নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম

শামীম আরা নীপা
Published : 3 Dec 2012, 07:21 AM
Updated : 3 Dec 2012, 07:21 AM

আমাদের নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম এ শীত বস্ত্র দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা টা এতো কমফোর্টেবল এবং আরামদায়ক এবং প্রশান্তির হবে তা যাওয়ার আগে বুঝিনি। ভোর চারটায় ওখানে পৌঁছানোর পর থেকে ফেরার জন্য বাসে উঠার আগ পর্যন্ত সবকিছু এতো অরগানাইজড ভাবে হয়েছে যে আমি খুব বিস্মিত হয়েছি … আশার আলো পাঠশালা যারা চালায় তাদের একজন বিশ্বজিতের বাসায় আমরা উঠেছিলাম … সেই ভোর রাত থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত তাদের আতিথেয়তায় আমরা যারপর নাই খুশী এবং কৃতজ্ঞ … গ্রামে এখনো সব্জির প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় … অনেকদিন পর আমি অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে বেড়ালাম … গ্রাম ঘুরলাম… অনেকদিন পর গ্রামের মাটির ঘরে পা রেখেছিলাম… শহরে থেকে গ্রামের ঐ প্রকৃতি এবং নির্ভেজাল খাবার এর সন্ধান পাওয়া বড় দায় …

নাগেশ্বরী সেই গ্রাম যেখানে ফ্যালানী কে মেরে সিমান্তের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো … যতবার আমি ঐ বেড়ার দিকে তাকিয়েছি ততবার আমার শুধু ঐ বর্বতার কথা ই মনে হয়েছে, মুখে হাসি ঝুলিয়ে আমার মন শৃঙ্খলিত হয়ে থেকেছে … এটা ক্ষনিকের অনুভুতি নয় বরং এসব ক্ষত তো সারাজীবনের জন্য !!!

সীমান্তে এতো সুন্দর বাঁশঝাড় যে ওখান থেকে বের হয়ে আসতে মন চায়নি-মনে হয়ে ছিলো সারাদিন ঐ নিসর্গে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেই কিন্তু যে অভিপ্রায়ে ওখানে যাওয়া তা তো আগে সমাধা করতে হতো তাই ফিরে এলাম সেই স্কুল ঘরে যেখান থেকে গ্রামের মানুষগুলোর কিছুটা কাছাকাছি হতে পারলাম। গ্রামের স্কুল খুব কম কিন্তু যেটুকু আছে তা একেবারে স্বপ্নের মতো ই আদর্শ মডেল … ঐখানে লেখাপড়ার মান শহরের মতো ভাল না হলেও মানুষ যে শিক্ষার আলো পাচ্ছে তা অনেক বেশী কৃতজ্ঞতার … প্রতিটা গ্রাম আমাকে আমার গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেহেতু দীর্ঘদিন বিভিন্ন জটিলতার কারণে আমার নিজের গ্রামের বাড়ী যাওয়া হয়নি তাই মন টা বিষন্ন হয়ে জায় তারপর ই আমি নিজেকে বুঝাই প্রতিটা গ্রাম ই তো আমার – শুধু অবস্থান এবং নাম ভিন্ন কিন্তু প্রেক্ষাপট এবং প্রকৃতি মোটামোটি এক … গ্রাম দেখে , স্কুল দেখে শান্তি লাগে- কষ্ট লাগে মানুষের দুর্ভাগ্য এবং দারিদ্র দেখে … আমাদের জীবনের ব্যাস্ততা এবং শহুরে বাস্তবতা আমাদের কে অনেক বেশী শৃঙ্খলিত করে দিয়েছে নইলে আমরা প্রকৃতি এবং প্রশান্তি ছেড়ে যান্ত্রিকতা কে কেন আলিঙ্গন করলাম !!!???

আশার আলো পাঠশালা চালায় ১৮ থেকে ২০ বছরের বাচ্চারা যাদের ইনিশিয়েটিভ এবং পথ চলা অসীম এপ্রিসিয়েশন এবং পৃষ্ঠপোষকতার দাবীদার … আমার মনের গভীর থেকে তাদের সালাম ও সাধুবাদ … এই ছেলেগুলো ৫৭ জন বৃদ্ধ কে বয়স্ক শিক্ষার আওতায় এনে উনাদের কে শিক্ষিত করার প্রয়াসে সচেষ্ট এবং উনাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা ও তার সমাধান এবং তাদের মানসিক শান্তির জন্য অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং অনেকাংশে সফল ও হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ … আশার আলো পাঠশালার সাধ্য সীমিত কিন্তু তাদের অভিপ্রায় অসীম এবং নিখাদ- নির্মল … আমরা প্রথমে ওই বয়োজ্যেষ্ঠ দের সাথে বসে আলাপচারিতা করেছি, উনাদের কে কম্বল দিয়েছি – উনাদের জীবনে এতো অল্প খানি সহযোগীতা করতে পেরে আমাদের প্রশান্তি অনেক সাথে কষ্ট এই যে উনাদের জীবনের দায়ভার আমরা নিতে পারার ক্ষমতা রাখি না আর যারা ক্ষমতা রাখেন তাদের সময় নাই এই মানুষগুলোর দিকে তাকানো কিংবা তাদের নিয়ে একটু ভাবা এবং দায়িত্ব পালন করা !!! কম্বল পেয়ে উনাদের চোখে যে প্রশান্তি এবং হাসির ছায়া তা আমরা প্রতিদিন কই পাই??? এই মানুষগুলো আমাদের কে উনাদের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শুনালেন, আশার আলো পাঠশালার অবদান সম্পর্কে বললেন এবং উনারা আমাদের জন্য গান গেয়েছেন — গানের কথা আঞ্চলিক থাকার দরুন কিছুটা কথা বুঝতে কষ্ট হওয়ার পর ও উনাদের ভাব, তাল, সুর বুঝে আমি যারপর নাই আহ্লাদিত – আমার বন্ধুরা ও তাই …

দুপুরে উনারা চলে যাওয়ার পর আমরা দুপুরের খাবার খেয়েই আবার স্কুল ঘরে গিয়ে দেখি বাচ্চারা আমাদের জন্য অপেক্ষমান সাথে তাদের বাবা-মা … আশার আলো পাঠশালা বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২৫০ বাচ্চা কে লেখাপড়া করায় বিনা বেতনে এবং তাদের এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ভলান্টারি এক্টিভিটি … এদের ভেতর যারা গ্রামের স্কুলে পড়ে এবং যাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা নাই তাদের জন্য আশার আলো পাঠশালা বাজারে জায়গা ভাড়া নিয়ে তাদের কে ফ্রি শিক্ষা দেয় !!! আমি ওদের এসব ব্যাবস্থা এবং কর্মকাণ্ড দেখে যেমন বিস্মিত, যেমন খুশি ঠিক তেমন ই নিজেকে নিয়ে লজ্জিত !!! এতো কমবয়সী ছেলেরা এতো মহৎ সব কাজ করছে আর এদিকে আমি তার সিকি আনা ও কিছু করতে পারছি না কিংবা করছি না…!!! আশার আলো পাঠশালা এবং এই বাচ্চা গুলো ও আমাদের কে সারপ্রাইজড করার জন্য আমাদের জন্য একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল… তাতে তারা আমাদেরকে সাধুবাদ জানিয়েছে, আমাদের কে গান গেয়ে শুনিয়েছে এবং নেচে দেখিয়েছে … এতো সুব্দর করে গুছানো বিস্ময়কর অনুষ্ঠান দেখে আমি মুগ্ধ— এতো পরিপাটি, এতো অরগানাইজড, এতো সিনক্রোনাইজড সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে আমি কিছুটা অবাক ই হয়েছি … যারা আল্লাহর রহমতে নিজেরাই এতো আলোকিত তাদের জীবনে আলোর অভাব কেন? তাদের কে আল্লাহ্‌ হেফাজত করুন এবং আল্লাহ ই যেন এই পৃথিবীতে ওদের সবার পৃষ্ঠপোষক হয়ে থাকেন সবসময়… বাচ্চা দের তথা তাদের পরিবার কে কম্বল দেয়া শেষ হলো পড়ন্ত বিকালে … পড়ন্ত আলোয় তাদের হাসিগুলো ছিল খুব উজ্জ্বল …!!! এই শান্তি বলে বুঝানোর কোন উপায় আমার জানা নাই … আলহামদুলিল্লাহ আমরা ঐখানে কাওকে নিরাশ করে আসিনি … আল্লাহ্‌র রহমতে সবাইকে একটা করে হলেও ঐ সামান্য শীত বস্ত্র দিয়ে আসতে পেরেছি … হয়তো ঐ একটা কম্বলে তাদের শীত নিবারন হবে না তাও তো তারা কত কৃতজ্ঞতার সাথে তাকিয়েছিলো, কেউ কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দোআ করে দিলো আমাকে … আমার মন ভিজে উঠছিলো বারবার – নিজেকে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো আবার একি সাথে দুর্ভাগ্যবান মনে হয়েছে !!! জাতি হিসেবে খুব গরীব লেগেছে নিজেকে !!! মানুষ হিসেবে খুব ছোট মনে হয়েছে নিজেকে … !!!

আমাদের দেশে যারা অবস্থা সম্পন্ন তারা কি একটু সাহায্য দিয়ে আমাদের দেশের এই অভিশাপ দারিদ্র্য কে নিবারন করতে পারে না??? সরকার কি এতোটাই অথর্ব যে দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটাতে পারে না??? প্রতিটা কোটীপতি যদি তার গ্রাম, জেলা, উপজেলার দায়িত্ব নিতো তাহলে কি দেশে এতো অনাহার, অবহেলিত মানুষ আর এই দুঃখ- দুর্দশা থাকতো ??? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞ্যাণ বলে আমরা সবাই মিলে যদি চাই তাহলে এই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হবেই হবে… এত সুন্দর একটা দেশ প্রশান্তিতে ঝলমল করার কথা কিন্তু দারিদ্র্য -দুর্দশার অভিশাপে নুয়ে পড়েছে গ্রাম বাংলা এমনকি শহর ও … মুহ্যমান মানুষগুলোর কথা সবাই মিলে ভাবতে পারি আমরা, সাথে অনেক দায়িত্য- কর্তব্য ও আছে আমাদের …

আমাদের কম্বল বিতরন কর্মসূচী আলহামদুলিল্লাহ সফল হয়েছে এবং তার সমস্ত কৃতিত্ব আশার আলো পাঠশালা এবং নাগেশ্বরি গ্রামবাসী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ গণ এবং স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা ও তাদের বাবা- মার … এতো গুছিয়ে , এত অল্প সময়ে আমরা আমাদের প্রয়াস কে সফল করতে পারবো তা আগে থেকে জানা ছিল না এবং বুঝতেও পারিনি। বিশ্বজিত এবং তার সম্পূর্ণ টিম কে ধন্যবাদ জানানোর যথার্থ ভাষা আমার জানা নাই। বিশ্বজিতের পরিবারের আতিথেয়তার প্রশংসা করার যথার্থ ভাষা আমার জানা নাই … যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কে সাহায্য করেছেন এই কর্মসূচী বাস্তবায়নে তাদের কে ধন্যবাদ জানানোর যথার্থ ভাষা আমার জানা নাই … তারপর ও আমাদের এই কর্মসূচীর সাথে জড়িত প্রতিটা মানুষ কে আমি শ্রদ্ধা , ভালবাসা , কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই … আল্লাহ্‌ আমাদের সবাই কে মাফ করুন এবং সমস্ত ভাল কাজে আমাদের কে সফলতা দান করুন এবং আমাদের সকলকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন।

আমরা যারা ঢাকা থেকে নাগেশ্বরী গেছি – রাফায়েত ভাই, কামাল ভাই, টিটু ভাই, ইমরান , হাসান, রীতু- তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা … অনেক বেশি মিস করেছি শ্রাবণী , শুভ্র , আমিনুল ভাই, শাকিল ভাই কে।

নাগেশ্বরী গ্রাম কে বলতে চাই, তোমার জন্য আমার মন খারাপ এবং প্রতিদিন ই আমার মন চাবে তোমার সিক্ত মাটির উপর নগ্ন পায়ে হেঁটে বেড়াতে, তোমার জমির বুকে হাল চাষ দেখতে, তোমার জমির বুকে সোনালী ধানের ছড়া দেখতে, তোমার আযমিত নদীর পানি স্পর্শ করতে, তোমার প্রান্তরের বাঁশঝাড়ে শুয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করতে , তোমার হালট আর মাঠগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার সোনাতুন্দী কে অনুভব করতে , ঘোড়ার টানা গাড়ীতে বয়ে নেয়া খড়ের গাঁদা দেখতে, তোমার মেটে রাস্তায় ধান শুকানো দেখতে, বারবার তোমার কাছে ফিরে যেতে … নাগেশ্বরী, আমার মন খারাপ তোমার জন্য, তোমার বুকে অবস্থান করা মানুষ গুলো আর প্রকৃতির জন্য …