ভালবাসতেন বিপ্লব আর ভালবাসতেন কবিতা : অমর প্রতিকৃতি চে গুয়েভারা

শুভ্র রহমান
Published : 22 June 2011, 03:22 AM
Updated : 22 June 2011, 03:22 AM


"গেরিলেরো হেরোইকো" প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আলবের্তো কোর্দার তোলা, ১৯৬০ সাল

বিশ্ব পুঁজিবাদের আতঙ্কের নাম আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভেবেছিল, তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে লাতিন আমেরিকায় | কিন্তু যুগে যুগে চে'র আদর্শের মৃত্যু হয়নি। লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের দেয়ালে দেয়ালে চে'র ছবি | লাতিন আমেরিকা জুড়ে সংগ্রামী নেতা চে গুয়েভারা এ অঞ্চলের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন | যেখানে শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের সংগ্রাম সেখানে চের ছবি হয়ে ওঠে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা |

কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া এই বিশ্ববিপ্লবীর জন্ম আর্জেন্টিনার রোসারিওতে ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন | একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী , বিপ্লবী, ডাক্তার, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবায় বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব | তার বাবা ছিলেন মুক্তমনের অধিকারী | ধর্মীয় অনুশাসন মানতেন না | আর মা ছিলেন শতভাগ মার্কসবাদী সংগঠক | সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন | সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চের পরিবারে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই | যা চে'কে করে তোলে একজন জ্ঞান পিপাসু ও সমাজ সচেতন পাঠক | তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের একজন গোড়া সমর্থক | মেহনতি, নির্যাতিত মানুষকে ভালোবাসতে শেখা পরিবারের মধ্য দিয়ে | বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী, লুটেরা, ধনিক শ্রেণীর আতঙ্কের নাম 'চে' আর মেহনতি, শ্রমজীবী, সংগ্রামী মানুষের বন্ধু চের ছিল বর্ণাঢ্য জীবন | তিনি তার সেই জীবনের কিছু অংশ 'মোটরসাইকেল ডায়েরি', 'বলিভিয়ার ডায়েরি' ও 'ডাক দিয়ে যাই' নামক তিনটি গ্রন্থে লিখে গেছেন |


প্রথম কন্যা ও ফিদেলের সাথে

চে গুয়েভারা ১৯৪৮ সালে বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন | ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবার্টো গ্রানাডো নামক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে (কুষ্ট রোগীদের জন্য বিশেষ কলোনি) স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজ করা | মাচু পিচ্চুর যাওয়ার পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্রতা দেখে ভীষণভাবে মর্মাহত হন | এ কৃষকরা ধনী মহাজনদের অধিনে থেকে ছোট ছোট জমিতে কাজ করত | তাঁর ভ্রমণের পরবর্তি সময়ে তিনি লেপার কলোনিতে বসবাসকারী মানুষের মাঝের ভাতৃত্ব ও সহচার্য দেখে অভিভূত হন | এই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ডায়েরীতে(The Motorcycle Diaries,) তিনি লিখেছেন, 'মানব সত্ত্বার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রুপটি এ সকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে' | এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েনস আয়ার্সের এর দিকে | ভ্রমণের শেষ দিকে তিনি এই মত পোষণ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব যার প্রয়োজন মহাদেশব্যপী স্বাধীনতার জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা | পরবর্তিতে তাঁর নানা বিপ্লবী কর্মকান্ডে এই একক, সীমানাবিহীন আমেরিকার চেতনা ফিরে আসে বার বার | লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে খনি মালিকদের নির্যাতন, নিপীড়িত শ্রমিকদের প্রতি ধীরে ধীরে একাত্ম হয়ে ওঠেন তিনি | এ ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। আর এর একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখেন বিশ্ববিপ্লব |


১৯৬৫ সালে কঙ্গোতে কোলে সহযোদ্ধার শিশু

তার প্রধান স্বপ্ন লাতিন আমেরিকাকে স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলমুক্ত করা | এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়েতামালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন | ১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে চে মেক্সিকোতে আসেন এবং সদর হাসপাতালে এলার্জি বিভাগে চাকুরি গ্রহণ করেন | পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতে মেডিসিন বিষয়ে প্রভাষক এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন | ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার বন্ধু নিকো লোপেজ রাউল কাস্ত্রোর সাথে তার পরিচয় করান এবং পরে তার বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন | কাস্ত্রোর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত | এক পর্যায়ে মাত্র ১৭ জন বিপ্লবী, চে ও ফিদেল মিলে সংগঠিত হয়ে টানা আড়াই বছর গেরিলা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদ করে বিপ্লব সফল করেন |


১৯৬৪ সালে মস্কোর রেড স্কোয়ারে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সাথে


১৯৬৫ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের সাথে

কিউবার মুক্তি সংগ্রামে তার অবিস্নরণীয় অবদানের জন্য নাগরিকত্ব লাভ করেন | কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন | এর মধ্যে ছিল বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শিল্পমন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, সামরিক বাহিনীর ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন ও কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বভ্রমন | চে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, চীন, মিশর ও অন্যান্য দেশ ঘুরে কিউবায় শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং সফল হন | এ ছাড়াও চে গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেকার চুল্লী প্রস্তুত, নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা, স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণের কর্মশালার আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচারের ব্যবস্থা করেন | এ সব কারণে টাইম ম্যাগাজিন চে'কে "ক্যাস্ট্রোর মস্তিস্ক" বলে আখ্যায়িত করেছিলেন | কিন্তু যার চোখ, মন পড়ে আছে সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করার জন্য তার কিউবার শিল্পমন্ত্রী থাকাটা বেশিদিন স্থায়ী থাকে না | ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান | তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন | এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন | ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কথা বলেই কিউবার কয়েক কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে বলিভিয়ায় আসেন চে গুয়েভারা | বলিভিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে শ্রমজীবী, নিপীড়িত মানুষের সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন চে গুয়েভারা | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু অসহযোগিতার কারণে সফল হননি | ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর মার্কিন মদদপুষ্ট বলিভিয়ার বাহিনীর হাতে কিছু গেরিলা যোদ্ধা সহ ধরা পড়েন এবং নির্মম হত্যার শিকার হন | কমরেড চে তোমায় লাল সালাম |

'চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/ আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা/ আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ/ শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস…/ বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা/ তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর/ তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে/ নেমে গেছে/ শুকনো রক্তের রেখা…|' কবি, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'চে গুয়েভারার প্রতি' এই কবিতাটিই শুধু নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় চে গুয়েভারাকে নিয়ে যত কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, তথ্যচিত্র, গান, চলচ্চিত্র, শোকগাথা রচিত হয়েছে তা সত্যিই বিরল | এত লেখালেখি হয়ত আর কোন বিপ্লবীকে নিয়ে হয়নি | চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন 'চে'কেই আমরা দেখি বিষণ্ন এক যোদ্ধার প্রতিকৃতিতে, যিনি ভালবাসতেন বিপ্লব আর ভালবাসতেন কবিতা | যার অস্ত্রের পাশেই থাকত কবিতা |' তার মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, 'একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল |' মৃত্যুর পর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরেও টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিংশ শতাব্দীর সর্বসেরা প্রভাবশালী একশ ব্যক্তির তালিকায় রয়েছে তাঁর নাম |

***
তথ্যসুত্র : উইকিপেডিয়া ও লাতিন আমেরিকার মুক্তির সংগ্রাম (প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো)
ছবি সংগ্রহ : ইন্টারনেট