গণতন্ত্র:মেইড ইন বাংলাদেশ

নাদিরা মজুমদার
Published : 5 Feb 2011, 05:36 PM
Updated : 17 Jan 2012, 02:55 PM

গত বছরের শেষের দিকে, বিশেষ করে বছরের শেষের দেড় দুই মাস সারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাকটিসের বাজার বেশ সরগরম ছিল। বিভিন্ন শহরে প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো জনসভা, গরম গরম বক্তব্য, দাবি, প্রতিশ্রুতি, শীতের চিরায়ত বির্বণ মেজাজে ভাল আমেজের সুন্দর এক ব্লেন্ড এনে দেয়, তৈরি করে সরগরম অবস্থার।

গণতন্ত্র বিষয়টি আগাগোড়াই "জনগণ বনাম রাজনীতি ও রাজনৈতিক" দলকেন্দ্রিক। এবং জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর পি আর বজায় রাখার প্রধান মাধ্যম, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, হল পথেঘাটে, রাস্তার মোড়ে, বাজারে, মাঠেময়দানে দৈনন্দিন জীবন থামিয়ে জনগনের জন্য "মনোলগের" আয়োজন করা। পি আরকে র্অথাৎ পাবলিক রিলেশনসকে ইদানীং বিশ্বায়িত অন্য এক পরিভাষা দেয়া হয়েছে -কমিউনিকেশন, বাংলায় হয়তো হওয়া উচিত "আদান-প্রদান বা বিনিময়", তবে অর্থবোধক পরিভাষায় না গিয়ে যদি স্রেফ "যোগাযোগ" বলা হয় তবে মনোলগের সুবিধাটি নেয়া যায় বেশ।

আমাদের দেশজ গণতন্ত্রের বির্বতনপ্রক্রিয়া লংমার্চ থেকে সাম্প্রতিককালের রোডমার্চ, অটো মার্চ, গাড়িমার্চ ইত্যাদি নানাবিধ পর্বে গিয়ে উপনীত হয়েছে। যানজটের কারণেই তো কতো কতো দুর্মূল্যের জ্বালানি পুড়ছে; বাড়তি গাড়িমার্চে আরো কতোটা পুড়ছে, কে জানে! অনশন ধর্মঘটের বিষয়টিও নতুন অবয়ব লাভ করেছে। অনির্দিস্টকালের জন্য অনশন পালনে ওস্তাদ ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, আধুনিককালে আনা হাজারেও কম যান না। তাঁদের ভঙ্গুর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে তাঁরা কেন চেষ্টা করে অনশনের আধুনিক অবয়ব বা সংজ্ঞা দেয়ার চেস্টা করেননি? যেমন, দুপুরের আগে খাওয়াদাওয়া করার অভ্যাস যাদের নেই, তারা ঘোষণা করবেন যে "সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত" অনশন ধর্মঘটে থাকবো, বা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্তও অনশন ধর্মঘট করার বিধান করা যেতে পারত। করেননি বলেই তো  স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনশনরত গান্ধীজীর ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে কতো উদ্বেগে থেকেছেন! আনা হাজারেকে অনশন ভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কি কাকুতি মিনতি!

গণতন্ত্র একাধিক নিউক্লিয়াসের ওপরে ভর করে গড়ে উঠেছিল; তারই অন্যতম একটি হল বাক-স্বাধীনতা। কিন্তু মনোলগ কেন্দ্রিক রাজনীতির যুগে বাস্তবে এই বাক-স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আসছে প্রধানত যারা রাজনীতি করেন, তারা এবং রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যখন তখন যা খুশি বলছেন; মনোলগের অডিয়েন্স হিসেবে জনসাধারণরা শুনছে। এই জাতীয় বাক-স্বাধীনতার বড়ো সুবিধে হল যে বক্তারা কখনোই কোনোরকমের সেল্ফ সেন্সরশিপ যেমন আরোপ করেন না, আবার বক্তব্যের সপ্রমাণতার পক্ষে কোনো যুক্তিরও ধার ধারেন না। মনোলগ যে!!! ডায়ালগও নয়, মাল্টিলোগও নয়!

দেশের এই সরগরমে পূর্ণ মনোলগীয় বক্তব্য, বক্তৃতা ইত্যাদি বিষয়বস্তুর বিচারে কিন্তু যথেস্ট আকর্ষনীয় ছিল। যেমন, খাদ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে, দাম কমাতে হবে। যদি না করা হয় তো কী করা হবে? সমাধান কী? ক্ষমতার গদি থেকে সরকারকে টেনে নামানো হবে। একইভাবে, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে, নইলে কী হবে? গণ আন্দোলন করে ক্ষমতার গদি থেকে টেনে নামানো হবে।

এক্ষেত্রে, যদি মনোলগের বদলে ডায়ালগের ব্যবস্থা থাকতো তো বক্তাকে খাদ্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণগুলো সবিস্তারে বলতেই হতো। সেইসঙ্গে সমস্যা নিরসনের রেসিপিও দিতে হতো একটি। খাদ্যমূল্যের গতি ২০০৮ সাল থেকেই আরোহণমুখি, বিষয়টি আগেকার মতো কোনো দেশের গন্ডির মধ্যে আর সীমিত নেই; সারা পৃথিবীতেই দ্রব্যমূল্য ওপরের দিকে উঠে আসছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যের উর্ধ্বগতিকে মূল্যের উর্ধ্বগতি না বলে অভিহিত করা হচ্ছে খাদ্যের ইনফ্লেইশন বলে (বা খাদ্য স্ফীতি কিংবা খাদ্য আধ্মাপন?)। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, দামের ঘোড়ার গতিবেগে তাতে কোনো কমতি ঘটছে না। খাদ্যের ইনফ্লেইশন বা খাদ্য স্ফীতি ঘটার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেমন: অতীতে পণ্যমূল্যের ওঠানামা ছিলো আবহাওয়া নির্ভর। সমসাময়িককালের ট্রেন্ডই হলো জটিল সরবরাহ/চাহিদার সমীকরণ বা সাপ্লাই/ডিমান্ড ইকুয়েশনের বিধি মেনে চলো। বিগত ৬/৭ বছর ধরে আর তাই, আমার খাদ্য শস্য আছে আর তোমার খাদ্যের দরকার – সাপ্লাই/ডিমান্ডের অতি পরিচিত সমীকরণটি একেবারেই অচল হয়ে গেছে।

এইকালে ডিমান্ড অংশের বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে – জনসংখ্যাবৃদ্ধি, উঠতি সমৃদ্ধি, এবং খাদ্য থেকে গাড়ির জ্বালানি তেল তৈরি। সাপ্লাইয়ের ঘরে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে: মাটির ক্ষয়, অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত অসুস্থ দুর্বল মাটি, জলসঞ্চয়ের শূন্যকরণ, আবাদ জমির অ-আবাদকাজে ব্যবহার (যেমন: বাড়িঘর, কলকারখানা স্থাপন, রাস্তাঘাট, সড়ক ইত্যাদির সম্প্র্রসারণ; বাংলাদেশে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে), জলসেচের জন্য জলের গতি বদলে শহরমুখি করা, কৃষিআবাদে প্রাগ্রসর দেশগুলোর শস্যের ফলন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যাওয়া, যাকে প্ল্যাটোয়িং বলা হয়, অর্থাৎ ফলন আর বাড়ানো সম্ভব নয়, এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় অনাবৃষ্টি, পাগলা আগুন, অসময়ে ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, ইত্যাদি এবং  গ্লেসিয়ার, পাহাড়ের বরফ চাদরের গলা। জলবায়ুর সঙ্গে জড়িত এই ট্রেন্ড ভালো শোধ নিচ্ছে এখনই; ভবিষ্যতে আরো বেশি বেশি করে শোধ তুলে নেবে আমাদের ওপরে।

ডিমান্ড অংশে, গ্লোবাল পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সামান্য কমতির দিকে হলে কী হবে এই গ্লোবাল সাফল্যে বাংলাদেশের কোন সক্রিয় অবদান নেই। বিশ্বব্যাপি জনসংখ্যা কমতির ট্রেন্ডকে কাচকলা দেখিয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে ১.৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ হারে বেড়েই চলেছে। আমাদের স্বাধীনতার সময়কার ৭৫ মিলিয়ণ জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে কমবেশি ১৬০ মিলিয়নে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ ৪০ বছরের সময়সীমার মধ্যে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই হার অব্যাহত থাকলে সাধারণ সমীকরণ অনুযায়ী আগামী ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বাড়তি আরো ১৬০ মিলিয়ন যোগ হবে। এই মুহূর্তেই তো ছোট বড়ো শহরগঞ্জে প্রায় গায়ে গায়ে গা লাগিয়ে চলতে হয়; ৪০/৫০ বছর বাদে অবস্থা কী দাড়াবে! এবং এর ১৩৪ হাজার কিলোমিটারের জমিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১০০ র বেশি মানুষ আস্তানা গেড়েছে।

মনোলগের অডিয়েন্সদের সামনে সমাধানের একটা প্রোগ্রাম দিলে ক্ষমতার গদি থেকে টেনে নামানোর যুক্তি খোঁজার চেস্টা করা যেতো।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও উঠতি সমৃদ্ধি মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তিত উন্নতি ঘটাতে বাধ্য করছে। পৃথিবীর প্রায় বাড়তি আরো তিন বিলিয়ন সমৃদ্ধশীল মানুষ গবাদি মাংস ও হাঁসমুরগিজাত খাদ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এইসব পশু আবার মানুষের মতোই শস্য নির্ভর; এদের খাদ্য বাবদ শস্যের একটা বড়ো অংশ তাই ব্যবহার হচ্ছে। তাই উপরোল্লিখিত মনোলগের অডিয়েন্সদের খাদ্যের একটা বড়োসড়ো অংশ গরুছাগল, হাঁসমুরগি খেয়ে নিচ্ছে।
উন্নত দেশগুলো পরিবেশ বান্ধবতার দোহাই দিয়ে ডিমান্ড অংশে আরেকটি গুরুত্বর্পূণ সংযোজন করেছে যাকে বলা হয় "ডিকার্বোনাইজ পলিসি"। পলিসিবিধি অনুযায়ী প্রতিবছরই চিরায়ত জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ ক্রমশ কমিয়ে আনছে। কিন্তু কীভাবে? সেই ২০০৫ সাল থেকেই যানবাহনে বাধ্যতামূলকভাবে চিরায়ত জ্বালানির সঙ্গে মেশানো হচ্ছে জৈব জ্বালানি। তাই শস্য ও আখ থেকে তৈরি হচ্ছে জৈব ইথানল। তাই উদাহরণস্বরূপ, যেমন ২০০৯ সালে আমেরিকা যে ১১৯ মিলিয়ন টন শস্য থেকে গাড়ির জ্বালানিতে ব্যবহারের জন্য জৈব ইথানল তৈরি করে, এই পরিমাণ শস্য পেলে বাংলাদেশকে কম করে দুইবছরের জন্য খাদ্যের কোনো চিন্তাই করতে হয় না। বা ব্রাজিল যদি তার আখ দিয়ে জৈব ইথানল তৈরি বন্ধ করে তো চিনিও আকালের সামগ্রিতে পরিণত হয় না। কিন্তু বাস্তব সিনারিও অন্যরকম। অন্যদিকে ইউরোপের রাস্তায় চলছে জৈব ডিজেল মিশ্রিত গাড়ি; এই জৈব ডিজেল বানানো হচ্ছে সরিষা জাতীয় রেপ সীড, পামের তেল ইত্যাদি থেকে। ফলে, ভোজ্য তেলের বাজারে আগুণ লাগবে না কেনো?

খালবিল ভরাট করে, বাড়িবন কেটেকুটে সাফ করে আধুনিক কৃষকরা জৈব জ্বালানির কাঁচামালের আবাদ করছে। তাতে লাভ বেশি; নানারকমের ভর্তুকির সুবিধে রয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্যশস্যের জন্য ব্যবহৃত আবাদ জমির পরিমাণও কিন্তু তাই কমে যাচ্ছে। খালবিল ভরাট করা বা বাড়িবন বিনাশের পরিবেশগত কুফলের কথা না হয় নাই বললাম।

জৈব জ্বালানির এই ফিভার কিন্তু ভারত, থাইল্যান্ড এবং চীনা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, ক্যানাডা ইত্যাদির মতো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং জৈবজ্বালানির উৎপাদনে ও ব্যবহারে মনোনিবেশ করেছে। "খাবারের জন্য নয়" শস্য উৎপাদনকে উৎসাহ দেয়া হচেছ নানা ধরণের আকর্ষনীয় ভর্তুকি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এবং এমনকি আবাদ না করে জমিকে অলস বসিয়ে রাখলেও আধুনিক কৃষকরা আর্থিক সুযোগসুবিধা পাচ্ছে!

জৈবইথানল ও জৈবডিজেলের কাঁচামাল না হলেও বিশ্ববাজারে চালও দুর্লভ পণ্যে পরিণত হয়েছে; উচ্চমূল্যকে কেন্দ্র করে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্নদেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও নতুন কিছু নয়। ঘটেছে, এবং আর যে ঘটবে না, হলফ করে কি মনোলগের কোনো কর্তাব্যক্তি বলতে পারে? চালের মূল্যের উর্ধ্বমুখি গতির পরিপ্রেক্ষিতে চাল রফতানিকারক প্রধান দেশগুলো, (যেমন চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া,  ইন্দোনেশিয়া, মিসর ইত্যাদি) চাল রফতানির ওপরে কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি করে নতুন এক ফেনোমেননের জন্ম দেয়। সেই থেকে বিশ্ববাজারে চাল কেনা দিনকে দিন বেশ কঠিণ ব্যাপার হয়ে দাড়াচ্ছে। চালের বাজারের অবস্থাটির গুরুত্ব আরো বেড়ে যায় ওপেকের কায়দায় "চাল রফতানিকারী দেশের সংস্থা" ওরেক গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে। বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি আসলে এক "শব্দহীন সুনামি"র জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখার যে পন্থা উন্নত দেশগুলো নিয়েছে, তার ফলে বিশ্ববাজারে খাদ্যের সরবরাহের পরিমাণ বরং ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আসলে,  "ফেলো কড়ি কেনো চালের" (এবং একইভাবে, চিনি, ভোজ্যতেল, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রেও) সময়ে বসবাস করছি আমরা। অর্থাৎ, বাস্তবক্ষেত্রে 'সুলভ বা সস্তার খাদ্য' কিন্তু অতিকথা বা মিথই থেকে যাচ্ছে। চালের যদি "বাম্পার" উৎপাদনও হয়, তবে কি সম্ভব বিশ্ববাজারের মূল্যের অনেক কমদামে চালের কেনাবেচা করা? না, সম্ভব নয়। কেউ কি সার্বিক খাদ্য মূল্য বা ইনফ্লেইশন কমানোর মন্ত্র জানেন?

চাল, চিনি ও ভোজ্য তেলের বাজারে বিশ্ববাণিজ্যিক আধিপত্য বজায় রেখেছে উন্নয়ণশীল দেশগুলো। এবং আমদানিরফতানি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ভূমিকার ও অংশীদারিত্বের রদবদল হচেছ প্রায়শ। অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের মতো খাদ্যও বিশ্ববাজারে লেনদেনের সামগ্রি, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে গৃহীত দামটি অতি দ্রুত আভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিফলিত হয়। সস্তার খাদ্য বা কমদামের খাদ্য কী বোঝায়, কে জানে!!! তবে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য বলতে বুঝি যে আমাদের আয়ের বিশাল অংশটাই চলে যায় খাদ্যের পেছনে। ফলস্বরূপ জনসাধারণের একটা বড়ো অংশের হাতে অন্যান্য পণ্য সামগ্রি কেনার ও ভোগের পুঁজি প্রায় থাকেই না; সাধারণ ব্যবসাবাণিজ্যও তাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।

আসলে উন্নত ও উন্নয়ণশীল দেশ নির্বিশেষে, খাদ্যমূল্যের বা খাদ্য ইনফ্লেইশনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অপরিসীম। বাংলাদেশের সমস্যা হল যে নির্বাচিত সংসদীয় দলগুলো রাজপথভিত্তিক রাজনীতির নীতি পরিহার করতে শেখেন নি। বিপুল উদ্যমে স্ট্রীট রাজনীতির অভ্যাস এখনো চলছে। মনোলগের অডিয়েন্সরা নির্বাচন করে দলগুলোকে সংসদে পাঠালে কী হবে ধর্মঘট, হরতালের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে তাদের রেহাই হয়নি কোনো। খাদ্যসহ জাতীয় ইস্যুগুলোর কোনোটিই কোনো দলেরই রাজনীতি করার হাতিয়ার হতে পারে না।  জাতীয় ইস্যুর সমাধান হবে জাতীয় ভিত্তিতে। (এরমধ্যে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, টিপাইমুখি, তিস্তার জলের ভাগ – সবই অন্তর্গত)। ক্ষমতার গদি থেকে টেনে নামানোর পরে, কীভাবে কী করা হবে, কেউ কিছু বলুক! খাদ্যকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতির খেলা চলছে, যেমন, মজুতদারি, কালোটাকা ধোয়া, টাকা পাচার ইত্যাদি রয়েছে, সেসবের সমাধানের রেসিপিও বলা হোক! কারণ, ভালো ভালো মিষ্টি কথা ও আহবান, ন্যায়অন্যায়ের দোহাই ইত্যাদি বাস্তবক্ষেত্রে মোটেই কার্যকরী নয়। সেই অভিজ্ঞতাও আমাদের প্রচুর রয়েছে!

বিশ্বায়িত খাদ্যবাজারের এই প্রবণতা থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে ক্রয়ক্ষমতার অসাম্যতা; মানুষে মানুষে ক্রয়ক্ষমতার দূরত্বের মধ্যে খুব একটা হেরফের হয়নি, বরং আরো বেড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, হিসেবটি বর্তমানে নব্বই শতাংশ বনাম দশ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ক্রেতার স্বার্থে (ভর্তুকি ব্যবস্থার মাধ্যমে) খাদ্যের দাম কমিয়ে রাখলে যেকোনো সরকারই দেউলিয়া হতে বাধ্য। তাই দীর্ঘমেয়াদিভিত্তিতে খাদ্য উৎপাদনকে করতে হবে আরো বেশি বাজারমুখি, উৎপাদন ক্ষেত্রে উৎপাদন উদ্দীপনার প্যাকেজ এমন হতে হবে যাতে উৎপাদনকারি আরো বেশী উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। এবং সর্বোপরি গরিবের আয়ের পরিমাণ যাতে বাড়ে সেই ব্যবস্থার দিকে যত্নবান হতে হবে। আর মনোলগের অডিয়েন্সদের চাই সবগুলোর সমাধানের পরিপাটি রেসিপি, সঙ্গে রাজনৈতিক অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি।


নাদিরা মজুমদার
:বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।
nadirahmajumdar@gmail.com