বিষণ্ন বাংলাদেশ

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 27 April 2011, 06:06 AM
Updated : 2 Jan 2014, 06:25 PM

প্রায় ছয়মাস আগে আমি ঠিক করেছিলাম যে প্রতি দুই সপ্তাহে আমি একটি করে কলাম লিখব। যারা লেখালেখি করেন তারা জানেন এটা একটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত– প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে কলাম লেখা সোজা ব্যাপার নয়।

তারপরেও আমি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দুটি কারণে; প্রথমত, এই দেশের অনেকগুলো পত্রিকা সেটি একই সঙ্গে ছাপাতে রাজি হয়েছে। সারা পৃথিবীতে লেখকদের সম্মান দেওয়ার এই ব্যাপারটি আমার এই কলাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবার শুরু হল। দ্বিতীয়ত, আমার অসংখ্য বিষয় নিয়ে অসংখ্য জিনিস লেখার আছে। পাঠকেরা আমার সব মতামত মেনে নিবেন সেটা আমি কখনও আশা করি না (কিংবা চাই না)। কিন্তু কয়েক মিনিট সময় দিয়ে সেটা অনেকে পড়তে রাজি থাকবেন সে রকম আশা করা এমন কিছু দোষের নয়। কাজেই আমি ধরেই নিয়েছিলাম লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে আমার কখনও সমস্যা হবে না।

লেখার বিষয়ের এখনও কোনো অভাব নেই, কিন্তু আমি সেগুলো নিয়ে লিখতে পারছি না। আমি যখন এটা লিখছি তখনও নূতন বছর শুরু হয়নি। কিন্তু এটা যখন প্রকাশিত হবে তখন নূতন বছর শুরু হবে। এই বছরটি শুরু হবে অবরুদ্ধ থেকে। একটা অবরুদ্ধ দেশে যখন মানুষকে গাড়ির ভেতরে পুড়িয়ে মারার কালচার তৈরি হয়েছে, ককটেলে শিশুর হাত উড়ে যাওয়া নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা, শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক দল করে বলে একজন মহিলাকে মাটিতে ফেলে তাকে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে সেটার সপক্ষে একটা যুক্তি পর্যন্ত দাঁড় করানো যায়– তখন আসলে বিচিত্র বিষয়ে কলাম লেখার ইচ্ছে করে না। তাই গত কয়েক মাস থেকে দুই সপ্তাহ পরে পরে কলাম লেখার দায়িত্বটি আমার জন্যে আনন্দময় অভিজ্ঞতা নয়। অনেক সময়েই মন খারাপ করার সময়।

অথচ গত সপ্তাহটি খুব আনন্দময় একটি সময় হতে পারত। পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণির সম্মিলিত পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে এই সপ্তাহে। পরীক্ষা দুটির গালভরা দুটি নাম আছে; এইচএসসি এবং এসএসসি-এর কাছাকাছি জেএসসি এবং পিএসসি! ছোট ছোট বাচ্চারা গম্ভীর হয়ে পরীক্ষা দিতে যায়। আবার সারা দেশব্যাপী সব ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে পরীক্ষার ফল বের হয়। টেলিভিশনে তার ঘোষণা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে একটা হুলুস্থূল ব্যাপার। যেদিন পরীক্ষার রেজান্ট হয় সেদিন বাচ্চারা স্কুলে এসে ভিড় করে। ক্যামেরার সামনে তাদের মুখের হাসি দেখলে আমাদের হতাশা, দুঃখ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়!

এবারে যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হবে সেই দিনই সরকার আর বিরোধী দলের শক্তিপরীক্ষা। সংসদ ভবনের ভেতরে মাইক্রোফোনে সরকার আর বিরোধী দলের শক্তিপরীক্ষা যতটুকু সুন্দর, পথেঘাটে রাস্তায় তাদের শক্তিপরীক্ষা ঠিক ততটুকু অসুন্দর। তাই আমরা দেখেছি স্কুলে স্কুলে ছেলেমেয়ে বলতে গেলে নেই, তাদের ভেতর সেই উচ্ছাস নেই, সেই আনন্দ নেই। পুরো জাতি তাদের সেই হাসিমুখ দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হল।

পরীক্ষার রেজাল্ট খুবই ভালো। আমরা সবাই খুব আনন্দিত। কিন্তু তরপরেও একটা ব্যাপার নিয়ে আমার ভেতরে একটু দুর্ভাবনা রয়ে গেছে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা করে স্কুল থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্যে তৈরি হলেও, আশেপাশের বাচ্চারাও পড়তে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্কুলটা রয়েছে সেটা পরিচালনা করার যে কমিটি আমি তার আহবায়ক। তাই প্রয়োজন অপ্রয়োজনে স্কুলে গিয়ে বসে থাকি; বাচ্চাদের ছুটোছুটি, দুষ্টুমি দেখি (তারা কখনও আমাকে নিরাশ করে না)। মাঝে মাঝে স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও কথা বলতে হয়।

স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে একবার এ রকম একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল, অষ্টম শ্রেণি পাশ করে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর কারা বিজ্ঞান পড়বে সেটি কীভাবে ঠিক করা হবে সেটি ছিল আলোচনার বিষয়। আমি বললাম, জেএসসির রেজাল্ট দেখলেই বোঝা যাবে কার কোন বিষয়ে আগ্রহ, কোন বিষয়ে দক্ষতা, সেটা দিয়েই ঠিক করে নেওয়া যাবে। শিক্ষকেরা নিজেদের ভেতর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর একজন সাহস করে বললেন যে, আসলে জেএসসির রেজাল্ট সবারই এত অস্বাভাবিক রকম ভালো থাকে যে সেটা খুব বেশি বিশ্বাস করা যায় না। স্কুলের নিজস্ব পরীক্ষাগুলো আরও বেশি নির্ভরযোগ্য!

আমি এই কথাগুলো আরও অনেকবার শুনেছি। কাজেই আমার মনে হয় বিষয়টা হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটু ভেবে দেখা দরকার। আমরা চাই সবাই ভালো করুক। আবার এটাও চাই যে, তাদের পরীক্ষার নম্বরটা আরেকটু নির্ভরযোগ্য হোক। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এটা মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে সৃজনশীল লেখাপড়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছি। নূতন একটা পদ্ধতির শুরুটা সহজ করার জন্যে প্রথমদিকে হয়তো একটু ছাড় দেওয়া হয়েছে। পদ্ধতিটা যেহেতু সবাই গ্রহণ করে ফেলেছে, এখন পরীক্ষার পদ্ধতিটা আরেকটু বেশি নির্ভরযোগ্য করার সময় হয়েছে।

কিন্তু এখন সারা দেশে নির্বাচনের সপ্তাহ। সবার ভেতরে সেটা নিয়ে একটা চাপা দুর্ভাবনা আমি দেখেছি। শুধুমাত্র গণিতের বিষয়গুলো এমনভাবে যুক্তির ওপর যুক্তি দিয়ে দাঁড়া করানো হয় যে সেটাকে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না– অন্য যে কোনো বিষয়কে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে।

তার সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে আমাদের টক শোগুলো। আমি এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কীভাবে একটি বিষয়কে দুজন মানুষ দুভাবে দেখছে এবং দুভাবে ব্যাখ্যা করছে। আলাদাভাবে শুনলে দুজনকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কিন্তু একসঙ্গে শুনলে বোঝা দায় একজন আরেকজনের পুরোপুরি উল্টো কথা বলছেন! কথা বলার সময় একই সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্ন কথা বলা খুব সোজা, কিন্তু কাজে লাগানোর সময় একই সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্ন বা বিপরীত বিষয় বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হয়।

আমাদের নির্বাচন নিয়ে সারা পৃথিবীর সব দেশের খুব আগ্রহ। সবাই একবার একবার করে এসে বড় বড় কথা আর ভালো উপদেশ দিয়ে গেছেন। তবে সাদা চামড়া দেখলেই আপ্লুত হওয়ার দিন মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে যাওয়ার সৌজন্যতাটুকু পর্যন্ত যখন দেখানো হয় না তখন সেই সাদা চামড়া থেকে সাবধান থাকা ভালো। সারা পৃথিবীতে তাদের জন্যে এক রকম নিয়ম, বাংলাদেশে তাদের নিয়ম অন্য রকম– সেই কারণটা কি তাদের মুখ থেকে খুব শুনতে ইচ্ছে করে!

যাই হোক, নানা রকম আলাপ, আলোচনা, উপদেশের পর দেখা গেল শেষ পর্যন্ত সবার আশাতেই গুড়ে বালি। এখন মোটামুটি নিশ্চিত পুরো ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হবে গায়ের জোরে। আমরা সবাই সেটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি। সবার ভেতরে একটা চাপা দুর্ভাবনা।

কিন্তু এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। খবরের কাগজে ছোট একটা সংবাদ সবার চোখ এড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাসে যখন জামায়াতে ইসলামীর নৃশংস তাণ্ডব একটা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে ঠিক তখন গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতারা একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলেন তারা জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ করে একসঙ্গে থাকবেন। সেই থেকে তারা একসঙ্গে আছেন এবং তাদের উপশহরে সেই থেকে কোনো ভায়োলেন্স নেই।

সারা দেশ যখন একটা জটিল সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, সারা পৃথিবী থেকে বড় বড় লোকজন হরতাল-অবরোধের মাঝে ঢাকা এসে ছোটাছুটি করছেন, লেখাপড়া বন্ধ, যোগাযোগ বন্ধ, বাড়িঘর পোড়ানো হচ্ছে, মানুষকে মারা হচ্ছে– তখন একটা উপশহরের রাজনৈতিক নেতারা পাশাপাশি বসে আলাপ-আলোচনা করে তার সমাধান করে ফেললেন।

সমস্যাটি যত জটিল সমাধানটা ঠিক তত সহজ। একাত্তর সালে যে দলটি বাংলাদেশকে চায়নি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে– এই দেশে রাজনীতি করার তাদের কোনো অধিকার নেই। অন্য যারা আছেন তারা পাশাপাশি রাজনীতি করবেন, কেন্দ্র থেকে তাদের যে কর্মসূচি দেওয়া হয় তারা সেটা পালন করবেন, কেউ কাউকে বাধা দেবেন না। খুবই সহজ-সরল একটি মডেল তাদের জন্যে কাজ করেছে, সারা বাংলাদেশের জন্যে কেন কাজ করবে না?

আমি পত্রিকার সম্পাদক নই। যদি পত্রিকার সম্পাদক হতাম তাহলে আমার পত্রিকায় বড় বড় করে এটা ছাপাতাম। সবাইকে বলতাম এই দেশের সমস্যা সমাধান করার জন্যে বাইরের দেশের সাদা চামড়াদের দরকার নেই, আমাদের দেশের মানুষেরাই আমাদের দেশে এর সমাধান করতে পারে।

কিন্তু আমি পত্রিকার সম্পাদক নই, তাই এই খবরটা সবার অগোচরে ছাপা হয়ে সবার চোখের আড়ালে থেকে গেছে।
আমি এখনও বিশ্বাসে বুক বেঁধে আছি। বাংলাদেশের মানুষের মতো কষ্টসহিষ্ণু, সহনশীল মানুষ পৃথিবীতে নেই। যখন দেশের সবচেয়ে বড় দুঃসময় তখন তাদের সবচেয়ে সুন্দর রূপটি বের হয়ে আসে, সেটি আমার জীবনে নিজের চোখে দেখেছি। রানা প্লাজার সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর সাধারণ মানুষেরা যেভাবে তাদের ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই। রানা প্লাজার মালিকদের লোভের কথা অনেকবার আলোচিত হয়েছে। কিন্তু যে মানুষগুলো, তরুণগুলো পৃথিবীর ভয়ংকরতম পরিবেশে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের জীবন দিতেও দ্বিধা করেননি, সেই কথাগুলো কিন্তু সেভাবে আলোচিত হয়নি।

এই দেশের মানুষ কত অল্পে সন্তুষ্ট হয় আমি জানি, আমি অসংখ্যবার নিজের চোখে দেখেছি। বন্যায় যখন দেশ ডুবে যায়, অসহায় পরিবারগুলো গুরু-বাছুর নিয়ে রাস্তায় উঠে আসে, তখন তাদের মুখ দেখে কখনও মনে হয় না সেখানে রাগ, দুঃখ বা অভিযোগ রয়েছে– মনে হয় তারা বুঝি সব আনন্দ মেলায় এসেছিল! ছোট শিশুদের ছুটাছুটি, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া– সব যেন বিশাল আনন্দের অংশ। ঢাকা শহরে হঠাৎ বৃষ্টিতে যখন রাস্তাঘাট ডুবে যায়, স্কুলফেরত কিশোরী মেয়েটি সেই কাদামাখা হাঁটু পানিতে ছপ ছপ করে হেঁটে যায়, কখনও তার মুখে দুঃখ-ক্ষোভ-অভিযোগ থাকে না, তার মুখভরা হাসি! মনে হয় কী মজাটাই না হচ্ছে। হাজার হাজার গার্মেন্টসের মেয়ে সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করতে যায়, কেউ কি কখনও তাদের মুখ ভার করে যেতে দেখেছে?

আমাদের দেশের এই অপূর্ব মানুষগুলো আমাদের শক্তি। কতবার এই মানুষগুলোকে আঘাতের পর আঘাত করে নুইয়ে দেবার চেষ্টা করেছে, পারেনি। প্রত্যেকবার তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এই মানুষগুলো যখন তীব্রভাবে কিছু একটা চাইবে সেটাকে কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না। সেটাকে উপেক্ষা করে কেউ টিকতে পারবে না।

বাংলাদেশের মানুষ এই অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্তি চায়। কোন পথে সেই অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্তি আসবে সেটি দেশের সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। তারা সেটা জানে না। কিন্তু তাদেরকে এই অসহনীয় পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তিকে অবমাননা করা যাবে না।

কীভাবে সেটি করা হবে আমরা জানি না। কিন্তু সেটি করতে হবে। আমরা এই বিষণ্ন বাংলাদেশ দেখতে চাই না।

১.১.১৪

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।