতাই দালাল বু্র্জোয়াদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান হাতিয়ার। তাই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ক্ষমতায় যায় সে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। '৭১ পরবর্তী সকল সরকারকে দেখলেই তা বোঝা যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাই যখন অর্থনৈতিক উন্নতির চাবিকাঠি তখন শাসকশ্রেনী জনগণের উপর ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই কায়েম করে। সামরিক স্বৈরাচারের পর এখন চলছে সংসদীয় স্বৈরাচারের যুগ। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোকে একটা নিপীড়ক রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিণত করা হয়েছে।

আর আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী বৃটিশ আমলে বৃটিশ সরকারের সেবার জন্যই তৈরি হয়েছিল। বৃটিশদের উপনিবেশিক মানসিকতা ও তার আলোকে পুলিশের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান আমলের বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও পুলিশের এবং রাষ্ট্র কাঠামো থেকে যায় সেই পুরনো উপনিবেশিক মানসিকতা ও আইন নিয়ে। নাম, প্রতীক ও পোশাক পরিবর্তন হলেও মানসিকতায় থেকে যায় সেই পুরনো উপনিবেশিক মানসিকতা। জনগণের ও দেশের সেবার জন্য নয়, জনগণের হাত থেকে শাসকশ্রেনীকে রক্ষা করাই যেন পুলিশের প্রধান কাজ। যেমন তারা বৃটিশ আমলে করত।

রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আমলাতন্ত্রকে ব্যবহারের ফলে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থার মত পুলিশ বাহিনীও নিজেদের ক্ষমতার একটা প্রধান স্তম্ভ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনের দলীয়করণ। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগের খবর আজ কারো অজানা নয়।

একদিকে রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্র, ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার এবং ব্যাপক দলীয় নিয়োগ পুলিশের আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী। রাজনৈতিক আনুগত্য ও দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা পুলিশকে এমন স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।