শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

এ কে এম গোলাম রব্বানী
Published : 21 Feb 2012, 09:34 AM
Updated : 13 April 2022, 04:28 PM

পহেলা বৈশাখ বাঙালির অন্যতম লোকজ উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির সর্বজনীন প্রথা ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন আশা, স্বপ্ন, প্রত্যয় ও নব উদ্দীপনায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যাত্রা শুরু হয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন হয়। পাশাপাশি অনেকদিন বিলেতি এবং ফসলি সনও চলেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে খ্রিস্টাব্দে ব্যবহার শুরু হয়। আর উনিশ শতকে এসে তা ব্যাপকতা লাভ করে। আটাশ বছর আগে লেখা বাংলা কাব্যে যে বারোমাসি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, বৎসরের শুরু গণনা করা হয়েছে বৈশাখ থেকে। নববর্ষ উৎসবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতার প্রচলন দেখা যায়। 'হাল' আরবি শব্দ এবং 'খাতা' ফারসি শব্দ। মুসলিম শাসনামলেই 'হালখাতা'র প্রচলন হয়।

পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন বাংলাবর্ষকে বরণ করে নিতে সকালে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ যাত্রা যেন বাংলাদেশের জন্মের শেকড়ের দিকেই এক অভিযাত্রা। এই যাত্রা নিরন্তর অসীমের কাছে পৌঁছানোর সাহস। প্রকৃতির নিয়মে নদীর মতো প্রবহমান বাঙালির এক অনবদ্য বর্ণিল উপাখ্যান। সেই জীবন যাপনের অঙ্গীকার থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা। ১৯৬০- এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়।

দেশের চিরায়ত ঐতিহ্য লোকজ শিল্প ও সংস্কৃতির উপস্থাপনের মাধ্যমে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্র করার লক্ষ্যে ১৯৮৫ (মতান্তরে ১৯৮৬) সালে যশোরে 'চারুপীঠ' নামের একটি সংগঠন প্রথম পদযাত্রার মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করতে বৈশাখী শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। প্রচারের জন্য এর পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন তরুণ ঘোষ। সেই সময় সোনারগাঁর লোকজ হাতির নকশাটিকে (মডেল) প্রমাণ মাপে করা হয়েছে। এই হাতির পাশাপাশি দশটি ঘোড়া বানানো হয়েছিল বাঁশের চাটাই দিয়ে এবং তার উপরে পাতলা চট দিয়ে আবৃত করা হয়। চটের উপর রঙিন কাগজ লাগিয়ে নকশাবহুল করা হয়। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের বছর ১৯৯০ সালে 'এসো গাহি মঙ্গলের জয়গান' শীর্ষক স্লোগান উৎকীর্ণ করে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামকরণের পটভূমি তৈরি হয়। বাংলা ১৪০০ সালে/১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক আয়োজন ও আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। আর ১৯৯৫ সাল থেকেই এ শোভাযাত্রা নিয়মিতভাবে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে আত্মপ্রকাশ করে। উদ্ভূত সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সংগীতশিল্পী ওয়াহিদুল হক এবং ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শিল্পী ইমদাদ হোসেন- এর প্রস্তাবে আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' রাখা হয়। জাতিসত্তার ঐক্য, গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে উচ্চকিত থাকা এবং বাঙালির হাজার  বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক মহামিলনে পরিণত হয়েছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।

প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এমএফএ শেষবর্ষের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে, সম্মানিত ডিন-এর তত্ত্বাবধানে এবং অনুষদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও প্রক্টোরিয়াল মোবাইল টিমের সহায়তা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রায় একমাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম, শিল্পসত্তা ও সৃষ্টিশীল মননের সমন্বয় ঘটিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এতে বাঙালির শাশ্বত লোকজ ঐতিহ্যসমৃদ্ধ শিল্পসামগ্রী যেমন- টেপা পুতুল, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, প্যাঁচা, ময়ূর, মুখোশ, জোড়া মাছ, জোড়া পাখি, বৃক্ষলতা, গুল্ম এবং মানুষের অবয়ব তৈরি করে শোভাযাত্রাকে অনন্য রূপদান করা হয়। এগুলো তৈরিতে বাঁশের চাটাই, খবরের কাগজ, রঙিন কাগজ ও শোলা ব্যবহৃত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে সকলেই এ শোভাযাত্রায় বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রতিককালেও মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শৈল্পিক অবয়ব দিয়ে রঙিন সাজে সাজানোর ফলে নববর্ষ উদযাপন এক শৈল্পিক মিলন মেলায় পরিণত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রাণের রূপে, বাঁশিতে, ভেঁপুতে এবং অভূতপূর্ব সমারোহ ও মুখরতা পেয়েছে তার বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সামষ্টিক অংশগ্রহণ ও কঠোর পরিশ্রম এই শোভাযাত্রার মর্মবাণী আবহমান বাংলার পথ ধরে বহমান বাংলার বর্তমান সময়কেই ব্যাখ্যা করে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ সংস্কৃতির ঘাতক সকল অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার এক শাশ্বত অঙ্গীকার।

মহামারীর আগের বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে পহেলা বৈশাখের দিন সকাল ৯ টায় চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টল মোড় ঘুরে টিএসসি হয়ে চারুকলার অঙ্গনে এসে শেষ হতো। 

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সমগ্র বিশ্বে জীবন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জীবিকার উপর ভীষণরকম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার থেকে আমরাও দূরে নয়। জাতীয় পর্যায় থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে সব ধরনের কাজ সীমিত পরিসরে এবং জীবন ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে অনেক জাতীয় ও প্রতিষ্ঠানিক কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এমন অবস্থার শিকার হয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন ১৪২৭ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি খানিকটা উন্নতি হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অভ্যন্তরে ১৪২৮ সনে প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। 

দীর্ঘ দু'বছর পর কোভিড পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতির ফলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলমান থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উদযাপন কার্যক্রম গ্রহণের জন্য উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান-এর সভাপতিত্বে সম্মানিত সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যরা, ডিন, প্রভোস্ট ও ওয়ার্ডেন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউটের পরিচালক, অফিস প্রধান, প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধরণ সম্পাদকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকবৃন্দের সমন্বয়ে ৩রা এপ্রিল বেলা ১১টায় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনকে সুচারুভাবে সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ২৫টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রো-উপাচার্য বিশিষ্ট কবি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক এবং চারুকলা অনুষদ- এর ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনকে সদস্য সচিব করে বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উদযাপনের কেন্দ্রিয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। 

অনুষ্ঠানের দিন ক্যাম্পাসে শৃংখলা ও নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার অভিপ্রায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানীকে আহ্বায়ক ও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মো. আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব করে শৃংখলা উপ-কমিটি গঠিত হয়। তাছাড়া চারুকলা অনুষদ- এর ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনকে আহ্বায়ক এবং সহকারী প্রক্টর মো. নাজির হোসেন খানকে সদস্য সচিব করে মঙ্গল শোভাযাত্রা উপ-কমিটি গঠিত হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় ঝুঁকি ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলা নববর্ষের দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যথাসম্ভব সীমিত লোকসমাগম করার বিষয়টি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহযোগিতা কামনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তটি ইতোমধ্যে গণমাধ্যম, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপনের চিরাচরিত পথ চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় ঘুরে টিএসসি হয়ে চারুকলার অঙ্গনে এসে শেষ করার রেওয়াজে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উদযাপন উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের দিন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সম্মুখস্থ সড়কদ্বীপ থেকে সকাল ৯টায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে দিয়ে স্মৃতি চিরন্তন হয়ে ইউটার্ন নিয়ে সড়কদ্বীপে এসে শেষ হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নির্বিঘ্নে প্রদক্ষিণ ও নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট বাহিনী কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া শোভাযাত্রার কোন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা যেন না করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য সংশ্লিষ্ঠদের অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। নববর্ষের দিন ১৪ এপ্রিল সকাল থেকেই কোন ধরনের যানবাহন ক্যাম্পাসে চলাচল না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ও মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  

প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে মঙ্গল শোভাযাত্রার মূলভাবকে একটি স্লোগানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পহেলা বৈশাখ-১৪২৯ উদযাপন- এর লক্ষ্যে মূলভাবের সাথে সঙ্গতি রেখে স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে। তা হলো 'নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে'। যা  বিখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন- এর গান থেকে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা উপলক্ষে একটি লোগোও তৈরি করা হয়। বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতাকে উপলক্ষ করে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করার অভিপ্রায়ে নির্ধারিত স্লোগান সংবলিত টি-শার্ট ও ফেস্টুন এবং মনোরম পোস্টার তৈরি করা হয়। এই টি-শার্ট, ফেস্টুন মঙ্গল শোভাযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রস্তুতকৃত পোস্টার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রকাশিত হয় এবং দেশব্যাপী মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচার ও প্রসারের জন্য দেশের সকল জেলায় পোস্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা মুখোশ, সরাচিত্র ইত্যাদি তৈরি করে এবং শিক্ষকবৃন্দ ও বিশিষ্ট শিল্পীরা ছবি আঁকেন, যা সাধারণ জনগণ ক্রয় করে। জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন আজ আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে কেনিয়ার নাইরোবিতে ইউনেস্কোর সম্মেলনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম অংশ নেন; সেখানে বিভিন্ন দেশের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সম্মেলনের পরে তিনি সর্বপ্রথমে জামদানি, পরে নকশিকাঁথা, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ অন্যান্য নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক উপাদান প্রেরণ করার নিদের্শনা দেন। সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের (সদ্যপ্রয়াত) সুপারিশ মোতাবেক ড. ফিরোজ মাহমুদকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপারিশ করে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। ২০১২-২০১৫ অর্থবছরে ইউনেস্কোর Intergovernmental Committee for the Safeguarding of the Intangible Cultural Heritage- ২০১২ থেকে ২০১৫ অর্থবছরে Intangible Cultural Heritage– এর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রেজিস্ট্রেশন/অন্তর্ভুক্তি শীর্ষক কর্মসূচি অনুমোদিত এবং বাংলা একাডেমির সচিব জনাব মো. আলতাফ হোসেনকে কর্মসূচির পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০টি নির্বস্তক সাংস্কৃতিক ঐহিত্য তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা হয়। বাংলা একাডেমির তৎকালীন সচিব জনাব মো. আলতাফ হোসেনকে আহবায়ক করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৩ মালের ১৪ এপ্রিল 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, ফিরোজ মাহমুদ কর্তৃক প্রণয়নকৃত "মঙ্গল শোভাযাত্রা"র মনোনয়ন প্রস্তাব, দশটি রঙিন আলোকচিত্র এবং দশ মিনিটের ভিডিও ক্লিপ ইউনেস্কোতে প্রেরণ করেন। ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'কে নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য- এর উপাদান হিসেবে মনোনয়নের সুপারিশ করে। ২০১৫ সালের পয়লা জুন  স্টেট পার্টির পক্ষে প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম সহিদুল ইসলাম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'কে নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেন। ২০১৬ মালের ২৮ নভেম্বর ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় ইউনেস্কোর ১১তম অধিবেশনে বাংলাদেশের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' (Draft Decision: 11.COM 10.b.3) নমিনেশন ফাইল নম্বর ০১০৯১-কে বিশ্ব Intangible সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে 

এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথমত, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মননশীল সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের একটি উপাদান; দ্বিতীয়ত, উপাদানটির দৃষ্টিগ্রাহ্যতা (ফিজিবিলিটি) প্রমাণ করতে হয়; তৃতীয়ত, রক্ষাকবচ নিশ্চিত করতে হয়; চতুর্থত, ব্যবহারজীবী ও বাহকদের সম্মতি এবং সর্বশেষ এটি বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিকভাবে উদযাপিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

বাংলা নববর্ষ বরণের বর্ণিল উৎসব 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি জাতির দুর্বার আকর্ষণ রয়েছে। এই শোভাযাত্রা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসব হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত। জাতির পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠান ও সর্বসাধারণের সার্বিক সহায়তা ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের মাধ্যমে দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছে। যার ভিতর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ, মুক্তচিন্তার বিকাশ ও লালন, লিঙ্গসমতা, মনন এবং মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির বার্তাই বহন করে চলেছে।