এই ভূখণ্ডের অতিথি- ইবনে বতুতা থেকে হিলারী ক্লিনটন

সালেহ নোমান
Published : 7 May 2012, 09:43 AM
Updated : 7 May 2012, 09:43 AM

চিরায়ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি আর মুসলিম ঐতিহ্য অনুযায়ী অতিথির বিশেষ গুরুত্ব আমাদের কাছে। অতিথির কাছ থেকে কোন কিছু চাওয়া বা উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা এই ঐতিহ্যের বিরোধী। কিন্তু অতিথি জ্ঞানে, মানে, এবং ধনে গৃহকর্তার চেয়েও উচ্চতর কেউ হলে সে ক্ষেত্রে তার কাছ থেকে কোন কিছু,শেখা এবং জানা দোষের কিছু নয়। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য, আর শর্ত হচ্ছে এই শেখার ব্যাপারটা সারতে হবে অতিথিকে বিরক্ত না করেই।

তবে অতিথি যদি সেচ্ছায় এবং সৌজন্যে কোন কিছু দিতে চান কিংবা নিজের স্বার্থে কোন কিছু চেয়ে বসেন তাতে খুব বেশি কিছু দোষের নেই। এই ক্ষেত্রে গৃহকর্তাকে নিজের ঐতিহ্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সাড়া দিতে হবে।

অতিথি সংক্রান্ত এই নিয়মটি চালু থাকে সাধারনত স্বাভাবিক সমাজে। কিন্তু আমাদের মতো সর্বহারাদের এই দেশে অতিথি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী কিনটন হোক আর যে হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসেনা। কারন প্রেম, আর যুদ্ধের মতো ক্ষুধারও তেমন কোন নিয়মের ধার না ধারলেও চলে।

তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম গুছিয়ে আমরা এখন মোটামুটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়ার কাছাকাছি। তাই আমাদের পেটের ক্ষুধা কমেছে । এতে হিলারীদের মত অতিথিদের পদচারনা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পেটের ক্ষুধা কমলেও আমাদের মনের ক্ষুধা যে কমেনি সেটা নিশ্চয় টের পেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এই ব্যক্তি।

হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশ পা রেখেই রাষ্ট্রীয় দিপাক্ষিক বৈঠক আর চলে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে তরুনদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন। এর মাঝে তিনটি বৈঠক করেছেন পাচ ব্যক্তির সাথে। এই পাচজন হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল, গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ব্রাকের চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ।

এই পাঁচজনের মধ্যে চার জনের হারানোর তালিকাটা একটু দীর্ঘ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন বাবা, মাসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে, বিরোধী দলীয় নেত্রী হারিয়েছেন স্বামী আর দুসন্তানের সুস্থতা, ইলিয়াস আলীর মেয়ে হারিয়েছে তার বাবাকে আর ড. ইউনুস হারিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীন ব্যাংক।

তবে এই ছাড়াও তরুনদের সাথে বসুন্ধরা স্কুলের আড্ডায় হিলারীর সাথে সাক্ষাত হয়েছে গুম হয়ে খুন হওয়া শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের ঘনিষ্ঠদের। এবং প্রতিনিয়ত গনতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব হারানোর আশংকায় ভুগতে থাকা একদল বাংলাদেশীর।

মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের কোটা ও শুল্ক মুক্ত প্রবেশে সরকারের দাবি, সরকার কর্তৃক অত্যাচার নিপীড়ন নিয়ে বিরোধী দলের নালিশ, বাবাকে উদ্ধারে সরকারের উপর চাপ দিতে ইলিয়াস কন্যা সাইয়ারার আবদার ও আমিনুল ইসলামের সহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবির দীর্ঘ তালিকা পেয়েছেন হিলারী। এতসব দাবি আর আবদারের ভিড়ে মুল্যবান এই অতিথি আসলে কি উপহার নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য সেটা হয়তো স্পষ্ট করতে পারেননি।

তবে এই সর্বহারাদের খপ্পড়ে পড়ে দিশেহারা হননি হিলারী,বিদায় বেলায় বিমান বন্দরে তার হাসি মুখ সে ইংগিত বহন করে। বরং এই সর্বহারাদের দেশে ২০ ঘন্টা অবস্থান কালে সারাক্ষনই নসিহত করে গেছেন মিলেমিশে থাকার। ধরে নিচ্ছি এই নসিহতই হিলারীর সবচেয়ে বড় উপহার আমাদের জন্য।

হিলারীদের মত অতিথিরা ঘুরে গেলে সর্বহারাদেরও মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়, আর আত্মবিশ্বাস থেকে আসে আত্মউপলদ্ধির সুযোগ। এই আত্মউপলদ্ধির জায়গা থেকে আমরা ধারনা করতে পারি, চীন ভারতের মত প্রতিবেশির কাছাকাছি থেকে ১৬কোটি মানুষের চল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশ এখন অনেকের আগ্রহের তালিকায় আছে।

মূলত ড.ইউনুস কান্ড নিয়ে হিলারী কিনটনের সফর বাতিল হয়েছিলো গতবছর। ধারনা করা হয়েছিলো গ্রামীন ব্যাংকের সম্মানজনক সদগতি করা না হলে ক্লিনটন আর বাংলাদেশ মুখো হবেন না। কিন্তু গ্রামীন ব্যাংক পরিস্থিতি এখনো টালমাটাল, শ্রমিক নেতা আমিনূল ইসলাম খুন হওয়া এবং বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় ঘোলাটে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও। তারপরও হিলারী এসেছেন, মন খুলে কথা বলেছেন, চুক্তিও করে গেছেন।

হিলারীর এই সফরে সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঝালাই হয়েছে, বিরোধী দল তাদের বিভিন্ন নালিশ জানাতে পেরেছে, দেশের তরুনরা সার্বিক পরিস্থিতিতে কতটুকু হতাশ তাও তুলে ধরেছে স্বপ্নের দেশ মার্কিন মূল্লকের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিটির কাছে।

মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা চীন দেশ হয়ে বাংলা ভুখণ্ডে এসেছিলেন চৌদ্দশ শতকে। একইভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনও বাংলাদেশে এসেছেন চীন হয়ে। ইবনে বতুতার বাংলা সফর এই ভূখণ্ডকে আলাদা মর্যদা দিয়েছিলো। তবে ইতিহাসে হিলারীর বাংলাদেশ সফর স্থান কোন পর্যায়ের হবে সেটা সময় বলবে।

ইবনে বতুতা নিজের লেখা ভ্রমন কাহিনীতে বাংলাকে অতিথিপরায়ণ একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ইবনে বতুতা। কিন্তু হিলারী যদি কোন ভ্রমন কাহিনী লিখেন তাহলে কি লিখবেন…?