হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করেন যিনি

পাগল মন
Published : 3 June 2012, 11:43 AM
Updated : 3 June 2012, 11:43 AM

সোনারগাঁ কিংবা ওয়েস্টিন হোটেলের বারে বসে ছদ্মবেশী পানিতে চুমুক দিয়ে সুরের মূর্ছনায় বুঁদ হয়ে, সেই অভাগা মহিলার কষ্ট কি অনুভব করা যাবে, যার স্বামী মারা গিয়েছে ক্যান্সারে, উনি নিজে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কেমো নিচ্ছেন, তাঁর একমাত্র মেয়ের কোলোনস্কপি রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসে শুনতে হোল তাঁর মেয়ের কোলোন ক্যান্সার হয়েছে ।
বা, শীতলক্ষ্যায় নৌবিহারে মেরী এন্ডারসনের ডেকে বসে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের ১১ সদস্যের লাশের কফিনের সামনে বসে থাকা সেই যুবকের হাহাকার কি বোঝা যাবে, অথবা, একমাত্র সন্তানকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ঘাতক বুলেটের আঘাতে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া সন্তানের ছোট্ট শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে থাকা সেই পিতার বুকের যন্ত্রণা ।
সামনে পিছনে ছুটে চলা গাড়ির বহরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে রবীন্দ্র গীতির সুরে, নিথর হয়ে পড়ে থাকা বাবা-মায়ের লাশের সামনে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটির চোখের ভাষা কি অনুভব করা যাবে । কিংবা গুলশানের অভিজাত রেস্তরার ড্যান্স ফ্লোরে সুর আর আলোর নৃত্যে সুন্দরীর বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বোঝা যাবে না, ডুবে যাওয়া লঞ্চের কেবিনে আটকে পরা পরিবারের মানুষগুলোর বাঁচার আকুতি, বাবামাকে জড়িয়ে ধরে তাদের দু'সন্তানও চলে যাচ্ছে না ফেরার জগতে

তেমনি, হাজার মাইল দূরে আইফেল টাওয়ারের নিচে, কিংবা নায়েগ্রা জলপ্রপাতের পাশে অথবা হাওয়াই দ্বীপের সমুদ্র তীরে বা লাসভেগাসের ক্যাসিনতে বসে এই অভাগা দেশের দরিদ্র-নিরন্ন মানুষগুলোর কষ্ট, আকুতি আর যন্ত্রণা কোনদিনই অনুভব করা যাবে না । দেখা যাবে না, শত-সহস্র প্রতিকূলতার সাথে নিরন্তর যুদ্ধ করে কি করে এই মানুষগুলো টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে

যাবে, অনুভব করা যাবে, দেখা যাবে, যদি সেখানে বসেও হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ কিংবা লালন করা যায় । যদি হৃদয়ে থাকে ভালবাসা, তাহলে মহাশূন্য খেয়াযানে বসেও এই দেশের হৃদকম্পন অনুভব করা যাবে । অনুভব করার এই ক্ষমতার নামই কি দেশপ্রেম ? কিন্তু সে তো অবসলিট বা বাতিল একটি শব্দ । মূল্যহীন একটি বিষয় । সেদিন এক সেমিনারে অর্থনীতিবিদ এবং সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশপ্রেমের আলাদা কোন ভূমিকা নেই । এই শব্দের ব্যাবহার একটি সস্তা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ । দেশপ্রেম সবার মধ্যে আছে, সবাই দেশকে ভালবাসে এবং এই দেশে থাকতে চায়, কাজেই দেশ প্রেমিক হিসেবে পরিচয় মূল্যহীন একটি উন্মাসিকতা ।

তর্কের খাতিরে বলতে চেয়েছিলাম, যথার্থ বলেছেন আপনি । সবাই দেশকে ভালবাসে, দেশে থাকতে চায় !! ভিসাটা ওপেন করে দেখুন না, প্রমান পেয়ে যাবেন । স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তারাও দেশপ্রেমিক, যারা জীবন নিয়েছে তারাও দেশপ্রেমিক!! একজন মুক্তিযোদ্ধাও দেশপ্রেমিক আবার রাজাকার-আলবদরও দেশপ্রেমিক!! রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর মালিকও দেশপ্রেমিক!! বিদ্যুতের অভাবে গরমে সারারাত বসে রাত কাটায় সেও দেশপ্রেমিক । ডঃ ইউনুস সাহেবও দেশপ্রেমিক, ঋনের ভারে জর্জরিত শোবার ঘর বিক্রি করা জরিনা বিবিও দেশপ্রেমিক।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিল-ঘুসি মেরে কাঁঠাল নরম করে বিক্রি করছে যে, সেও দেশপ্রেমিক । আপনার রসনা নিবারণ করার জন্য তরমুজের মধ্যে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে লাল রঙ পুশ করছে যে, আম-লিচু-কলা পাকাবার জন্য ক্যামিকেল মিশাচ্ছে যারা, আপেল-আঙ্গুর-কমলাতে ফরমালিন, মাছ-মাংসতে ফরমালিন, সমস্ত শাক-শব্জিতে বিষ মিশাচ্ছে যারা, তাঁরা তো পরম পূজনীয় দেশপ্রেমিক জনতা । এই দেশকে তারা প্রানের চেয়েও বেশি ভালবাসে বলেই তো জনগণের কল্যাণসাধনে এইসব ব্রত হাতে নিয়েছে । লক্ষ-লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর হাতে টাকা থাকা নিরাপদ নয় হেতু যারা সেই টাকা নিজের একাউন্টে নিয়ে সযত্নে হেফাজত করছে তারা তো মহান দেশপ্রেমিক ।

কিন্তু যারা সিডনি অপেরা হাউজের সামনে বসে, বা আরবের তপ্ত মরুভূমির গরমে কিংবা নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ক্যাবে বসে অবসরে, বা টেমসের তীরে বসে কিবোর্ড চেপে দেশের জন্য, অভাগা মানুষগুলোর জন্য একের পর এক লিখে যাচ্ছেন, অথবা দেশে যারা নিজের স্বার্থ ও স্বপ্ন বিকিয়ে দিয়ে, এই মাটির জন্য বুকটা চিরে সোঁদা মাটির গন্ধে অবগাহন করে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন সকল অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে, তাঁরা কি সেই অবসলিট বা বাতিল দেশপ্রেমিক ? তাঁরা কি অনুভব করতে পারবেন একজন অভাগা নারীর ২৮ টুকরা খণ্ডিত দেহের বেদনা, অপেক্ষায় থাকা মায়ের হাতে আসা সন্তানের ছিঁড়া জামা আর কংকালের কয়েকটি টুকরা প্রাপ্তির যাতনা, লাখো শহীদের আর্তি, নিরন্ন মুক্তিযোদ্ধার বুকফাটা কান্না, হেরে যাওয়া অভাবি অভাগার চোখের জলের রঙ, বুঝতে পারবেন কি সনাতন আর মান্ধাতা আমলের দেশপ্রেমিকেরা ?