মাদকের মহা ছোবলে দেশ – বন্ধে জরুরী প্রশাসনিক তৎপরতা ও সচেতনতা প্রয়োজন

রেজওয়ান মোর্শেদ
Published : 23 March 2015, 01:15 PM
Updated : 23 March 2015, 01:15 PM

আমাদের সবার চোখ এখন আবহমান রাজনীতির উপর, দুন্ধুমার লড়াই – নিত্য নতুন খবরের শিরোনাম। কাজে অকাজে খবর- খবরের পরে খবর। পুলিশ প্রশাসন ও অন্যান্য বাহিনী ব্যাস্ত দেশকে অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষায় তাই এই সুযোগে অন্যান্য অনেক অপকর্ম ও অপরাধের সাথে সাথে মাদকের চোরাচালান ও সেবনও অনেকাংশে বেড়ে চলেছে যা শহর থেকে গ্রাম এবং গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তেছে।

  • উত্তরবঙ্গের জেলাগুলতে মাদকের অন্যান্য রকমফেরের মধ্যে "ফেন্সিডিল" (পত্রিকা এবং টেলিভিশনের কারনে ফেন্সিডিল এখন সবার জানা নাম তথাপি বর্ণনা লেখার নিচের অংশে বর্ণিত) নামক ভয়াবহতার মাত্রা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।  ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও নবাবগঞ্জ এ এর ব্যাপকতা অন্যান্য নিকটবর্তী জেলাগুলর থেকে একটু বেশি। পাশাপাশি "গাঁজা" সেবনের মাত্রাও অন্যান্য সময়ের থেকে বেশি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশের অন্যান্য বর্ডার দিয়েও ভারত থেকে আমাদের দেশে অতিসহজেই নিষিদ্ধ ঘোষিত ফেন্সিডিল প্রবেশ করতেছে যা আমাদের যুব সমাজ কে ধ্বংসের পথে ধাবিত করতেছে।

শারীরিক – মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি নৈতিকতা ও মূল্যবোধেরও অবক্ষয় হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ সমাজে বিরুপ প্রভাবের পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন অপরাধের জন্ম দিয়ে চলেছে। আগেও ছিল কিন্তু দিনে দিনে এর বিস্তার বেড়েই চলেছে। শহর থেকে শিক্ষিত যুবারা গ্রামে যাচ্ছে ফেন্সিডিল খাওয়ার জন্য এবং গ্রামের কিছু অসাধু ব্যাবসায়ি এই সুযোগে তাদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে যা গ্রামের পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলতেছে। কিছুক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাবসা করার দরুন স্থানীয় জনগণও কিছু বলার বা করার সাহস পায় না।

উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি অন্যান্য যেসব জেলার সাথে ভারতের বর্ডার সংযোগ রয়েছে সেসব জেলাতেও এর প্রভাব রয়েছে এবং ওইসব জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলাতেও বিভিন্ন ভাবে অবৈধভাবে চলে আসতেছে এবং ধীরে ধীরে যা মহামারীর আকার ধারন করতেছে।

  • পাশাপাশি দক্ষিনের জেলাগুলতে আবার নিষিদ্ধ ঘষিত "ইয়াবার" ছড়া-ছড়ি। মাদকের এই রূপটিও অনেক ভয়ংকর অন্যান্য ক্ষতিকর মাদকের মত (বিস্তারিত নিচের অংশে বর্ণিত)। সবাই কমবেশি শুনেছি। কিন্তু এর ব্যাপ্তিও যে অনেকদূর পর্যন্ত গিয়েছে তা হয়তো অনেকেই জানিনা। কক্সবাযার-চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-পাবনা ইত্যাদি জেলাগুলে এর প্রভাব বেশি কারন টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবার প্রধান চালান আসে যা পার্শ্ববর্তী জেলাগুলতে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। এবং পরবর্তীতে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় হাত বদল হয়ে গিয়ে থামে।

তরুণ-তরুণীরাই ইয়াবার প্রধান গ্রাহক হলেও দিনে দিনে ছোট-বড় সব বয়সীরাই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে প্রচারিত "তালাশ" নামক ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সোতে ইয়াবা নিয়ে ধারাবাহিক দুটি পর্বে দেখেছিলাম কিভাবে ইয়াবা বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকদের কাছে পৌছায়। ভয়ের বিষয় হল কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন বয়সী শিশু এবং মহিলারাও এটার বিক্রির সাথে জড়িত।

এছাড়াও অন্যান্য মাদক সেবন ও চোরাচালান যেমন- ড্রাগ, হেরোয়িন, প্যাথেডিন, আফিম, হাসিস ইত্যাদির  মাত্রাও বেড়ে চলেছে। গত দুই-তিন বছর আগেও যেখানে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ছিল সতেরলক্ষের একটু বেশি  সেখানে বিশ্ব চিকিৎসকদের মতে বর্তমানে দেশে মাদকাসক্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষেরও বেশী (যদিও সঠিক হিসেব নিরুপন করা কঠিন তাই আমার তো মনে হয় এ সংখ্যা আরও বেশি হবে) এবং এর বড় একটা অংশে আমাদের ছাত্রসমাজ। তাই উন্নত দেশ ও জাতি গঠনের মূল হাতিয়ার আমাদের ছাত্রসমাজ কে এখুনি মাদকের কালো গ্রাস থেকে মুক্ত করতে না পারলে সামাজিক- অর্থনৈতিক – রাষ্ট্রীয় – ধার্মিক কোন উন্নয়নেই তরান্বিত হবেনা।

প্রসাশনিকভাবে মাদকের চরাচালান এখুনি বন্ধ করতে হবে, পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে মাদক নিরাময় কেন্দ্র আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতেকরে বর্তমানে যারা মাদকাসক্ত তাদের সুচিকিৎসার ব্যাবস্থা করা যায়। এবং মাদক নির্মূলে সবথেকে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে আমাদের পরিবারগুলোকে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য যদি একটু সচেতন হই তাহলে অন্যান্য সদস্যদের মাদকাসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব। কথায় আছে – সচেতন পরিবার – সচেতন দেশ।

বহুল প্রচলিত কিছু মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে নিম্নে সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তুলে ধরলাম –

ফেন্সিডিল – চিকিতসা বিজ্ঞানের ভাষায় এর ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, রুচি নষ্ট হওয়া, এবডোমিনাল পেইন, ঘুম কম হওয়া, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি যা পরবর্তীতে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পাশাপাশি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অনেকেই মোটরবাইক বা অন্যান্য গাড়ি চালানোর সময় এক্সিডেন্ট করেও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। বেশি আসক্ত ব্যাক্তিরা টাকার যোগানের জন্য চুরি, ছিন্তাই সহ অন্যান্য অসামাজিক কর্মে লিপ্ত হতে পারে।

ইয়াবা – দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যাক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগে। মস্তিষ্কের ভেতরের ছোট রক্তনালীগুলো ক্ষয় হতে থাকে এবং অনেকসময় এগুলো ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সৃতিসক্তি কমে যায় পাশাপাশি মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়ে অহেতুক রাগারাগি করে যা পরবর্তীতে পড়াশোনা- পারিবারিক অশান্তি ও কর্মক্ষেত্রে বিরুপ প্রভাব ফেলে। পরিশেষে বেশি পরিমাণে ইয়াবা সেবনের ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।

মদ – যেহেতু কম-বেশি সবাই প্রায় মদ সম্বন্ধে জানেন তাই এটা উপরে লিখিনি। মদ মানুষের কর্মশক্তি নষ্ট করে। সেই সঙ্গে চিন্তাশক্তি হ্রাস করে, চেতনাশক্তি ও বিবেচনাশক্তির অভাব দেখা দেয়। সর্বোপরি করে চরিত্রহীন। টানা মদ খাওয়ার ফলে শরীরে নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। স্নায়ুু দুর্বল হয়, পেটে নানারকম রোগ বাসা বাঁধে, মূত্রাশয়ে রোগ জন্মে, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি জটিল রোগের উত্পত্তি হয়। এতে অনেকে অকালে-বেঘোরে প্রাণ হারান। বিষাক্ত মদ খেয়ে বিভিন্ন স্থানে এক সঙ্গে অনেকের অকাল এবং করুণ মৃত্যুর খবর আকছার মিলছে।

এছাড়াও  অন্যান্য মাদক – ড্রাগ, হেরোয়িন, প্যাথেডিন, আফিম, হাসিস ইত্যাদির বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষতিকর দিক রয়েছে এবং আমাদের দেশে কিছু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা এসব মাদকে আক্রান্ত। তবে পরিমাণে অন্যান্য মাদকের তুলনায় কম।

পরিশেষে – প্রচলিত আছে সব মাদকের গুরু হল "সিগারেট – বিড়ি" বা "ধূমপান"। গবেষণায় দেখা যায় মাদকাসক্ত বেশিরভাগ মানুষই আগে ধূমপায়ী ছিলেন বা ধূমপান করেন। যদিও প্রায় প্রতিটি দেশেই ধূমপানে সরকারিভাবে খুব বেশি বাধা-নিষেধ নাই তথাপিও এটি পরিহার করাই বাঞ্ঝনিয়। ধূমপানের কারনে স্ট্রোক- হার্টঅ্যাটাক এবং  ক্যানসার হয়।