বর্তমান বাস্তবতায় পলাশীর পরাজয়

সালেহ নোমান
Published : 23 June 2012, 11:51 AM
Updated : 23 June 2012, 11:51 AM

প্রতি বছর ২৩জুন পলাশী দিবসে একজন ব্যক্তি, একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবককে খুবই মনে পড়ে। তিনি হচ্ছেন বিলুপ্ত দৈনিক বাংলার বানীর নির্বাহী সম্পাদক শফিকুল আজিজ মুকুল ভাই। বিভিন্ন সময় এই দেশ বিদেশিরা কিভাবে দখল করেছে এবং ভবিষ্যতে কেউ এই দেশে বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা অথবা থাকলে কিভাবে হবে, একবার তার একটা দৃশ্যকল্প তিনি হাজির করেছিলেন আমাদের সামনে। আমি বলতে আমি, বর্তমানে বার্তা সংস্থা ইউএনবি চট্টগ্রামে কর্মরত মুস্তফা নঈম ভাই এবং কবি ত্রিদিব দস্তিদার।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বর- অক্টোবরের কোন এক সময় মুকুল ভাইয়ের সাথে তার পুরানা পল্টনের বাসায় আমি এবং নঈম ভাই দেখা করতে যায় । সেখানে কিছুক্ষণ পর হাজির হন কবি ত্রিদিব দস্তিদার। আমি, নঈম ভাই এবং ত্রিদিব দা তিনজনই চট্টগ্রামের মানুষ। তখন চট্টগ্রাম বন্দরের স্পর্শকাতর একটি এলাকা আমেরিকান কোম্পানী এসএসএকে দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছিলো দেশ ব্যাপি।

এই আলোচনার সূত্রধরে মুকুল ভাই বলছিলেন, ভবিষ্যতে কেউ এই দেশ দখল করলে তাদের সৈন্য সামন্ত পাঠিয়ে যুদ্ধ করতে হবেনা। কোন কোম্পানিকে টেন্ডার দিয়ে দিলে তারাই নানা কায়দা কানুন করে এই দেশ দখল করবে। এর পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ভারতবর্ষ কিন্তু বৃটিশ সরকার দখল করেনি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামক একটি কোম্পানিকে দিয়ে দখল করেছিলো। এবং এই কোম্পানীটির মাধ্যমে দীর্ঘ দিন শাসন শোষণও করেছে।

সেদিন পলাশীতে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাকে যে প্রক্রিয়ায় পরাজিত করা হয়েছে তার উদাহরন টেনে মুকুল ভাই ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন যে বাংলাদেশের সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে যে দ্বিধা বিভক্তি তাতে ভবিষ্যতেও একই রকম ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটা খুবই স্বাভাবিক। মুকুল ভাই এর এই বিশ্লেষণ আমার খুবই পছন্দ হয়েছিলো।

মূলত এই কারনে পলাশী দিবসের ঘটনাটিকে আমি বিশেষভাবে দেখা শুরু করি। আর এই দিনটির কথা মনে পরলে মুকুল ভাই চলে আসেন আমার সামনে।

পলাশী প্রান্তরে ১৭৫৭ সালের ২৩জুনেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ২৩জুনের এই ঘটনাকে ইতিহাসে পলাশী যুদ্ধ বলা হলেও সেদিন আসলে মঞ্চস্থ হয়েছে যুদ্ধ যুদ্ধ নাটক। সিরাজের আমলা , সেনাপতি আর এদেশীয় উচ্চস্তরের বনিক শ্রেণীকে হাত করে ইংরেজ রবার্ট কাইভ পলাশীতে বাংলার স্বাধীনতার কবর রচনা করেছিলো।

১৯৪৭ সালেও কিন্তু পাকিস্থানীদের যুদ্ধ করে এই দেশ দখল করতে হয়নি। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে আমাদের নেতারা কখন যে আমাদেরকে হাজার মাইল ওপারের পাকিস্থানীদের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন সেটা হয়তো তারা টেরও পাননি। কিন্তু আমাদেরকে ঠিকই পাকিস্থানীদের তাড়াতে হয়েছে যুদ্ধ করে। বাংলাভাষী দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষে এত বেশি ছিল যে এক সম্প্রদায় গেল হিন্দিভাষী ভারতীয়দের সাথে এবং অপর পক্ষ গেল উদূভার্ষী পাকিস্থানীদের সাথে।

তারও আগে ১২০৬ সালে তুর্কি যুবক বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৭ জন অস্ত্রধারী সহযোগী নিয়ে এই ভুখন্ডের অধিপতি লক্ষন সেনের রাজ প্রসাদ দখলে নিয়েছিল। তখনও কিন্তু বিদেশী বখতিয়ার খিলজীকে যুদ্ধ করতে হয়নি। ষাট বছরের গৌড়ের অধিপতি লক্ষন সেন কোন প্রতিরোধই করতে পারেনি। দিল্লির প্রতিনিধি হয়ে গৌড় দখল করা বখতিয়ার খিলজীকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি লক্ষণ সেনের সৈন্য বাহিনী কিংবা দেশের জনগন।

এভাবেই বারবার আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি, হয়েছি পরাধীন। ইতিহাসের পরতে পরতে কেন এবং কিভাবে এই রকম ঘটনা ঘটছে বর্তমানের ঘটনা প্রবাহ দেখলে তা উপলব্ধি করতে আমার খুব মাথা ঘামাতে হয়না। একই পতাকা তলে বসবাস করে এত দ্বিধা বিভক্তি, এত রেষারেষি আর বিদ্বেষ স্বাধীনতা হরন করতে যারা ওত পেতে থাকে তাদের জন্য বড় সুযোগও বটে। ইতিহাসইতো প্রমান করে এত রেষারেষিতে বিভক্ত জাতি কখনো তার পতাকার মর্যাদা বজায় রাখতে পারেনি।

আর ইতিহাসের উল্লেখিত ঘটনাগুলো প্রমান করে স্বাধীনতা যখন খোয়া যাচ্ছে তখন কিন্তু উপলব্ধি করতে পারেনি এখানকার মানুষরা, তাদের বোধদয় হয়েছে আরো অনেক পরে।

আমরা এইভাবে আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাইনা……………