রাজনীতি ও আমাদের তরুণ প্রজন্ম

রাতজাগাতারা
Published : 21 Oct 2011, 03:42 AM
Updated : 21 Oct 2011, 03:42 AM

পরীক্ষার পর প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। তেমন কিছুই করার নেই। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করি আর রাতে হয় গল্পের বই পড়ি, নাহলে ইন্টারনেটে বসি।ফেসবুক আর ব্লগসাইট গুলোতে ঘোরাঘুরি করতে খারাপ লাগে না।ভালোই লাগে ব্লগের লেখা, ফেসবুক নোটগুলো পড়তে। ব্লগে আর ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করে দেখতে পেলাম, লেখার বিষয় হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল রাজনীতি এবং আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। বেশিরভাগ লেখাতেই হতাশার সুর, বেশিরভাগ লেখকেরই প্রত্যাশা পরিবর্তনের।আমিও পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু কীভাবে আসবে সেই পরিবর্তন? আদৌ কি পরিবর্তন আসবে?

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর হয়ে গেল।যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই স্বপ্ন নিঃসন্দেহে পূরণ হয়নি। বরং আমাদেরকে বার বার সহ্য করতে হয়েছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। সেই বেদনার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাই অধিকাংশ লেখায়।দেখতে পাই রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণা। পড়তে পড়তে মনে হয়, দেশে বুঝি এবার একটা বিপ্লব হয়েই যাবে! সব কিছু আবার গড়ে উঠবে নতুন ভাবে।আমাদের সবার স্বপ্ন এবার বাস্তব হয়ে উঠবে। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। বিপ্লব ঘটে যায় শুধু ফেসবুক নোট, স্ট্যাটাস আর ব্লগের ভার্চুয়াল জগতে। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে বিপ্লব কখনো বাংলার পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে না!সবাই পরিবর্তন প্রত্যাশী, কিন্তু কেউ পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী না। সবার ভাবখানা এমন, "আমি তো দোষ ধরিয়ে দিচ্ছি, এখন পরিবর্তন করার ভার তোমাদের।" সবাই যদি পরিবর্তন আনার ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি, তাহলে কি আদৌ কোনদিন পরিবর্তন আনা সম্ভব?

বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? অধিকাংশ ফেসবুক বিপ্লবীর মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই বাতিল মাল।কেউই দেশ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।এদেরকে দিয়ে আর কাজ হবে না।তাহলে উপায়? হয় দেশে একটা বিপ্লব ঘটাতে হবে, না হলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে অথবা দুই দলকেই বাদ দিয়ে তৃতীয় কোন শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। প্রথমে আমরা সবচেয়ে সহজ বিকল্পটা নিয়ে চিন্তা করি-রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন।

আমার এক বন্ধুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, "রাজনীতি করিস না কেন?" বন্ধু নাক সিঁটকে জবাব দিয়েছিল, "রাজনীতি মানুষে করে? নষ্ট লোকদের কাজ রাজনীতি করা।" আমি জানি,অধিকাংশ তরুণেরই মনোভাব এরকম।রাজনীতিকে, রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করাই হাল আমলের ফ্যাশন। রাজনীতি নিয়ে বর্তমান সময়ের কিছু জনপ্রিয় ধারণা হল- রাজনীতি করে নষ্ট ছেলে পেলেরা, রাজনীতিতে পেশী শক্তি আর অর্থের কাছে মেধার কোন দাম নেই,রাজনীতি করলেই জীবন নষ্ট হবে,অকালে মারাও যেতে হতে পারে।বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কথাগুলো যে ভুল আমি তা বলছি না।কিন্তু কেন এই অবস্থা তৈরি হল বাংলাদেশের রাজনীতিতে? এই প্রশ্নটার জবাব কেউ দিচ্ছে না।

নষ্ট মানুষের অধিকারে রাজনীতি কেন চলে যাচ্ছে? কারণ যারা নিজেদেরকে ভালো বলে দাবি করছে, শিক্ষিত বলে দাবি করছে, তারা কেউ রাজনীতিতে আসছে না।আপনারা যদি বাস্তব জগতে না এসে, ভার্চুয়াল জগতে বসে কীবোর্ড দিয়ে রাজা-উজির মারেন, তাহলে তো সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবেই। আপনারা আসুন, এসে চেষ্টা করে দেখুন কিছু পরিবর্তন করা যায় কিনা! ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে রাজা-উজির মারছেন, এমন কয়জন তরুণ সরাসরি মূল ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত হবার সাহস দেখিয়েছেন? সফল হওয়া যাবে কিনা সেটা পরের কথা, কিন্তু চেষ্টা করেছেন কয় জন? যদি আজকে শত শত কিংবা হাজার হাজার শিক্ষিত ভালো ছেলে,যারা দেশ নিয়ে চিন্তা করে, সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিত, তাহলে কি এত সহজে সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যেত? যদি শিক্ষিত ভালো ছেলে মেয়েরা তৃণমূল পর্যায়ে থাকত, তাহলে কি দলগুলোর হাইকমান্ড বাধ্য হত না তাদের দাবির মূল্য দিতে? কিন্তু যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত বলে দাবি করছে তারা তো কেউ আসছে না সক্রিয় রাজনীতিতে।তাহলে পরিবর্তন কি আকাশ থেকে ধূমকেতুর মত খসে পড়বে?

পরিবর্তন তো একদিনে আসবে না, পরিবর্তন একটা চলমান প্রক্রিয়া। আজকে যারা ছাত্র রাজনীতি করবে, যারা তৃণমূলে নেতৃত্ব দিবে, তারাই একদিন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাবে। তারাই একদিন ঠিক করবে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। সেই পর্যায়ে যত সুশিক্ষিত মানুষ থাকবে, দেশ ও জাতির জন্য তা তত মঙ্গলজনক হবে।কিন্তু শিক্ষিত, ভালো ছেলেরা কোথায়? তারা তো আগেই মাঠ ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।এই রকম পলায়নপর মনোভাব নিয়ে আপনারা দেশে পরিবর্তন আনবেন কিভাবে? পেশীশক্তিকে আপনাদের এতই ভয়? আপনারা প্রচলতি রাজনীতির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন; পরিবর্তন,পরিবর্তন বলে চিল্লাবেন; আপনাদের তো প্রস্তুত থাকতে হবে যেকোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য। দরকার হলে জীবনও দিতে হতে পারে।আপনাদের লেখা পড়লে তো মনে হয়, দেশের চিন্তায় আপনাদের রাতে ঘুম আসে না। আপনাদের তো দেশের জন্য জীবন দান করতে দ্বিধা থাকার কথা না। তাহলে চলে আসুন রাজনীতির মাঠে। দরকার হলে দু'একজন মারা যাব। দেখি না পেশীশক্তি কতদিন আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারে।নাকি ভয় লাগে? যদি ভয় লাগে, তাহলে দয়া করে, এইসব হিপোক্রেসি বাদ দিন। শুধু শুধু এইসব সস্তা কথাবার্তা লিখবেন না।

যত তরুণ ইন্টারনেটে রাজনীতি নিয়ে গরম গরম কথা লিখছে, তার অর্ধেকও যদি রাজনীতি করত, মনের কথাগুলোকে কাজে পরিণত করার চেষ্টা করত, তাহলে দেশের অবস্থাটাই আজকে পাল্টে যেত।কিন্তু কেউ মাঠে নামছে না। সবাই আশায় আছে, কোন এক দেবদূত এসে দেশের অবস্থা পাল্টে দেবে! যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদেরকে কেউ কোনদিন দমিয়ে রাখতে পারেনা। আপনাদের কথাবার্তা শুনলে তো মনে হয় না যে, আপনাদের যোগ্যতার কোন কমতি আছে।তাহলে এই যোগ্যতাটাকে আপনারা কেন দেশের কাজে লাগাচ্ছেন না? প্রত্যেকে রাজনীতির সাথে সংশিষ্ট হোন নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ।পাল্টে দিন দেশের ছাত্র রাজনীতিটাকে। ছাত্র রাজনীতি পাল্টালেই তো একদিন দেশের রাজনীতি পাল্টাবে। দুই বড় দলেই যদি দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা থাকে তাহলেই তো একদিন পাল্টে যাবে দেশের রাজনীতির চিত্র।পাল্টাতে না পারুন, চেষ্টা করে দেখুন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ফেসবুক ছাড়া আর কোথাও তো এবিষয়ে তরুণ সমাজের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। সবাই হাসিনা-খালেদাকে গালিগালাজ করেই খালাস।দায়িত্ব নিতে কেউ উৎসাহী নয়।তাহলে আপনারা পরিবর্তনটা আনবেন কিভাবে? গরম গরম স্ট্যাটাস আর লাইক বাটনে ক্লিক করে?

তার চেয়ে আসুন, আমরা দ্বিতীয় বিকল্পটির কথা চিন্তা করি-বিপ্লব। আজকাল তো দেখি সবাই চে গুয়েভারা আর মাও সে তুং এর ভক্ত। কথায় কথায় বিপ্লবী স্ট্যাটাস, শাহবাগকে তাহরির স্কয়ার বানানোর হুংকার। পারবেন চে'র মত বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে কিংবা মাও সে তুং এর মত বছরের পর বছর ধরে ব্লিপবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে? কিংবা দিনের পর দিন শাহবাগে তাঁবু খাটিয়ে পড়ে থাকতে? সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন না, আপনারা করবেন বিপ্লব? ধরে নিলাম, ফেসবুকের অসংখ্য চে গুয়েভারার মধ্যে কেউ একজন নেমেও আসলেন বাস্তব জগতে। তারপর? আরেকটি নকশাল আন্দোলন? আপনাদের কি মনে হয় বাঙালি বাবা-চাচা-মামা-মা-মাসিরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেমে আসবে সেই আন্দোলনে? ইতিহাস তো তা বলে না।পারবেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে?

আরেকটি বিকল্প বাকি রইল-তৃতীয় কোন শক্তির উত্থান। তৃতীয় শক্তির শাসন তো দেখলাম কয়েকদিন আগেই।খুব ভালো কোন দৃষ্টান্ত তো তারা স্থাপন করতে পারল না।প্রচলিত রাজনীতিকে যদি আপনারা এতই ঘৃণা করেন, তাহলে তৈরি করুন না বিকল্প কোন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম।এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ তো দেখা যাচ্ছে না।শুধু ইন্টারনেটে রাজনীতি করলে তো পরিবর্তন আসবে না।

তাহলে আমরা কী করব? ভাগ্যের হাতে সবকিছু তুলে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকব? কোন সিস্টেম চেঞ্জ করতে হলে, আগে আমাদেরকে সেই স্টিটেমে ঢুকতে তো হবে। আসুন, আমরা, যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত বলে দাবি, করি তারা আগে সিস্টেমে প্রবেশ করি। প্রবেশ করি মূলধারার রাজনীতিতে। তারপর আমরাই একদিন পরিবর্তন আনব এই সিস্টেমে। বদলে দেব সবকিছু, বদলে দেব রাজনীতি, বদলে দেব দেশটাকে। আর যদি এতটুকু সাহস না থাকে, তাহলে প্লিজ, শুধু শুধু মায়াকান্না কাঁদবেন না। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের এইসব কথাবার্তা দেশটাকে বদলাতে পারবে না! অন্যের দোষ ধরা তো অনেক হল, এইবার আসুন নিজেরা কিছু করি! রাজনীতিকে ঘৃণা না করে, একে দিন বদলের, দেশ বদলের হাতিয়ারে পরিণত করি। হয়ত আমরা ব্যর্থ হব, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই।