অমর প্রতিকৃতি: মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক

শুভ্র রহমান
Published : 23 July 2011, 10:50 AM
Updated : 23 July 2011, 10:50 AM

"আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে | আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে | যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত" তাজউদ্দিন আহমেদ |

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা :

তার চিন্তাধারায় দেশপ্রেম ও রাজনীতির মন্ত্র ঢুকেছিল জন্মভূমি কাপাসিয়াতে থাকা অবস্থায় | ওই সময় কাপাসিয়াতেই নির্বাসিত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তিন বিপ্লবী রাজেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, বিরেশ্বর বন্দ্যাপাধ্যায় ও মনীন্দ্র শ্রীমানী | তাজউদ্দিন আহমেদ তখন কাপাসিয়া মাইনর স্কুলের ছাত্র | তাঁর প্রখর মেধার পরিচয় পান এই বিপ্লবীরা | তাঁকে ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মনীষীদের জীবনী সম্পর্কে জানতে-পড়তে সাহায্য করেন তাঁরা | তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ফেলেন প্রায় ৫০/৬০ খানা বই | বিপ্লবীরা তাঁর চেতনার নির্মাণ করেন শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ ভাবনা | ১৯৪৮ এ প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি | আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদেরও একজন তিনি | ভাষা আন্দোলনেও তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম লড়াকু সৈনিক | ১৯৪৮সালের ১১ ও ১৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ধর্মঘট-কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন | ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ দলের কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে 'মুসলিম' শব্দটি থেকে বাদ দেয়া হয় | শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন | এ সময়ই আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ | ওই বছরই তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন | সাংগঠনিক কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে | ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হন এবং জয় লাভ করেন তিনি | তখন তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর | ওই নির্বাচনি প্রচারণায় তাঁর জন্য ভোট সংগ্রহ করেছেন জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী | স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) আওয়ামী লীগের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এদলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন | ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেফতার করে আইয়ুব সরকার | ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন | ৬ দফা আন্দোলনের কারণে দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৬ সালের ৮ মে পুনরায় তাকে গ্রেফতার করা হয় | জেল থেকে মুক্ত হন ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনায় তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী | যিনি মানুষের অধিকার ও দাবির ব্যাপারে ছিলেন অনড় | ইয়াহিয়া খান তাজউদ্দীনকে ভয় করতেন তাঁর সততা ও কঠোরতার কারণে |

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় :

নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় শেখ মুজিবরের ডাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় | ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে | বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় | তাজউদ্দীনের ভাষায়, 'আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা |

প্রথমে আত্মরক্ষা তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পালটা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য সরকার তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন | তাই তাজউদ্দীন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন | এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌছান | ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন | সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়ে মেহেরপুরের মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন | সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন | গোলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজী তাদের আশ্রয়স্থলে এবং তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং পূর্ববাংলা সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন | সীমান্তে পৌছে তাজউদ্দিন দেখেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই | মুক্তিফৌজগঠনের ব্যপারে তাজউদ্দীন আহমদ বি,এস,এফ এর সাহায্য চাইলে তৎকালীন বি,এস,এফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময় সাপেক্ষ কাজ | তিনি আরো বলেন যে ট্রেনিং বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না।কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন সাথে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি চলে আসার জন্য | উদ্দেশ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দিন আহমদের বৈঠক | দিল্লিতে যাবার পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী | ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন | এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না | সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না | এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোন সরকার গঠিত হয়েছে কিনা | তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন | কারণ এতে 'পূর্ব বাংলার জনগনের সংগ্রাম কে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা হয় | ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে | শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব -ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য | মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লির উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন | ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন | ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে | এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা | ৪ঠা এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয় | ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষনা করা হয় | ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন | ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় | তাজউদ্দীন আহমদ হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী | শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম | অস্থায়ী সরকার ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত কলকাতা থেকে কার্য পরিচালনা করে | তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে এতে নেতৃত্ব দেন |

১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করেন | কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নাই | তিনি ঐ সময়, বলেন একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রন ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না | এটার করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক | অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অফ অর্নার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায় |

সারাদেশে রাজনৈতিক তত্‍পরতায় ব্যস্ত আবার নানা বিষয়ে মুজিবকে সচেতন করতেন তিনি | শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্ক্ষা সত্য হলো | ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করলো মোশতাক গংরা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে | বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সবাই তাজউদ্দীন আহমদকে আত্মগোপনে যাবার জন্য বলতে থাকেন দেশের বামপন্থী নেতারা | কিন্তু তিনি আত্মগোপন করতে অস্বীকৃতি জানান | ১৫ আগস্ট প্রথম গৃহবন্দী ও পরে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাঁকে | পরিবারের সদস্যদের প্রতি শুধু বলে গেলেন- "ধরে নাও আজীবনের জন্য" যাচ্ছি | ৩ কন্যা, ১ পুত্রসহ স্ত্রীকে ছেড়ে যাবার সময় একটুও বিচলিত ছিলেন না | কারা অন্তরীণহলেন আরো ৩ জন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান | ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানার মধ্যে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ৪ নেতাকে | ১৫ আগস্টের পরে মোস্তাক গংরা ৩ নবেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড ঘটায় |

কবি সেই কবে লিখেছিলেন কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে | সে ছেলে যে জন্মায়নি তা কিন্তু নয় | রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধুর মতো ছেলে জন্মেছেন এই উপমহাদেশে | জন্মেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের মতো বাঙালি অন্তপ্রাণ নেতা | বাংলাদেশের এক আশ্চর্য মানুষ | রক্তের রং লাল, বিপ্লবের রংও তাই | তার রক্তে হোলি খেলা পশুরা আজ পরাভূত | তারপরও আকাশে আকাশে তার বার্তা ছড়ানো যায়নি | আজ ২৩ জুলাই তার জন্মদিন | প্রতিবারের মতো এবারও প্রথাগত স্মরণে ভরে উঠবে কাগজের পাতা বা অন্যান্য মিডিয়া | প্রকৃত সম্মান ও আদর্শের কাজটি কি আন্তরিকভাবে শুরু করা সম্ভব ? আমরা কি তা চাই ? চাইলে সেটাই আরাধ্য হোক | কলঙ্ক ও দায়মুক্ত হই আমরা | জয়তু তাজউদ্দীন |

***
তথ্য উপাত্ত : উইকিপিডিয়া ও মূলধারা '৭১ (মইদুল হাসান)