ওই বস্তার ভিতর কী খালাম্মা!!

পাগল মন
Published : 12 June 2012, 08:39 AM
Updated : 12 June 2012, 08:39 AM

জরিনা বেগম হনহন করে হেটে চলেছে। প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত ক্লান্ত, বিষাদে ভরা চোখ দুটো দেখে বোঝা যাচ্ছে, পানি শুকিয়ে গেছে। পিঠে বড়সড় একটা বস্তা। গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে সিএনজি থেকে নেমে দামী বিদেশি ফয়েলে মোড়ানো বস্তাটি পিঠে তুলতে সাহায্য করল সঙ্গে থাকা জরিনা বেগমের দুই মেয়ে। কাউনটারে টিকেট কেটে বাসে উঠতেই বচসা শুরু হল সঙ্গে থাকা বস্তা নিয়ে। কন্ডাক্টর জরিনা বেগম কে কিছুতেই বস্তা সহ সিটে বসতে দেবে না। জরিনা বেগমের চোখের ভাষায় হেরে গেল কন্ডাক্টর। সযত্নে মুখ বাঁধা বস্তাটি সিটে রেখে পাশে বসলেন জরিনা বেগম, পাশের সিটে মেয়ে দুজনকে বসালেন। আগে থেকে বাসে বসে থাকা রহমান মিয়া বেশ উৎসুক হয়ে লক্ষ করছিল ব্যাপারটি। কি আছে মহিলার ওই বস্তায় !! যার জন্য এতো টানাটানি!! তাদের বেশভূষা দেখে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু মাঝারি সাইজের বস্তাটা বেশ দামী মনে হচ্ছে রহমান মিয়ার। গতকাল কোন শিকার পায়নি, কিন্তু আজ কোনভাবেই এই শিকার মিস করা যাবে না, ভাবতে ভাবতে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রহমান মিয়ার।

বাস ছেড়ে দিয়েছে, প্রচণ্ড বাতাসে চুল উড়ছে জরিনা বেগমের, চোখ থেকে যে দুই-একফোটা পানি বের হচ্ছে, বয়ে যাওয়া বাতাস তা পড়তে দিচ্ছে না। বস্তাটি শক্ত করে খামচে ধরে ভাবতে থাকে জরিনা। তড়িঘড়ি করে তাঁকে ডেকে আনা হয়েছে, গতকাল ঢাকায় আসতে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছে। গাড়িঘোড়া ছিল না, ভেঙ্গেভেঙ্গে বাসে, কিছুদূর হেটে তারপর ভ্যান গাড়িতে। সাভারের পর আর গাড়ী আসেনি, দুই মেয়ে নিয়ে সাভার থেকে হেটে ঢাকায় প্রবেশ তাদের। দলে দলে লোক লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিচ্ছে, আবার রাস্তায় মিছিলও দেখল জরিনা বেগম। এসবের কছুই বুঝলনা সে, বোঝার ক্ষমতাও তার নেই। দ্রুত যেতে হবে সেখানে, পথে বাঁধা পেল কয়েক জায়গায়। বহু কষ্ট করে তাদের বোঝাতে হল জরিনা বেগমের। ভুল করে মিছিলে ঢুকে পড়ায়, টানাহেঁচড়া করে বের হয়ে আসতে হল, মিছিলকারীরা কিছুতেই ছাড়বেনা। আসতেই টাকা শেষ হয়ে গেছে, সাভার থেকে হেটেই সেখানে যেতে হল, আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা এক ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে কাজ শেষ করে ফেরার পথ ধরল জরিনা বেগম।

গত দুইদিন কিছুই খায়নি জরিনা, মেয়ে দুইটিও না খাওয়া। রহমান মিয়া পিছন থেকে দেখল মেয়ে দুইটি বারবার বস্তার দিকে তাকাচ্ছে। বাসের দুলনিতে বারবার ঘুম এসে যাচ্ছে জরিনা বেগমের, বেশ কিছুদিন ধরে দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। ঋনের ভারে জর্জরিত জরিনাকে ফিরে যেয়ে একমাত্র টিনের ঘরটি বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হবে। বড় মেয়ের যৌতূকের অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। এখন একটি ছেলে পাওয়া গেছে এক ব্যাঙ্কের দারোয়ান, কিন্তু টিভি ও মোটরসাইকেল যৌতুক দিতে হবে। জরিনা বেগম নিশ্চিত এ ঘরটিও ভেঙ্গে যাবে। বিধবা জরিনা মাটি কাটার কাজ করে, কোথায় পাবে সে এতকিছু!! চিন্তায় ছেদ পড়ে জরিনার, বাস দাড়িয়ে গেছে, মা প্রশ্রাব করব, বলল ছোট মেয়ে। জরিনা নামলেন না, মেয়ে দুইটিকে পাঠালেন, আঁকড়ে থাকলেন বস্তাটি। শিকার মিস হয়ে যাচ্ছে, পিছন থেকে এগিয়ে আসে রহমান মিয়া। "খালাম্মা আপনিও হেগর লগে যান" আমি আপনার বস্তা দেখতাছি, বলল রহমান মিয়া। না!! আমি যামু না, কঠিন কণ্ঠে বলে পরম যত্নে বস্তা কোলে তুলে নেয় জরিনা বেগম। ধৈর্য হারিয়ে ফেলে রহমান মিয়া, কি আছে খালাম্মা পুটলির মইধ্যে? স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকে জরিনা বেগম, দুই চোখ দিয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি। আমার মেঝো মেয়ের ২৮ টুকরা খণ্ডিত লাশ, হাসপাতাল থাইক্কা দিছে…, ফিসফিস করে বলল জরিনা বেগম।

প্রতিদিনের মতো ঢাকা শহরে আজও সূর্য উঠেছে, আবার অস্ত যাবে। ক্রিসেন্ট লেকের লাল কৃষ্ণচূড়া সবুজকে রাঙ্গিয়ে লাল করে দিয়েছে। সাইরেন বাজিয়ে আগেপিছে স্কট নিয়ে গাড়ির বহর ছুটে চলেছে। প্রাক্তন মন্ত্রী কুদ্দুস আলিকে আজ একটা টেন্ডার ড্রপ করতে হবে, আজ খুব কাজের চাপ। বীর মুক্তিযোদ্ধা ঈমান আলি আজ সুইমিংপুলে একটু বেশি সময় ছিলেন, ফুরফুরে মেজাজ তার। গতকাল ভাল কমিশন পেয়েছেন। মাননীয় সাংসদ ফিরোজ শাহ লেক্সসাস নিয়ে এয়ারপোর্ট ছুটে চলেছেন, সময়মত সিঙ্গাপুরের প্লেন ধরতে হবে। সোনারগাঁ, ওয়েস্টিন আর রেডিসনে আজ জমকালো পার্টি হবে, সাজসাজ রব সেখানে। একটা নামকরা গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিক জনাব হজরত আলির মেয়ে সোনিয়ার খুব মন খারাপ, তার পোষা ডগি এরিয়েনের সর্দি হয়েছে, এ নিয়ে হজরত আলি আজ তার অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সভা বাতিল করেছেন।

তথ্য সুত্র: দৈনিক যুগান্তর ১২-০৬-১২