যানজট ও গণপরিবহণ দুষ্টচক্র-সমস্যা ও সম্ভাবনা (১ম পর্ব)

সরকার
Published : 3 June 2011, 12:51 PM
Updated : 3 June 2011, 12:51 PM

এই পর্বে আমার আলোকপাত শুধুমাত্র সমস্যাগুলো নিয়ে। পরবর্তী পর্বে সমাধান নিয়ে আলোচনা করব বলে আশা রাখি। সারাদেশে গণ-পরিবহণ এর দুষ্টচক্রে সাধারণ জনগণ জিম্মি। সরকারের আপাতত সমাধান নীতিতে জটিলতা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এদেশের ট্রাফিক পুলিশ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু তাদের প্রকৃত কাজ ছিল ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। আর দুই মাস পরেই রোজা শুরু। বিগত বৎসরে দেখেছি যানজট এড়াতে সরকার স্কুলসময়ে রোজার সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। বিষয়টি মাথা কেটে মাথা ব্যথা সারানোর মত মনে হয়েছে আমার কাছে । ব্লগার জনাব ফারুক দাবি করছেন উনি একটি সমাধান বের করেছেন। উনার ব্যবস্থাপত্র কতটুকু কার্যকর হবে জানি না। তবে জন-গুরুত্বসম্পন্ন একটি বিষয় নিয়ে ভাবার জন্য উনাকে সাধুবাদ জানাই। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি উনার দৃষ্টিতে যানজটের একমাত্র কারণ ট্রাফিক সিগন্যাল, এবং সমাধান হচ্ছে মিনি ফ্লাইওভার। আমার দৃষ্টিতে এটি যানজটের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি এবং সমন্বিত সমাধানের একটি উপায় মাত্র। যানজট দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু ট্রাফিক সিগনাল সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না এর অর্থ হল সিগনালই যানজটের একমাত্র কারণ নয়।

তাহলে যানজটের অন্যান্য কারণগুলো কি হতে পারে-

এ ক্ষেত্রে ঢাকা শহরকে বিবেচনা করে শুধুমাত্র সহজে সমাধানযোগ্য কারণগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করছি আর যে সকল সমস্যা দ্রুত সমাধানযোগ্য নয়, যেমন- অধিক জনসংখ্যা, রাস্তার স্বল্পতা, অপরিকল্পিত নগর,মেট্রো-রেল, ফ্লাইওভার ইত্যাদি বিষয়সমূহ আলোচনার বাইরে রাখা হল।

০১) শ্রম-নির্ভর(রিক্সা,ভ্যান, ঠেলা ইত্যাদি) ও যন্ত্র-নির্ভর(বাস,ট্যাক্সি,অটো ইত্যাদি) একই রাস্তায় চলাচল। স্বল্প গতির যানবাহন দ্রুতগতির যানবাহনসমূহের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

০২) বড় যানবাহন এর তুলনায় ছোট যানবাহন এর সংখ্যা বেশী। ২০১০ সালে শুধু ঢাকায় বাস/মিনিবাস বেড়েছে ১২৪৩টি সেখানে ছোট গাড়ী বেড়েছে ২৭,৬০৬ টি। অর্থাৎ ২২ টি ছোট গাড়ির বিপরীতে ০১টি বাস বেড়েছে। ছোট গাড়ির(প্রাইভেট কার, স্টেশন ওয়াগন, সি,এন,জি অটো) গড় যাত্রীসংখ্যা ২ জন এবং বাসের যাত্রী সংখ্যা ৫০ জন হলে ২৫ টি ছোট গাড়ির যাত্রী ১টি বাসে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে। এবার দেখা যাক ১০০০ জন যাত্রীর একটি হিসাব নিলে ২০ টি বাস হলেই চলে সেখানে ঢাকা শহরে ১০০০ যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হয় ১০টি বাস এবং ২২০ টি ছোট গাড়ী। ২০টি বাসের স্থলে ছোট বড় মিলিয়ে ২৩০টি গাড়ী চললে রাস্তায় যানজট হবে এটাই স্বাভাবিক।

০৩) নিরাপত্তা-হীনতা- বিশেষ করে সন্তানদের নিরাপত্তা বিবেচনা করে অভিভাবকরা স্কুল কলেজে যাতায়াতের জন্য ছোট গাড়ী ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। দু-একটি হাতে গোনা স্কুল/কলেজ ছাড়া কারোরই নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থা নাই।

০৪) রিক্সা চালকের কোন লাইসেন্স না থাকায় অবৈধ রিক্সার পরিমাণ বেশী। তুলনামূলক-ভাবে একটি রিক্সার মূল্যের তুলনায় আয় বেশী থাকায় মালিক-গন লাইসেন্স ছাড়াই রিক্সা রাস্তায় নামিয়ে দেয়।

০৫) স্বল্প দূরত্বে বাস ভাড়া বর্তমানে ৭ টাকা হওয়ায় ২জন যাত্রী বাসে না চড়ে ১৪ টাকায় সমদূরত্ব ভ্রমণের জন্য রিক্সা বেছে নেয়।

০৬) পর্যাপ্ত ফুটপাথ না থাকায় এবং ফুটপাথে হকারদের দখলদারিত্ব, বখাটেদের উপদ্রব, দোকান/বাজার এবং চোর, ছিনতাইকারী, ভিক্ষুক এর উপদ্রব থাকায় পায়ে না হেটে যাত্রীরা যানবাহন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়। অফিস-পাড়ায় ফুটপাথের আরেকটি সমস্যা হল এয়ার কন্ডিশনারের পানি বৃষ্টির মত পথচারীদের গায়ের উপর পড়া।

০৭) রাস্তা ইজারা প্রদান- সিটি কর্পোরেশন রাস্তায় পার্কিংয়ের জন্য ইজারা প্রদান করে রাস্তা দখল করে রাখে। এছাড়াও রাস্তার উপর গৃহ নির্মাণ সামগ্রী রেখে বা গাড়ী মেরামতের কাজ করার মাধ্যমে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

০৮) ভিআইপি চলাচলের জন্য অনেকসময় ধরে সকল গাড়ী চলাচল বন্ধ রাখা হয়, যা যানজটের অন্যতম একটি কারণ।

০৯) বাস রুটসমূহের নির্ধারিত কোন স্টপেজ নাই, তারা যেখানে খুশী যাত্রী উঠানো নামানোর কাজ করে। অধিক সংখ্যক স্থানে থামানো বা ধীর করনের জন্য বার বার তাকে লেন বদলাতে হয় এবং অন্যান্য গাড়ীর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।

১০) সমন্বয়-হীন, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যেমন বি,আর,টি,এ, ট্রাফিক পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন এর অদক্ষতা।

১১) আই,টি এর কম ব্যবহার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের স্বল্পতা, শুধুমাত্র ছোটখাটো তথ্য সংগ্রহ বা চিঠি চালাচালির জন্য অনেক মানুষের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতে হয়, যার কারণে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়।

১২) বামের লেন বন্ধ করে গাড়ি থামানোর কারণে যানজট বাড়ে। বামের লেনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিভাইডার নাই।

১৩) ফুট ওভার ব্রিজ এর উপরে উঠা বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য কষ্টকর শুধু উঠার জন্য চলন্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকলে পথচারীদের ওভার ব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহ থাকতো।

১৪) সিগনাল এর পরিবর্তে ইউ টার্ন এর ব্যবস্থা নিলে যানজট কমতো (সাইন্স ল্যাব মোরের মত)

১৫) ট্রাফিক আইন অমান্য করার জন্য তেমন কোন শাস্তি পেতে হয় না। এ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগে সরকারের অনীহা।

১৬) সরকারের এ খাতটি রাজস্ব আয়ের উৎস হিসাবে চিন্তা না করা। অনেক দেশেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গের দায়ে আদায়কৃত জরিমানা সরকারের বড় রাজস্ব আয়ের উৎস।

১৭) যানবাহন শ্রমিকদের কলুষিত রাজনীতিতে জড়ানোর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের আইন প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করা। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সরকারি নজরদারি বাড়ানোয় অনেক বাস বন্ধ রেখে কৃত্রিম যান-সংকট তৈরই করে যাত্রীদের হয়রানি আরও বাড়ানো হয়েছে।

১৮) অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি (গ্যাস, বি,টি,টি,বি, সিউয়ারেজ,পানি সরবরাহ কাজে) যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়।

১৯) রাজনৈতিক সভা সমাবেশ মিছিল

২০) সকল ধরনের গোলযোগের প্রতিক্রিয়ায় গাড়ি ভাঙচুর এর রাজনীতি।

২১) যান সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র প্রদানে দুর্নীতি।

২২) যানবাহনে চাঁদাবাজি।

এর সাথে পাঠকগণকে যেকোনো বিষয় সংযুক্ত করার অনুরোধ করছি। পরবর্তী পর্বে এর প্রতিকার সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করব।