যেহীন আহমদ ও চার দশকের গ্রামোন্নয়ন

মোশতাক রাজা চৌধুরী
Published : 1 Jan 2012, 03:22 AM
Updated : 6 Nov 2019, 06:59 AM

বাংলাদেশে যে-কয়জন এনজিও নেতা সমাজের অগ্রগতি ও পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, যেহীন আহমদ তাদের অন্যতম। গত ২৮ অক্টোবর ছিলো তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

যেহীন আর আমি ছিলাম সতীর্থ, বন্ধু। সেই ১৯৬২ সালে সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলে আমাদের প্রথম পরিচয়। স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবন শেষ করতে না করতেই সে দেশ মাতৃকার কাজে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সে তার মামাতো ভাই ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেশ করে। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ সিলেটের মণিপুরী জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে তাদের পুনর্বাসন পর্যন্ত সমস্ত কাজেই সে জড়িত ছিল। এই সম্পৃক্ততা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর ফসল হিসেবে আমরা পাই একজন উন্নয়নকর্মী এবং একটি উন্নয়নসংস্থা যার নাম ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ (এফআইভিডিবি)। সংস্থাটি চল্লিশ বছর ধরে মহাসমারোহে সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক বিদেশি সংস্থা এদেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে এগিয়ে আসে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ভলান্টারি সার্ভিসেস বা আইভিএস ছিল একটি। আইভিএস প্রথমে কুমিল্লায় পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমি বা বার্ডের সাথে কাজ শুরু করে। ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের অনুরোধে তারা তাদের কার্যক্রম সিলেটে সম্প্রসারিত করে। এরপর থেকেই যেহীন আহমদ আইভিএস-এর সাথে যুক্ত হন এবং গ্রামোন্নয়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিদেশি নাগরিক যারা এইসময় আইভিএস-এর সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে ডেভিড ফ্রেঞ্চ (পরিচালক), ক্যারোলাইন কারবোল্ড প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। যেহীন ছাড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট ভূমিকায় ছিলেন তাদের মধ্যে সুলতানা কামাল, সমিক সহিদ জাহান, জাহিদ হোসেন, এনামুল হক রনি, হাসিনা জামান দুলু, আব্দুর রহিম, মালিক আনোয়ার খাঁ ও সেবাস্টিয়ান রডরিক্স, ফ্রেডি পেড্রো, হিনিয়া মেকাবেন্টা, এম.এ. মোত্তালিব, যোয়েল দাশ, পান্না চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

আইভিএস সিলেটে এসে কুমিল্লা মডেলের ধাঁচে কাজ শুরু করে এবং কৃষক সমবায় সমিতি সহ বিভিন্ন সমবায় সমিতি ও সিলেটের খাদিমনগরে অবস্থিত রুর‌্যাল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে সম্পৃক্ত করে। এই কাজে তারা সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রামোন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর প্রশিক্ষণও দেয়। আইভিএস এর কাজ কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হয় যখন তাদের প্রধান সহায়তাকারী সংস্থা আমেরিকার ইউএসএইড অনুদান বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। আইভিএস বাংলাদেশে মিশন শেষ করে প্রত্যাবর্তনের সময় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তে এর কার্যক্রমের অনুরূপায়ণ বিস্তারের জন্যে দেশি ও বিদেশি কর্মীদের সমবায়ে একটি বাংলাদেশি উন্নয়ন সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। এবং এখান থেকেই এফআইভিডিবি বা ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। সেটা ১৯৭৯ সনের কথা। স্থানীয় কর্মীদের ভোটাভুটিতে যেহীন আহমদ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর এফআইভিডিবি-র কার্যক্রম বিস্তৃত হয়ে বৃহত্তর সিলেটের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৯-২০১৮ : এই দীর্ঘ চার দশক সংস্থাটির নেতৃত্বে থেকে দক্ষ হাতে পরিচালনা করেছেন যেহীন আহমদ। যেহীন আর এফআইভিডিবি এক ও অভিন্ন। এই দুই পরিচয় যেন একই সত্তা, এদেরকে আলাদাভাবে দেখার কোনো জো নেই। এফআইভিডিবি যতদিন থাকবে যেহীনের কৃতিত্ব, তার পরম্পরা ততদিন চিরজাগ্রত থাকবে।

এটা সবারই জানা যে এফআইভিডিবি বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সংগঠন। বর্তমানে এর কর্মীসংখ্যা একহাজারের বেশি এবং বার্ষিক বাজেট প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা। তবে এফআইভিডিবি-র কার্যক্রম এখন সিলেটের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এফআইভিডিবি-র কাজের ধারা দুভাগে ভাগ করা যায়। এক, তাদের নিজেদের দ্বারা সরাসরি পরিচালিত বা বাস্তবায়িত কর্মসূচি যার মধ্যে আছে প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ ও আর্থিক সেবা, কৃষি উন্নয়ন ইত্যাদি; দুই, অন্যদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত কার্যক্রম যাকে বলা হয় আউটরিচ। এর আওতায় বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে বয়স্ক শিক্ষা সহ অন্যান্য কর্মসূচি। তিনশতাধিক সংস্থা এফআইভিডিবি-র বয়স্ক শিক্ষা ধারণা সারাদেশ জুড়ে বাস্তবায়িত করছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের বিহার, উড়িষ্যা এবং ইয়েমেনেও এই ধারণা সমাদৃত হয়েছে। ক্রমবিবর্তনের ধারায় ঐতিহাসিকভাবে এফআইভিডিবি-র কার্যক্রম চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে ১৯৮১-১৯৮২ পর্যন্ত বলা যায় সংস্থার প্রারম্ভিক পর্ব। সিলেট সদর উপজেলার ২৩টি গ্রামে এর শুরু। তখন যেসব কাজে জোর দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল কৃষি, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য। এফআইভিডিবি তখন গ্রামের সবাইকে নিয়ে কাজ করত যাকে বলা হতো কম্যুনিটি অ্যাপ্রোচ। বিশ্বাস ছিল যে এর মাধ্যমে ধনী-গরিব সবাই সমানভাবে উপকৃত হবে। এরপর ১৯৮৩-১৯৮৯ পর্যায়। এই সময়টাতে সংস্থার কর্মকৌশলে এক বড়সড় পরিবর্তন ঘটে। ব্র্যাক সহ অন্যান্য সংস্থা উপরোক্ত কম্যুনিটি অ্যাপ্রোচের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে নতুন কর্মকৌশলের অবতারণা করে। এফআইভিডিবিও একইভাবে কম্যুনিটি অ্যাপ্রোচ বাদ দিয়ে টার্গেটগ্রুপ অ্যাপ্রোচের প্রবর্তন করে। এর মাধ্যমে সংস্থার সব কার্যক্রম শুধুমাত্র গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে প্রণীত হয়। কর্মীরা গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করে এবং শুধুমাত্র তাদের জন্য এফআইভিডিবি-র সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হতে শুরু করে।

একই সময় সংস্থাটি আরেকটি কার্যক্রমের উপর বিশেষ জোর দেয় এবং সেটা হলো ব্যবহারিক শিক্ষা। ব্রাজিলের নামকরা দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরির মতবাদ যেহীন আহমদ এবং তার সহকর্মীদের অনেককেই আন্দোলিত করে যার প্রতিফলন দেখা যায় এই ব্যবহারিক শিক্ষায়। ব্যবহারিক শিক্ষার একটি অংশ ছিল সাক্ষরতা কার্যক্রম। কিন্তু আরও মৌলিক কাজ ছিল সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কাজ। এই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য নতুন নতুন দল গঠন করা হয়। মহিলা ও পুরুষদের আলাদাভাবে সংগঠিত করে ক্ষমতায়নের কাজটি সুচারুরূপে চলতে থাকে। নতুন নতুন গ্রামের সংযুক্তিতে সংস্থার কাজ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এরপর ১৯৯০-১৯৯৭ পর্যায়। পাওলো ফ্রেইরির দর্শন অনুসরণ করে এফআইভিডিবি সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষমতায়নের কাজে আরও এগিয়ে যায়। একটি স্বাভাবিক পরবর্তী পর্যায় হিসেবে এই সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামদলের ফেডারেশন তৈরি হয়, যাতে করে সুবিধাবঞ্চিতরা তাদের সম্মিলিত কণ্ঠ স্থানীয় সরকার এবং সমাজের উচ্চবিত্তের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। এই কাজটি সহজ ছিল না এবং তাই এফআইভিডিবি এই সময়ে প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যার মাধ্যমে পিছিয়ে-পড়াদের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়। এই সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো শিশুশিক্ষা সম্পর্কে পুনর্ভাবনা।

১৯৯৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষার উপর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংস্থাটির মধ্যে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। যেহীন আহমদ ও তার সহকর্মীরা ভাবতে থাকেন কিভাবে বাংলাদেশে একটি প্রাথমিক শিক্ষার মডেল তৈরি করা যায়, যা হবে শিশুবান্ধব, যার মাধ্যমে ঝরে-পড়ার হার ক্রমশ কমিয়ে আনা যাবে এবং শিশুরা স্কুলে যেতে আনন্দ পাবে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি সামগ্রিক অগ্রগতি মূল্যায়নের পর এফআইভিডিবি তাদের ব্যবস্থাপনায় বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটার মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন কাজ চারটি স্বতন্ত্র কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে যা কমবেশি আজ অবধি চলছে। এই চারটি কার্যক্রমের ইংরেজি নাম হলো : ইন্টিগ্রেটেড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রোগ্রাম, লাইভলিহুড এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম, ফাংশনাল লিটারেসি প্রোগ্রাম এবং প্রাইমারি এডুকেশন প্রোগ্রাম। এছাড়াও আউটরিচ প্রোগ্রামও চালু রয়েছে যার মাধ্যমে অন্যান্য সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। সম্প্রতি আরও দুটো কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে। এর একটা হলো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সহায়তায় মিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা শিক্ষা ও কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে সহায়তা কার্যক্রম। এই নিবন্ধে এফআইভিডিবির চলমান কার্যক্রমগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা নিতে পারি। ইন্টিগ্রেটেড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেস বা সমন্বিত আর্থিক সেবা কর্মসূচি। এই কার্যক্রমের কয়েকটি অনন্য দিক রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, গ্রামের অস্বচ্ছল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং পুঁজির সহজ যোগান। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ৪৫,০০০ নারী সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা পাচ্ছেন এবং এই পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকার ঋণ সঞ্চালন করা হয়েছে যার উশুলের হার প্রায় শতভাগ। আরেকটি কর্মসূচি প্রাথমিক শিক্ষা বা প্রাইমারি এডুকেশন প্রোগ্রাম। এক্ষেত্রে এফআইভিডিবি একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী কোনো-এক সময়ে এই কার্যক্রমের শুরু। এবং এই পর্যন্ত দেশের ৮টি জেলায় ৩৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। এই কার্যক্রম দেশের অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অনেকটা আলাদা যেখানে জোর দেওয়া হয়েছে গুণগত শিক্ষার দিকে। আগেই বলা হয়েছে যে এফআইভিডিবি বিদ্যালয়গুলো শিশুবান্ধব, যেখানে পড়াশোনা একটা মজার ব্যাপার, সানন্দ ও সক্রিয় শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় এটি পরিচালিত হয়। এর ফলে এখানে ঝরে-পড়ার হার অনেক কম এবং শিশুরা তাদের বিদ্যালয়কে ভালোবাসে। দুর্ভাগ্যবশত দাতাগোষ্ঠী বৃটিশ ও নেদারল্যান্ডস সরকার ২০১৩ সালে তাদের অনুদান বন্ধ করে দিলে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতগুলো স্কুল যেখানে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবার উপক্রম হয়। অন্য নতুন দাতাসংস্থা যোগাড় সম্ভব হয়নি বলে এফআইভিডিবি স্থানীয় কম্যুনিটির উপর এর পরিচালনার ভার ছেড়ে দেয়। সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে প্রায় ৬৩ ভাগ বিদ্যালয়ে এখনও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, বাকি ৩৭ ভাগ বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। এফআইভিডিবি নিজে থেকে ১০টি বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। একইভাবে 'বিস' নামে আরেক সংস্থা এগারোটা বিদ্যালয় তাদের নিজস্ব অর্থায়নে চালাচ্ছে। অনেকগুলো বিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি চেষ্টা করছে সরকারি নথিভুক্ত হবার। এছাড়াও এফআইভিডিবি এখন আরও অনেকগুলো ছোট-বড় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো : পুষ্টি উন্নয়নে সূচনা প্রজেক্ট, হারভেস্ট প্লাস প্রজেক্ট, হাঁস ভেল্যুচেইন প্রজেক্ট, মামনি প্রজেক্ট, মমতা প্রজেক্ট, ম্যালেরিয়া নির্মূল প্রজেক্ট ইত্যাদি।

সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও এফআইভিডিবি কাজ করছে। শরণার্থীরা ছাড়াও স্থানীয় লোকজনের সাথেও এই প্রজেক্ট বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে এফআইভিডিবি এই প্রজেক্টে কাজ করছে তার মধ্যে রয়েছে ফিনান্সিয়াল লিটারেসি, পরিবেশ ও বনাঞ্চল রক্ষার জন্যে এলপি গ্যাস সরবরাহ, মানসিক রোগ ও মনোঃস্বাস্থ্য সহযোগিতা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি। আরেকটি ইনোভেটিভ প্রকল্পের নাম মিডওয়াইফারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সহায়তায় ৪ এটি একটি শিক্ষা প্রকল্প যার মাধ্যমে এইচএসসি পাশ মেয়েদের তিন বছরের ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। এফআইভিডিবি-র কল্লগ্রাম কেন্দ্রে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর এখান থেকে তিরিশজন মিডওয়াইফ তৈরি হচ্ছে, যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রসূতিসেবা ও নিরাপদ জন্মদানে অশেষ অবদান রেখে চলেছে। এফআইভিডিবি-র এটি একটি ব্যতিক্রমী কার্যক্রম।

যেহীন আহমদ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি এফআইভিডিবি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং সিলেট তথা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ নিরলস কাজ করে চলেছে। এফআইভিডিবি-র কাজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে তাদের অনেকগুলো পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তিন তিনবার জাতীয় সাক্ষরতা পুরস্কার এবং ইউনেস্কো পুরস্কার অর্জন। এফআইভিডিবি-র এই চার দশকের পরিক্রমায় যেহীনের নেতৃত্ব যেমন অবদান রেখেছে তেমনি অবদান রেখেছে এর বিশাল কর্মীবাহিনী এবং বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী নারীপুরুষ ও শিশু। এফআইভিডিবিকে সহায়তাকারী বাংলাদেশের সরকার ও বিদেশি দাতাসংস্থা যাদের অবদান ছাড়া এই দীর্ঘ পথযাত্রার কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না তাদেরকেও এখানে স্মরণ করছি। এদের মধ্যে আছে পিকেএসএফ, ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউএসএইড, ইউকেএইড, নেদারল্যান্ডস সরকার, ডাব্লিউএইচএইচ, ডাব্লিউএফপি, এসিএফ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ইউএন অর্গানাইজেশনগুলো ছাড়াও অসংখ্য সহযোগী সংস্থা। আসুন, আমরা সবাই মিলে এফআইভিডিবিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই এবং যেহীন আহমদ ও আরো যারা এফআইভিডিবি-র সৃষ্টিতে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সেই লালিত স্বপ্নকে প্রকৃত রূপ দিতে ব্রতী হই।